উল্টো পিঠের সোজা কথা (১) রিয়াজ হক
“হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যকুল”
ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টগ্রাম, পিন্টারেস্ট, হোয়াটস অ্যাপ সহ নানা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিপুল আন্দোলিত এ সময়।
‘আমি ভাল নেই, তুমি’! ‘তুমি হারিয়ে গেলে কোন বিজনে’। ‘কালের কণ্ঠ থেকে ভেসে আসে নবজীবনের গান’। ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই’।
অযুত কথা, শব্দ, ছবি ও গানের নানা ভাবভঙ্গীর প্রকাশে আজ উপচে পড়ছে সোশাল মিডিয়ার অবারিত আধার। যে যেভাবে চাচ্ছেন, ভাবছেন, চিন্তা ও উপলব্ধি করছেন তার সবই নানা প্রক্রিয়ায় প্রচার পাচ্ছে সোশাল মিডিয়ায়। এতে কে উল্লসিত বা আমোদিত হল, কার হৃদয় ফুঁড়ে চলে গেল বিষাক্ত তীরের অব্যর্থ ভেদ, কে সম্মানিত বা অপমানিত হল, কার মনের মন্দির ছেয়ে গেল নিকষ কালো আঁধারে, কে সব ব্যর্থতা ভুলে দৃঢ় পায়ে উঠে দাঁড়ানোর প্রবল শিহরনে হল কম্পিত আবার কার হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে জীবনের বেঁচে থাকাকেই করে তুলল অসহনীয় কে তার খোঁজ রাখে!
আর খবর রাখলেই বা কি! এই প্রকাশ্য, গতিশীল, উচ্চকিত ও তীব্রতায় দুর্বিনীত মাধ্যমগুলোর কাজই হচ্ছে নিজেকে ত্বরিত ঘূর্ণির আকারে জানান দেওয়া। সে ভৈরব, মালকোষ, সারঙ্গ, হিন্দোল, দীপক বা মেষ নামক শাস্ত্রীয় সংগীতের যে কোন রাগকে আশ্রয় করেই নিজের অবস্থান জানান দিক না কেন। প্রবল বানের জল যেমন নির্দয় ভাবে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ঘর-বাড়ি, ফসল-ফুল, গলিত মৃত প্রাণী; জীবিতের বিষ্ঠাসহ নর্দমার দূষিত জলজ প্রবাহ তেমনি যেন এসব সামাজিক মাধ্যমগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবনের প্রতিদিনের সুখস্বপ্ন, হাসি-কান্না, সাফল্য-ব্যর্থতা, গ্লানি, অপরাধ-অপবাদের ভ্রান্ত-অভ্রান্ত সব কাহিনী।
আমরা জেনে, না জেনে, ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় আজ এর অংশ হয়ে গেছি। আমি হয়ত চাইনি, ইচ্ছাও নেই তারপরও পারিবারিক-সামাজিক বা দল-গোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে উপস্থিতির সৌজন্যে, দ্বিতীয় কারো বদান্যতায় স্থান পেয়ে যাচ্ছি সোশাল মিডিয়ার পাতায়। এমনকি কৌতুকের ছলে বলা আমারই কোন কথা অডিও-ভিডিওর আকারে ছড়িয়ে পড়ছে এসব মাধ্যমে। আমাদের সাধ্য কি নিয়ন্ত্রণ হীন এইসব প্রচার রুখে দেওয়ার! ‘হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যকুল’ নামের আমাদের প্রলুব্ধ আচরণের হঠকারিতায় আজ আক্রান্ত হয়ে পড়ছে তৃতীয় ব্যক্তি; ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের বোধ, অভিপ্রায় ও সম্মতি।
তাহলে, প্রয়োজনীয় ও গুরুতর প্রশ্ন হল নিজের স্বতন্ত্র পরিচয়, বিশ্বাস ও আচরণকে সংরক্ষিত করতে হলে কি করা প্রয়োজন। সবার থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া? সামাজিক যোগাযোগের সমস্ত মাধ্যম থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া? নিঃস্ব, নির্জন, একাকী হয়ে যাওয়া? বাস্তবতার নিরিখে এ যুগে, এ সময়ে এটা কি সম্ভব? বাঞ্ছনীয়? আমার মনে হয়, তা নয়। তা হলে?
এক. সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিজেকে সীমিত করা। নানা প্লাটফর্মে অবস্থান না করে একটি বা দু’টিতে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখা।
দুই. বেঁছে বেঁছে বন্ধু গ্রহণ করা। অপ্রয়োজনীয়দের (বন্ধুর বন্ধু, দূরবর্তী বন্ধু, নিজের ভাবনার উল্টো স্রোতের বন্ধু ইত্যাদি ) ছেঁটে ফেলা।
তিন. নিজের একাউন্টকে নিরাপদ রাখার জন্য নিরাপত্তা বিধানের সমস্ত অপশনগুলোকে সচল করা।
চার. একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কোন কথা না বলা।
পাঁচ. পুনরায় ফিরে যাওয়া সোশাল মিডিয়ার পূর্ববর্তী জীবনাচরণে (বই পড়া, গান শোনা, ছবি আঁকা, বাগান করা বা নিজের শখের কোন কাজ করা)।
ছয়. নিজের ও পরিপার্শ্বের জীবন মানের উন্নয়নে চিন্তাকে কেন্দ্রীভূত করা।
আমি এ ধারনায় আজ প্রবলভাবে বিশ্বাসী যে সোশাল মিডিয়ার বল্গাহীন ব্যবহার আমাদের জীবনের নানা বিভ্রান্তিকে উস্কে দিচ্ছে। আমাদের বিবেচনা বোধকে ক্ষত বিক্ষত করছে। সৃজনশীলতাকে নিম্নগামী করছে। অনেক মূল্যবান সময় কেঁড়ে নিচ্ছে। যে সময় আমরা নিজেকে, পরিবারকে, সমাজ ও পরিবেশকে দিতে পারতাম তা আমরা প্রকাশ ও প্রচারের নেশার ঘোরে বিলিয়ে দিচ্ছি ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টগ্রামের পাতায়।
সব শেষ কথা, এসব মাধ্যমে যারা সৃষ্টিশীল কাজ করছেন, সংখ্যায় কম হলেও তাদের অভিনন্দন। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম দিয়ে তো আর সর্বগ্রাসী অনুৎপাদনশীল আচরণ কে অবোধের মত মেনে নেওয়া যায় না!
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|