উল্টো পিঠের সোজা কথা (৩) রিয়াজ হক
“বেহুদা কথা!”
একটা গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। গ্রামের একটি খালের দু’পার দিয়ে দু’জন লোক অনেকক্ষণ ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। একজন আনমনে; অন্যজনের কাঁধে পাঁচ/ছ হাত লম্বা একটি বাঁশ, হাঁটছেন কিছুটা দ্রুতলয়ে। হঠাৎ লয় শান্ত করে তিনি অপর পাড়ের লোকটির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, “ভাই, একটু দেখে শুনে হাঁটেন, আমার বাঁশের খোঁচা যেন আপনার গায়ে না লাগে”। তখন অপর পাড়ের লোকটি হেসে বললেন, “ভাই, আপনার হাতে অনুমান করি, পাঁচ/ছ হাত লম্বা বাঁশ, খালটিও তো দশ-বারো হাতের বেশী চওড়া। আপনি আর আমি হাঁটছিও সোজা / কোনভাবেও তো আপনি চাইলেও বাঁশ দিয়ে আমাকে খোঁচাতে পারবেন না। তা কেন এরকম কথা”! তখন বাঁশ কাঁধে লোকটি বললেন, “ভাই, এই একটু আপনার সাথে আলাপসালাপ করি আর কি”!
অর্থাৎ কথা বলতে চাই। কথা না বলে দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকা মানুষের জন্য বড়ই কঠিন। আমার ধারনা, দাগী অপরাধীদের নির্জন প্রকোষ্ঠে রাখা হয় কথা না বলতে পারার অসহ্য শাস্তিতে সমর্পিত করার জন্যই। আমরা কথাজীবি প্রাণী। আমরা কেবল বলতে চাই। এমন কি শোনার চেয়ে বেশী বলাতেই আমাদের আগ্রহ ও আনন্দ। কোথাও বলার সুযোগ পেলে আমরা থামতে চাই না, শ্রোতার কানে বা মনে তা যতই অস্বস্তি ছড়াক না কেন। এমন কি শ্রোতা তার দেহভঙ্গিতে যতই বিরূপ প্রতিক্রিয়া তুলে ধরুক না কেন আমরা তাও লক্ষ্য বা গ্রাহ্য করি না। এমনই আমাদের কথা বলার অপ্রতিরোধ্য তাড়না। কিন্তু কথা কি করে!
কথা হাঁটে। মাঠে, ঘাটে, বাজার-হাটে। কথা থামে। তাকায় ডানে-বামে। কথা দৌড়ায়। অযাচিত উৎকণ্ঠায়। কথা, কথা বলে। ছলে-বলে-কৌশলে। কথা খায়-দায়-ঘুমায়। সময়ের নিরন্তর স্রোতধারায়। কথা বিদ্যুৎ গতিতে অতিক্রম করে গ্রাম-পাড়া-জনপদ। দেশ-মহাদেশ, সময়ের রথ। কথার রঙ-রূপ-রস; বর্ণময়, অনন্য, সরস।
যেমন আমরা বলি:
এক. কথাটা কি সত্যি? (গুরুত্ব উপলব্ধিতে) দুই. কথাটা রাখবেন তো! (কাতর অনুনয় অর্থে) তিন. আপনি কিন্তু কথা দিলেন। (প্রতিশ্রুতি আদায় অর্থে) চার. কথা বলতে চাই না, তবু বলতে হচ্ছে। (অভিপ্রায় অর্থে) পাঁচ. এটাই আমার শেষ কথা। (ওজন অর্থে)
এমনি নানা কথা বা কথার নানা প্রকাশভঙ্গী। কখনো এ প্রশ্ন কি আমরা করে দেখেছি যে কথা আসে কোত্থেকে। আমাদের জীবনের নানা ঘটনা-অভিজ্ঞতা, চিন্তা-পড়াশুনা, অনুভূতি-প্রতিক্রিয়া তারই বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই আসে কথা।
কথা নিসর্গের অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের মত। ভোরের ফুটে উঠা জীবনদায়ী আলোর মত। কথা শিশির স্নিগ্ধ শরতের সকালের মত। কথা মুগ্ধতা ছড়ানো অবোধ শিশুর সরল হাসির মত।
আবার কথা অশরীরী আততায়ীর শানিত কৃপাণের মত। কথা প্রতি-নায়কের নিষ্ঠুর ক্রূর হাসির মত। কথা হৃদয় ভেদ করা ধনুকের বিষাক্ত তীরের মত।
কথা ঋদ্ধ করে। কথা বিদ্ধ করে। কথা খোঁচায়। কথা বাঁচায়। কথায় যতি। কথায় গতি। কথায় প্রণয়। কথায় সংশয়। কথায় আলাপ। কথায় অপলাপ। কথায় প্রগতি। কথায় অধোগতি। কথায় শ্লীলতা। কথায় অশ্লীলতা। কথা রিক্ত করে। কথা সিক্ত করে। কথা মিশে থাকে খোলা প্রান্তরে। অরণ্য ও আকাশ নীড়ে। কথা পুষ্টি পায়, মৃদু মন্দ হাওয়ায়। কথায় রঙ লাগে। চমকিত ঢং জাগে। কথা সাজে, অকারণ কাজে। কথা নতুন ডালপালা ছড়ায়। কথা পত্র পুষ্পে পল্লবিত হয়। কথা চাকুরী দেয়, কথা চাকুরী নেয়। কথায় তৈরি হয় যে সম্পর্ক সে সম্পর্কে ভাঙ্গনও ত্বরান্বিত করে কথা। কথায় প্রেম, কথায় বিরহ। কথায় আন্দোলন, কথায় সমঝোতা। কথায় শ্রান্তি, কথায় বিভ্রান্তি। কথায় জয়, কথায় বিপর্যয়। কথায় গৃহানন্দ, কথায়ই গৃহদাহ।
বেহুদা-বেসামাল কথা বলে পরিবারে-সমাজে বিপর্যস্ত হয়েছেন এমন লোককে তো আমাদের দেখা। তারপরও এ থেকে আমাদের নিষ্কৃতি নেই। কারণ আমরা মূল্য বুঝে কথা বলি না। কথা যে কি পরিমাণ দামী, কতটা যে মূল্যবান তা আমরা ক’জন ঠাহর করি। ঠাহর করি তখন, যখন আমারই একটি কথা বুমেরাং হয়ে আমাকেই বিদ্ধ করে। অথবা আমার কোন কথা অন্যের চোখে আমাকেই অপাংতেয়, মূঢ় ও হাস্যস্পদ করে তুলে।
কথা বিনয়ের পরিচয় দেয়। কথা সভ্যতা-ভব্যতার মানদণ্ড তৈরি করে। কথা ব্যক্তি কে মর্যাদার আসনে আসীন করে। কথা সংস্কৃতি বোধ ও রুচিকে তুলে ধরে। কথা ভালবাসতে শেখায়। সুতরাং কথা বলি হিসেব করে। কথার অমূল্য মূল্যকে মাথায় রেখে।
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|