তিন পয়সার জ্যোছনার সৈয়দ শামসুল হক ও ফজলে লোহানী রিয়াজ হক
‘শেষের কবিতার পরের কবিতা’ গল্পের পটভূমি অনেকটা এরকম: অমিত অনেক দিনের বিবাহিত, কেতকীর সঙ্গে। লাবণ্যও তার স্বামী শোভনলালের সঙ্গে সংসার করছে। হঠাৎ করেই তাদের দেখা বোম্বের সমুদ্রতীরের মেরিন ড্রাইভে। সেখানে ইন্ডিয়া গেটের কাছে নানা মানুষের ভিড়ে আরো দেখা মেলে এক শ্রেণীর দালাল ও গণিকার। সেই গণিকাদের একজন সরস্বতী। গল্পের মূল চরিত্রও সে। তাকে কেন্দ্র করেই এগুতে থাকে গল্প।
এই গল্পের লেখক আর কেউ নন, সৈয়দ শামসুল হক; পাঠকও তিনি। পাকিস্তান সাহিত্য সংসদে গল্প পাঠের আসরে এই তার প্রথম কোন লেখা পাঠ। অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘সওগাত’ প্রেসের গুদাম ঘরে। সভাপতির আসনে ধ্যানস্থ কাজী মোতাহার হোসেন। উপস্থিত পঞ্চাশের যুগের অনেক প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ লেখক।
একসময় গল্প পড়া শেষ হয়। কারো মুখেই কোন ভাবান্তর নেই। সভাপতির নীরব নির্দেশে খালেদ চৌধুরী শুরু করলেন আলোচনা। তিনি গুহাযুগ, লৌহযুগ, তাম্রযুগ, আগুনের আবিষ্কার, ফিনিশীয়দের হাতে লিপির উদ্ভব প্রভৃতির উল্লেখে, সংক্ষেপে পুরো মানব সভ্যতার আলোচনা শেষে বললেন, “মানবের এই দীর্ঘ ইতিহাসে এর চেয়ে নিকৃষ্ট গল্প আর হয়না”। যেন নিঃশব্দে হল অভাবিত বজ্রপাত। খাঁচায় আবদ্ধ পাখি যেন বিষাক্ত তীরে হল অকাল বিদ্ধ। সৈয়দ শামসুল হক ঠিক করলেন, আর নয়, এ মুহূর্ত থেকেই হোক লেখার ও লেখকের স্বপ্নের মৃত্যু।
রাত দশটা প্রায়। সাহিত্য সংসদের সভা শেষে অলক্ষ্যে চুপিসারে সওগাত অফিস থেকে বেড়িয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত এক ডালিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অপমান ও হতাশায় জর্জরিত সৈয়দ শামসুল হক নীরব অশ্রুপাত করছিলেন। ঠিক সেই সময় একটি নির্ভরতার হাত এসে পড়েছিল তাঁর কাঁধে। বলেছিল, “ওই যে ওদের দেখছ, একদিন ওরা কেউ থাকবে না। তুমি থাকবে। এসো আমার সঙ্গে”। সৈয়দ হকের নিজের ভাষায়, “আমাকে পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকার মেদটি শক্ত করে দিয়েছিলেন ওই একজনা-তিনি ফজলে লোহানী”। সাহিত্য প্রেমী, সম্পাদক, গল্প লেখক, উপস্থাপক, সমালোচক, বন্ধুবৎসল, স্বাপ্নিক এক পুরুষ এই ফজলে লোহানী। তিন পয়সার জ্যোছনায় নির্মিত ফজলে লোহানী হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি জীবনের ঘাটে ঘাটে নিজেকে কণায় কণায় ছড়িয়েছেন কিন্তু কখনোই তা থেকে নিজেকে কানায় কানায় ভরিয়ে তুলতে পারেন নি।
নিঃসন্দেহে তিন পয়সার জ্যোছনার কেন্দ্রীয় চরিত্র সৈয়দ শামসুল হক। যেহেতু এ তার নিজের জীবনেরই গল্প। লেখক হিসেবে তাঁর তৈরি, অবস্থান ও বেঁড়ে ওঠার গল্প। তবে মাঝে মাঝেই ভ্রম হয়, একি একই সঙ্গে বহুমুখী প্রতিভার অম্লান অধিকারী ফজলে লোহানীরও গল্প নয়! সৈয়দ হকের ভাষায়, সেই সময়ের তরুণদের কাছে অপেক্ষাকৃত জনপ্রিয় ‘অগত্যা’ পত্রিকার সম্পাদক ফজলে লোহানী যিনি লেখার অনেক পুষ্পকলি অবারিত দেখে উঠতেন কিন্তু কলমে তার কতিপয়ই ফুটত। তবে ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ, খোঁচা, মশকরা আর দারুণ সব রোমান্টিক গল্পে ঠাঁসা ছিল লোহানীর সম্পাদনায় প্রকাশিত ওই সময়ের ‘অগত্যা’। অগত্যার প্রকাশভঙ্গীর তীব্র আক্রমণে তখন ধরাশায়ী হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানী এস্টাব্লিশমেন্টের ধারক বাহকেরা। এটা সেই সময় যখন যুক্তফ্রন্ট জিতল প্রাদেশিক নির্বাচনে। মুসলিম লীগের হল ভরাডুবি। অচিরে পূর্ব বাংলায় নেমে এল কেন্দ্রের শাসন।
সাহিত্যের পত্রিকা, আধুনিক বইয়ের দোকান, মোটর গাড়ি, অনিন্দ্য সুন্দর সঙ্গিনী, অঢেল টাকা কি তার না চাই। একদিকে এসব চাওয়ার অবারিত আকাশে দুহাত মেলে পাখির মত ভেসে যাওয়া অস্থির উন্মুখ ফজলে লোহানী আর অন্যদিকে লেখক হিসেবে নিজেকে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত করতে উদগ্রীব দুহাতে লিখে যাওয়া সৈয়দ শামসুল হক। এরা কখনও বসছেন ঢাকার গ্রিন হোটেলে, গুলিস্তান সিনেমা হলের পূর্ব প্রান্তের গুলিস্তান রেস্তোরায়, রথখোলার মোড়ের খোশ মহলে, সদরঘাটের রিভার ভিউ ক্যাফেতে, মুকুল সিনেমা হলের পাশের মিরিন্ডার রেস্তোরায় বা স্টেডিয়ামের মোড়ে কসবায়। খাচ্ছেন, গল্প করছেন, জীবনের স্বপ্ন সাজাচ্ছেন অমিত যৌবনের সাহসী শক্তিতে। কিন্তু লিখছেন, ক্রমাগত লিখে যাচ্ছেন একজনই। তিনি ফজলে লোহানী নন, তিন পয়সার জ্যোছনার সৈয়দ শামসুল হক। তিনি তিন পয়সার জ্যোছনাকে সাজিয়েছেন অত্যন্ত ঋজু, কঠিন সরল সত্যে। যে কাহিনীর প্রধান চরিত্রে তিনি থেকেও ফজলে লোহানী তারই পাশাপাশি হয়ে উঠেছেন পরম আরাধ্য, আকর্ষণীয় ও মোহনীয় এক চরিত্র।
তিন পয়সার জ্যোছনায় সৈয়দ শামসুল হক তাঁর কৈশোর পেরোনো জীবনের সূচনা থেকে প্রায় মৃত্যু অবধি যাপিত জীবন ও তার স্বাদ-বিস্বাদ ও আশা-আকাঙ্ক্ষার গল্প নিরলস বর্ণনা করেছেন। এর সাথে ভীষণ ভাবে জড়িয়ে আছে হিমালয়ের উৎস থেকে রচিত বর্ষায় উন্মত্ত ধরলা পাড়ের কুড়িগ্রাম। আছে পুরনো ঢাকার স্মৃতি চিহ্নের কাহিনী। আছে পঞ্চাশের দশকের প্রতিভাবান লেখক, শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রায় প্রতিদিনের জীবন কথা। সৈয়দ হকের নিজের ভাষায়, “আমার তরফে এ গল্প আমি বলে গিয়েছি স্মৃতি কথনের দ্রুত তালে, যতি চিহ্নে মানিনি প্রথাগত রীতি, নিঃশ্বাস পতনেরও অবকাশ রাখিনি বহু ক্ষেত্রে-এভাবেই আমি আর আমার সেই পঞ্চাশের দশক”।
ছেলেবেলায় চাচিমার মুখে ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমির গল্প, কুড়িগ্রামের বাড়িতে জায়গীর থাকা ছাত্র আমিনুল ইসলামের কবিতার পদ রচনা, বাঁধানো লম্বা ফর্দের খাতায় কম্পাউন্ডার মজিবরের কবিতা লেখার ঝোঁক বা এলাকার একনিষ্ঠ কম্যুনিস্ট কর্মী ব্যাকাদার হাঁটে হাঁটে যেচে পুস্তক বিক্রি ও ধরলা নদীর বৈভব তাঁকে কৈশোরেই লেখার প্রতি মোহগ্রস্ত করেছিল সন্দেহ নেই। আর তারই ফলশ্রুতিতে প্রবোধ কুমার সান্যালের ‘ক্ষয়’ গল্পের অনুকরণে লেখা একটি গল্প লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ফজলে লোহানীর অগত্যা পত্রিকায়।
সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম ১৯৩৫ এর ডিসেম্বরে। বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হোসাইন হোমিও চিকিৎসা শাস্ত্রের সাতটি গ্রন্থের রচয়িতা-বাঙ্গালি মুসলিমদের মধ্যে প্রথম। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেও তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন ঔষধ তৈরির নানা পরীক্ষা নিরীক্ষায়। ছেলেকে বানাতে চেয়েছিলেন চিকিৎসক। ১৯৪৮ এ ছেলেকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন জয়নাল নামের এক কাজের যুবককে সঙ্গী করে। ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে। ইংরেজি নিয়ে পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু লেখাই যার আরধ্য ও নিয়তি তার পক্ষে নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষা জীবন কোন কাজের কথা নয় ! তাই শেষ হয়নি বা শেষ করেননি কোন কাগজের ডিগ্রি। প্রথম বই ‘তাস’। দেশ পত্রিকায় যার নাতিদীর্ঘ সমালোচনা বেড়িয়েছিল। সচিত্র সন্ধানীতে ‘তিন পয়সার জ্যোছনা’ পড়েই মেডিকেলের ছাত্রী আনোয়ারা বেগম চৌধুরী (পরবর্তীতে লেখিকা আনোয়ারা সৈয়দ শামসুল হক) আসেন তার জীবনে। মাটির পাহাড় ও সুতরাং ছবির মত ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন, গান লিখেছেন কাগজের নৌকা, আয়না ও বিনিময়ের মত সুস্থ সুন্দর চলচ্চিত্রের। নাটক, উপন্যাস ও গল্প একের পর এক। বৈশাখে রচিত পংতিমালার মত কবিতার রচয়িতাও তিনি।
সেই পঞ্চাশে তিনি পেয়েছিলেন ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাটা’র শামসুর রাহমান কে। সোনালী কাবিনের আল মাহমুদ কে। ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’র শহীদ কাদরি কে। তৎকালে সদর ঘাটের বিউটি বোর্ডিং ছিল তাদের আড্ডার কেন্দ্রস্থল। কে আসেনি সেখানে ! নীলক্ষেত থেকে কবি সাইয়ীদ আতিকুল্লাহ, লক্ষীবাজার থেকে ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’র কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সলিমুল্লাহ হল থেকে গল্পকার আলাউদ্দিন আল আজাদ, ফজলুল হল থেকে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো’ গানের রচয়িতা আব্দুল গাফফার চৌধুরী। আসছেন চিত্রকর আমিনুল ইসলাম, রশীদ চৌধুরী, মোহাম্মদ কিবরিয়া, হামিদুর রহমান, দেবদাশ চক্রবর্তী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, মুর্তজা বশীর, আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ। আর ওই যে শুরুতেই সৈয়দ হকের গল্পের সমালোচক যে খালেদ চৌধুরীর কথা উল্লেখ করেছিলাম সে ছিল লোহানী পরিবারের ঘনিষ্ঠ। ‘দ্য মুসলমান’ পত্রিকায় সাংবাদিকতার সূত্রে লোহানী ও খালেদ চৌধুরীর পিতার পরিচয়। দর্শন আর ইতিহাস ছিল খালেদ চৌধুরীর প্রিয় বিষয়। পরবর্তীকালে সৈয়দ হকের সাথেও তার প্রগার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সেই দশকে ও পরবর্তীকালে খালেদ চৌধুরীকে মানা হত দর্শন ও ইতিহাসের চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া হিসেবে। এমনকি তাকে ডাকা হত ‘প্রভু’ নামে।
এ এমন একটা সময় যখন “কবিতা ছিল কায়কোবাদের খপ্পরে, উপন্যাস নজিবর রহমানে বন্দী আর নাটক প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ তে। বিশ্বের সমসাময়িকতা ও আধুনিকতার সঙ্গে ছিল না সাধারণ পাঠকের বিন্দুমাত্র যোগ। এই যোগাযোগ ও রুচিটা তাদেরই গড়ে দিতে হয়েছিল বিরামহীন লেখায় ও লেখার চর্চায়”। এভাবেই সে সময়ের আবহকে তুলে ধরেছেন সৈয়দ শামসুল হক।
তিন পয়সার জ্যোছনা নতুন ভঙ্গিতে লেখা। সে কথা নিজেই বলেছেন তিনি। সাধারণ বাক্যের প্রথাগত ব্যাকরণ মেনে লিখেন নি। অর্থাৎ দাড়ি, কমা, সেমিকোলনের প্রয়োগে। অথচ বর্ণনা দিব্যি ঝরঝরে। গতিময়। মেদ হীন। ঘটনার বিস্তৃতি আছে, বাহুল্য নেই। কল্লোলিত নদীর মত। এত আন্তরিক আর ভালোবাসায় স্নাত এর বর্ণনা যে তা আশ্চর্য রকম স্নিগ্ধ, স্বচ্ছ ও মনোরম। বার বার পড়েও মনে হয়, কি যেন বাকি রয়ে গেল, আবার পড়ি। পঞ্চাশের সাহিত্য ও শিল্পকলার বিকাশ কে যারা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন বা এর সঙ্গে পরিচিত হতে চান, এ বই তাদের অবশ্যই পাঠ্য।
(তিন পয়সার জ্যোছনা। লেখক: সৈয়দ শামসুল হক। প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন। প্রথম প্রকাশ: একুশে বইমেলা ২০১৪ তৃতীয় মুদ্রণ: ২০১৬)।
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|