দ্য ফিজিশিয়ান রিয়াজ হক
আমেরিকান ঔপন্যাসিক নোয়াহ গর্ডন (Noah Gordon) এর লেখা ঐতিহাসিক উপন্যাসের চিত্ররূপ, The Physician ছবিটি Netflix এ দেখেছি সাত/আট মাস আগে। তখন থেকেই ভাবছিলাম যে ইতিহাস সমৃদ্ধ অভূতপূর্ব এই চলচ্চিত্রটি নিয়ে লিখব। এটি ২০১৩ সালে নির্মিত একটি ছবি। দুই ঘণ্টা ত্রিশ মিনিটের এই ছবির পরিচালক Philip Stotzl. এতে অভিনয় করেছেন গান্ধী খ্যাত বিখ্যাত অভিনেতা বেন কিংসলি সহ অনেকে।
কাহিনীর পটভূমি মধ্যযুগের ইউরোপ। তখন ছিল ব্ল্যাক ম্যাজিক এর প্রবল প্রসার। চর্চার অভাবে ইউরোপের মানুষ বিস্মৃত হয়েছিল বা হারিয়ে ফেলেছিল মহান দার্শনিক-চিকিৎসক হিপোক্ক্রিটস ও গ্যালেন আবিষ্কৃত মানুষের সাধারণ রোগ নিরাময় পদ্ধতি। ফলে সে সময় বাংলাদেশের কবিরাজদের আদলে সারা ইউরোপ জুরে ছড়িয়ে পড়েছিল বারবার সার্জনরা। তারাই মানুষের রোগ নির্ণয় ও নিরাময়কে লাভজনক পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিল। যদিও সে যুগে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী চার্চ তাদের পেশা ও কাজকে অনেকাংশেই যাদু বিদ্যার দায়ে অভিযুক্ত করে নানা দণ্ড ও শাস্তি প্রদান করত।
ছবিতে আমরা রবার্ট কোল নামে এক বালক কে দেখি যে ছিল বুদ্ধিদীপ্ত এক অসাধারণ কিশোর। যখন কোন বারবার সার্জন কোন রোগীর চিকিৎসা প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করত বা চিকিৎসা শুরু করে মাঝ পথে ছেড়ে দিত সে বুঝত যে এটি তার পক্ষে একটি সম্ভব-হীন অনিরাময় যোগ্য এক রোগ। তার কিশোর বয়সে তার মায়ের এপেন্ডিসাইটিসের ব্যথার সৃষ্টি হয় যদিও প্রকৃত জ্ঞানের অভাবে সে যুগে তাকে সাইড সিকনেস নামে অভিহিত করা হত। তারা শুধু এটুকু জানত যে দেহের ভিতরের কোন অঙ্গ থেকে এ রোগের উদ্ভব যার ফলে রোগী প্রদাহ-বমি-ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু এর নিরাময় তারা জানত না।
মায়ের ব্যথার কষ্ট দেখে সেই বালক সিদ্ধান্ত নেয় যে সে একজন বারবার সার্জনের সহযোগী হয়ে রোগ নিরাময়ের পদ্ধতিগুলো জেনে নিবে। সে মতে তার গ্রামে এক সার্জন এলে সে ভীষণ নাছোড়বান্দা হয়ে তার সাহায্যকারী হিসেবে কাজ শুরু করে। বারবার তাকে Cupping Theory (জ্বর, পিঠে ব্যথা, বদ-হজম, উচ্চ রক্তচাপের উপশম ), Blood Letting (জোঁকের মাধ্যমে দূষিত রক্ত বের করে দেওয়ার পদ্ধতি), Dental Extraction (দাঁতের ক্ষয়, দাঁতে ব্যথা, মাড়িতে পুঁজ প্রভৃতিতে সাঁড়াশি দাঁত তুলে ফেলা) প্রভৃতি কাজ শিখিয়ে দেয়। ছোট হলেও সেই বয়সে সে বুঝে গিয়েছিল যে তার মায়ের অসুখের মতই মানব দেহের ভেতরের বহু জটিল রোগের উপশম ও মুক্তিতে বারবার সার্জন এর জ্ঞান ও ক্ষমতা সীমিত।
ঘটনা ক্রমে এক সময় সেই বারবার সার্জনের দৃষ্টি শক্তি কমে চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করল। তখন সেই বালক তার জন্য কিছু করতে অনেক খুঁজে এক ইহুদী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হল। যারা দলবদ্ধ ভাবে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে ঘুরে মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিত কিন্তু কিছুতেই তাদের এই চিকিৎসা পদ্ধতি কাউকে শেখাত না।
যাহোক, ইহুদী চিকিৎসকেরা বারবারের চোখের মূল কারণ যে চোখের ছানি তা সনাক্ত করে তা অপসারণ করে তাকে নিরাময় করে তুলল। সে ছেলেটি ঐ ইহুদী চিকিৎসকদের মাধ্যমে এ জ্ঞান শিক্ষার জন্য সে সময়ের পৃথিবী খ্যাত চিকিৎসক ইবনে সিনার কথা জানতে পারল। সে এও জানল যে সে থাকে বহু দূরে পার্সিয়ার (বর্তমানের ইরান) কাকুজিদ নামক এক অঞ্চলে। এটা শোনা মাত্র তার শিশু বয়সে তার মায়ের অসুস্থতার স্মৃতি, তার দুঃসহ যন্ত্রণা, তার মৃত্যু তাকে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ করল এ জ্ঞান অর্জনের জন্য।
ইসলামের সোনালী স্বর্ণ যুগের (আব্বাসীয় খেলাফত-৮ম শতাব্দী থেকে ১৩শত শতাব্দী) সেই সময় ইউরোপের তুলনায় বহু ক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিল মুসলিম রাজত্বের চিকিৎসা পদ্ধতি। সেই সময় পার্সিয়ার ইস্পাহানে ইবনে সিনার কাছে চিকিৎসা সহ নানা বিষয়ে জ্ঞান লাভ ও প্রশিক্ষণের জন্য সারা বিশ্ব থেকে মানুষ আসত। একমাত্র খৃষ্টানদের আগমন নিষিদ্ধ ছিল।বলা বাহুল্য, ইহুদী সহ অন্য ধর্মের লোকদের অবাধ যাতায়াত ছিল।
রবার্ট কোল খৃষ্টান হওয়াতে তার জন্য ইবনে সিনার কাছাকাছি হওয়া ছিল এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু রব (রবার্ট) নাছোড়বান্দা, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, সে চিকিৎসা শাস্ত্রের সর্বশেষ জ্ঞান আহরণ করবেই। অদম্য ইচ্ছা শক্তি ও জ্ঞানের প্রবল তৃষ্ণায় রব নিজের মুসলমানি করাল, নাম পরিবর্তন করে ইহুদী নাম নিল জেস বেন বেঞ্জামিন। তারপর রওনা হল ইস্পাহানের উদ্দেশ্যে।
তার যাত্রা পথে অনেক ঘটনা। প্রচণ্ড মরুঝড়ে মৃত্যু মুখে পতনের দশা হয়। সব বিপত্তি, প্রতিকূলতা কাটিয়ে এক সময় সে ইস্পাহানে পৌঁছায়। ঘটনা ক্রমে নিজ শরীরের চিকিৎসার জন্য তার জায়গা হয় ইবনে সিনার মাদ্রাসা (কলেজ) ও বিমারিস্তানে (হাসপাতালে)। সে ইবনে সিনার চিকিৎসায় দ্রুত সেরে উঠে। এমন কি তার ঐকান্তিক আগ্রহে ইবনে সিনা তাকে চিকিৎসার প্রাথমিক জ্ঞান, বিজ্ঞানের বিশেষ ধারনা ও দর্শনের শিক্ষা দিতেও রাজী হন। সেখান থেকেই সে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম বারের মত নাড়ি নির্ণয়, দাঁতের চিকিৎসা, শল্য চিকিৎসার নানা পদ্ধতি ও চেতনা নাশক হিসেবে অপিয়ামের ব্যবহারে হাতে-কলমে শিক্ষা প্রাপ্ত হয়।
সেই সময়ের পার্সিয়ান রাজা জনৈক শাহ্ তৎকালীন সেলজুক শাসন কর্তাদের সাথে শান্তি চুক্তিতে রাজী না হওয়ায় সেলজুক রাজা চক্রান্ত করে বুবনিক প্লেগে আক্রান্ত এক ব্যক্তিকে ইস্পাহানে পাঠায় সেই রোগ ছড়িয়ে দিয়ে শাহকে শাস্তি দেওয়ার জন্য।
সারা শহরে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে সমস্ত প্লেগ আক্রান্ত রোগীদের সু-চিকিৎসার মূল কেন্দ্র হয়ে উঠে ইবনে সিনার বিমারিস্তান। রব হয়ে উঠে ইবনে সিনার নির্ভর যোগ্য সহযোগী এক চিকিৎসক।
ইতিপূর্বে ইস্পাহানের যাত্রা পথে রবের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল রেবেকা নামের এক বিবাহিতা মহিলার। রেবেকা প্লেগ আক্রান্ত হয়ে এসে উপস্থিত হয় ইবনে সিনার হাসপাতালে। রব তাকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলে। দুজন এক গভীর মানসিক-শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। রেবেকা গর্ভবতী হয়। তা প্রকাশ পেলে তখনকার আইন অনুযায়ী রব কোল কে পাথর নিক্ষেপে হত্যার কথা আলোচিত হয়। ইতিমধ্যে সেই হাসপাতালে সাইড-সিক্নেস নিয়ে একজন রোগীর মৃত্যু হলে রব গোপনে সে মরদেহের ময়না-তদন্ত করে যা সব ধর্ম মতেই তখন পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। রব এই ময়না তদন্তের মাধ্যমে জানতে পারে যে রোগীর মৃত্যুর কারণ এপেন্ডিক্সের প্রদাহ। ধর্মান্ধ মোল্লা গোষ্ঠীর কাছে এ ঘটনা প্রকাশ পেলে তারা শাহের কাছে ধর্মের অবমাননার জন্য রবের মৃত্যু দণ্ড দাবী করে।
এভাবে ঘটনা নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে একটি পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। যেভাবে এ চলচ্চিত্রের কাহিনী, সংশ্লিষ্ট ঘটনা ও চিত্রনাট্য সাজানো হয়েছে তা এককথায় অবিশ্বাস্য। এই গল্পের প্রতিটি বাঁক দর্শক কে অবলীলায় এক রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতির ভেতর ঠেলে দেয়। দর্শক কে মোহাবিষ্ট করে রাখে।
ইবনে সিনার জন্ম ৯৮০ খৃষ্টাব্দে। ১০৩৭ খৃষ্টাব্দে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে তার মৃত্যু ঘটে। তাকে প্রাথমিক যুগের চিকিৎসা বিজ্ঞানের পিতা বলা হয়। তিনি জ্ঞানের নানা শাখা যথা পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন, জোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা, দর্শন প্রভৃতি নিয়ে কাজ করেছেন। এসব বিষয়ে তার লেখা ৪৫০টি রচনার মধ্যে অন্তত ২৪০টি এখনও বেঁচে আছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর তার লেখা গ্রন্থ (The Book of Healing, The Canon of Medicine) ১৬৫০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য ছিল।
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া Jsfn21@gmail.com
|