উল্টো পিঠের সোজা কথা (৪) রিয়াজ হক
‘বিষণ্ণ ঝগড়াটে উদ্বিগ্ন বাঙ্গালী’
বাঙ্গালী আবেগপ্রবণ জাতি। বাঙ্গালী দিলখোলা, বন্ধুবৎসল। বাঙ্গালী অতিথিপরায়ণ। অন্যদিকে বাঙ্গালী পরশ্রীকাতর। ঈর্ষা ও প্রতিশোধপরায়ণ। বাঙ্গালী নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গে কুশলী।
আসলে, বাঙ্গালী কি? বাঙ্গালীর ইতিহাস, বাঙ্গালীর ঐতিহ্য, বাঙ্গালীর শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি নিয়ে অন্য অনেকের মতই আমার আগ্রহ মানব সভ্যতার মতই প্রাচীন। বাঙ্গালী ও বাংলাকে, বিশেষ করে পূর্ব বাংলাকে নিয়ে হাতের কাছে কোন বই পেলে তা পড়া ও জানার জন্য চিরদিনই আগ্রহী আমার মন।
এবার প্রায় তিন মাস (মধ্য জানুয়ারি থেকে মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত) ঢাকায় থাকার সময় বেশ কিছু বই পড়েছি। তার মধ্যে অন্তত দুটি বই এ পূর্ব বাংলা ও এর মানুষদের নিয়ে যে অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য পড়েছি এক কথায় তা অভূতপূর্ব। এখানে তাইই উদ্ধৃত করছি। কোন দিক থেকেই বই দুটি’র তুল্যমূল্য বিচার করছি না বা সাহিত্যিক বিচারে এদের অবস্থানও বিশ্লেষণ করছি না। এ থেকে নিজেদের পূর্ব পুরুষদের সম্পর্কে কিছু মৌলিক ধারনা পাওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
এক) ‘কোই হ্যায়’: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক, বিশিষ্ট লেখক মুনতাসির মামুনের অনবদ্য রচনা, ‘কোই হ্যায়’। এ রচনার প্রেক্ষাপট ব্রিটিশ শাসনামলে তৎকালীন ভারতবর্ষের পূর্ব বাংলায় ইংরেজ সিভিলিয়ানদের জীবন যাপন ও কর্মকাণ্ড নিয়ে তাদেরই রচিত উনিশটি স্মৃতি কাহিনী ভিত্তিক লেখা। এক অর্থে অনুবাদ ও অন্তর্গূঢ় বিশ্লেষণ। সময়কাল ১৭৭২ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। বই এর কলেবর বিস্তৃত; পৃষ্ঠা সংখ্যা পাঁচশরও অধিক। বলা বাহুল্য তাদের স্মৃতি কথার অংশ থেকে ভারত বর্ষের অন্যান্য অংশ বাদ দিয়ে কেবল পূর্ব বাংলার (বর্তমানের বাংলাদেশ) অংশটুকু নেওয়া হয়েছে। ব্রিটিশ (শ্বেতাঙ্গ) সিভিলিয়ানরা এদেশে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা ও আই সি এস অফিসার হিসেবে বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন।
ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে যারা কাজ করতে এসেছিলেন তাদের অধিকাংশই শিক্ষিত কিন্তু গরীব। গ্রামে থাকতেন। তাদের পিতারা ঘনিষ্ঠ ভাবে চার্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তৎকালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে চার্চের নিবিড় যোগাযোগ ছিল। আকর্ষণীয়, ভদ্র উপার্জনের জন্য গ্রামের অসচ্ছল ঐসব ব্যক্তিরা ভারতে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে রাইটারের চাকুরীর জন্য এ সুযোগ কাজে লাগাত। রাইটারের প্রশিক্ষণের জন্য তখন লন্ডনে বেশ কিছু স্কুল ছিল। প্রশিক্ষণ, যাবার প্রস্তুতি, ভাড়া সব মিলিয়ে খরচ ভালই ছিল। এখনকার আমাদের দেশের সন্তানদের মধ্যপ্রাচ্য যাবার পক্রিয়ার মতই তৎকালে পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করেও অনেকে সে খরচ যোগাতেন।
অন্যদিকে আই সি এস অফিসার হিসেবে যারা এদেশে এসেছিলেন তাদের বিভিন্ন একাডেমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মেধা-মন ও শরীরের যোগ্যতা (ঘোড় দৌড় সহ) প্রমাণ করেই ভারত বর্ষে চাকুরী নিতে হয়েছিল। এই সব ব্রিটিশ রাইটার ও আই সি এস অফিসাররা পদ-পদবী ভেদে ছয় থেকে ছাব্বিশ জন ন্যাটিভ আর্দালি-পিয়ন-মালী-বাবুর্চি সহ নানা অধিস্থনের সেবা ‘মনিবের প্রাপ্য’ অর্থেই গ্রহণ করেছেন দেখা যায়। ‘কোই হ্যাঁয়’ তাদের কণ্ঠের বহু প্রচলিত একটি বাক্য কেবল নয়, হুকুম-আদেশ সহ প্রভুত্বের সমার্থক একটি নির্দেশনা। যা উচ্চারণের সাথে সাথে ন্যাটিভ চাকররা মনিবের সেবায় পড়ি-মরি করে, বিনীত ভাবে করজোড়ে সামনে এসে দাঁড়াত। এতো একদিক।
আরেক দিকে বিস্তৃত নদ-নদী জলাভূমির এ বিশাল পূর্ববঙ্গ, অপরূপ নিসর্গ, উদার প্রকৃতি, অসংখ্য বন্যপ্রাণী পাখপাখালি নির্ভর এক ছায়ায় মায়ায় ভরা দেশ ছিল। কিন্তু এখানের মানুষ! সেখানেই এক বড় প্রশ্নের মুখোমুখি আমরা। আমাদের শিক্ষাদীক্ষায় আলোহীন, কুসংস্কারে ভরা নিম্ন বোধ বুদ্ধির জীবন ছিল। শতকরা প্রায় নব্বুই ভাগ ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সিভিলিয়ানরা আমাদের এ অঞ্চলের মানুষকে চিহ্নিত করেছেন “ঝগড়াটে, মামলাবাজ ও প্রতিশোধপরায়ণ” হিসেবে (পৃষ্ঠা ৩৩৮)। যেমন তারা বলেছেন, “ঢাকা হচ্ছে সবচেয়ে মামলাবাজ এলাকা। দিনে অন্তত দশটি মামলা দায়ের হত”। এটা ১৮৬৪ সালের কথা। যখন বৃহত্তর ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজার। তারা আরো বলছেন, “মামলা হল সব মানুষের প্রধান বিনোদন ও আনন্দ” (পৃষ্ঠা ৩৫১)। কেউ কেউ বাঙ্গালী মুসলমানদের সম্পর্কে আক্ষেপ করে বলেছেন, “যদি ক্ষুধার্ত ও হিংস্র ছোট কালো মুসলমানের মন খানিকটা সমঝোতাপূর্ণ ও যুক্তিবাদী হত” (পৃষ্ঠা ৩৪৫)।
ব্রিটিশ সিভিলিয়ানদের ঐ পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত একপেশে ও নিষ্ঠুর হলেও আমাদের এযাবৎ কালের নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে হলেও তার সত্যতা কি নিহিত নয়! আমরা কি প্রায় পৌনে দু’শ বছর পরেও তা থেকে বিপুল ভাবে সরে আসতে পেরেছি!
খ) ‘সংগঠন ও বাঙ্গালী’: ২০০৩ সালে মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ রচিত মাত্র আশি পৃষ্ঠার বই ‘সংগঠন ও বাঙ্গালী’। এটি অত্যন্ত সুচিন্তিত; আগাগোড়া বিশ্লেষণ মূলক। পর্যবেক্ষণে তীক্ষ্ণ ও বাস্তববাদী। লেখকের মতে, ৭১ এর আগ পর্যন্ত আমরা কোনদিনও স্বাধীন ছিলাম না। পাল, সেন, পাঠান, মোগল ও ব্রিটিশদের শাসন ও পরাধীনতাই ছিল আমাদের ভাগ্যলিপি। ফলে আমরা কখনই কোন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন গড়ে তুলতে পারিনি। পরাধীন হিসেবে দীর্ঘ সময় পার করায় আমাদের বোধ ও চেতনার ভেতর কোন “ন্যায় নীতি নেই, সমষ্টি কল্যাণ নেই, পরহিত নেই, নিজের উচ্চতর স্বার্থ নেই, কেবল আমিই আর আমার সংকীর্ণ স্বার্থ- এই সীমিত চেতনার মধ্যেই কি আমরা আমাদের উচ্চতর স্বার্থকে বিক্রি করে দিতে ভালবাসি?” (পৃষ্ঠা ১৫)।
“আমাদের অক্ষমতা আমাদের জীবনকে প্রায় প্রতিটা জায়গায় ব্যর্থ করে দিয়েছে। পরের ভাল দেখলে তাই আমরা কষ্ট পাই, বিষণ্ণ হয়ে পড়ি। অক্ষম মানুষ সাধারণত ব্যর্থ হয়, ব্যর্থ মানুষ হয় পরশ্রীকাতর। পরশ্রীকাতরতা তাই আমাদের জীবনের সার্বভৌম অধীশ্বর। অক্ষমতার কারণে তাই আমরা নেতিবাচক। আমরা যে পরিমাণে নিষ্ফল, সেই পরিমাণে নিন্দুক। নিন্দার ভেতর দিয়ে নিজেদের অক্ষমতার প্রায়শ্চিত্ত খুঁজি। (পৃষ্ঠা ৪৩)।
এ থেকে বেড়িয়ে আসার পথ খুঁজতে লেখক যেমন চিহ্নিত করেছেন এর রোগগুলোকে (ব্যক্তিগত অসহায়তা, অক্ষমতা, হীনমন্যতা ও আত্মঘাত) তেমনি বলেছেন, “আমি যে বাঙ্গালীর আত্মপরতার কথা বলেছি আমার ধারনা এর প্রধান কারণ স্বাস্থ্যহীনতা। নির্জীব স্বাস্থ্যের কারণে সে এমন নিষ্প্রাণ ও গৃহপালিত।” (পৃষ্ঠা ৫৮)।
“আমাদের স্বাস্থ্যগত দুর্বলতার সঙ্গে আমাদের জীবনের সংগ্রামহীনতা যোগ হয়ে আমাদের এমন চলৎশক্তিহীন আর নিষ্প্রাণ করে দিয়েছে। মোদ্দা কথা মৃদু ও বন্ধুভাবাপন্ন আবহাওয়ার কারণে আমাদের স্বাস্থ্যের উদ্দীপনা ও কাজের স্পৃহা হয়ত কিছু পরিমাণে কম।” (পৃষ্ঠা ৬৪)। শত বা হাজার বছরের সংস্কার ভেদ করে আমাদের জেগে উঠতে, পূর্ণ মানবিকতা বোধে উদ্বুদ্ধ হতে আর কতদিন, কত সময় !
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|