‘সোভিয়েত রাশিয়া ভাঙল কেন’ - একটি মূল্যায়ন রিয়াজ হক
প্রথমা প্রকাশন থেকে সদ্য প্রকাশিত “সোভিয়েত রাশিয়া ভাঙল কেন” বইয়ের লেখক সিডনি প্রবাসী বদরুল আলম খান তার অনুসন্ধিৎসু তরুণ জীবনের এক দশকেরও (১৯৭২-১৯৮৩) বেশী সোভিয়েত রাশিয়ায় কাটিয়েছেন। সরকারী বৃত্তি নিয়ে তিনি রাশিয়ায় পড়াশুনা করতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বিস্তর ভ্রমণ করেছেন, গিয়েছেন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। মনোযোগী ও অধ্যবসায়ী ছাত্রের মত শুধু রাশিয়ার তাত্ত্বিক জীবনকেই তিনি পড়েননি, জহুরীর মত বুঝতে চেয়েছেন এই বহুমুখী বিচিত্র সমাজের আত্মার স্পন্দনকে। তাই সাধারণের সঙ্গে মিশেছেন, কথা বলেছেন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বন্ধুর মত তাদেরই একজন হয়ে। ফলে এ সমাজের বিশ্লেষণে, এর উত্থান ও পতনে তার তৃতীয় নয়নের দৃষ্টিকে যৌক্তিক অর্থেই মূল্য না দিয়ে উপায় নেই।
তিনি রুশ জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব থেকে শুরু করে এর শিল্প-সাহিত্য এবং তার মাধ্যমে রুশ সমাজ জীবনের গভীর চিত্রায়ন করেছেন। তার মর্মার্থ, বানী, আদর্শ ও উপযোগিতাকে অত্যন্ত সহনশীলতার সাথে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা নিয়েছেন এবং তার আলোকেই ১৯১৭ এর বলশেভিক বিপ্লবকে দেখতে ও দেখাতে চেয়েছেন। অবশ্যম্ভাবী ভাবে সোভিয়েত রাশিয়া বা ইউ, এস, এস আরের (ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক) মধ্যে লুকিয়ে ছিল তার বিচ্ছিন্নতার প্রবণতাগুলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের এই রাষ্ট্রটির ভেঙ্গে পড়ার ইতিহাস রূপক অর্থে টাইটানিকের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে। পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য বলছি, ১৯২২ সালে এই রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর ১৯৯১ এর ভাঙ্গন-কালে এ রাষ্ট্রের মোট আয়তন ছিল দুই কোটি চব্বিশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। এটা পৃথিবীর মোট ভূখণ্ডের এক ষষ্ঠাংশ। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ তেইশটি দেশের সমন্বয়ে গড়া উত্তর আমেরিকা মহাদেশের সমান। পৃথিবীর পরিধির প্রায় দেড়গুণ অর্থাৎ ষাট হাজার কিলোমিটার ছিল এর সীমান্ত যার দুই তৃতীয়াংশ সমুদ্র পরিবেষ্টিত - উত্তরে আর্কটিক ও পূর্বে প্যাসিফিক মহাসাগর, দক্ষিণে আফগানিস্তান, ইরান, চীন ও মঙ্গোলিয়া, পশ্চিমে ইউরোপ। পনেরটি আলাদা আলাদা অঞ্চল বা দেশ মিলে এর জনসংখ্যা ছিল প্রায় ঊনত্রিশ কোটি। এই বিশাল রাষ্ট্র কাঠামো এগারোটি টাইম জোনে বিভক্ত ছিল। এমন একটি রাষ্ট্র হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ার কারণ অনুসন্ধান যেমন সমাজ-রাজনীতির চিন্তাশীল মননের জন্য অভিপ্রেত, তেমনি সাধারণ পাঠকের জন্য অপার বিস্ময় ও অফুরন্ত কৌতূহলের।
সবচেয়ে বড় কথা - এ গ্রন্থ রচনায় লেখক আর দশজন সমাজতাত্ত্বিকের মত এ রাষ্ট্রের ভাঙ্গনের বিশ্লেষণকে কেবল তাত্ত্বিকতার ভারে ন্যুব্জ হতে দেন নি। জীবনের রস আস্বাদন করতে করতে তিনি তার নিজস্ব ভ্রমণ কাহিনীর ভেতর দিয়ে পাঠককে নিয়ে গেছেন এর সোনালী সম্ভাবনার আদি থেকে অনিমেষ অন্তের দিকে। যার পরিণতিকে লেখক নিজেই তুলনা করেছেন ‘বিনা মেঘে বজ্রপাতের’ সাথে।
প্রায় দুইশ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থকে লেখক সাতটি অধ্যায়ে ভাগ করেছেন। শুরুতে একটি মুখবন্ধ রয়েছে যেখানে তিনি সোভিয়েত রাষ্ট্রের পতনের চুম্বক কারণগুলো উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হচ্ছে নিম্নরূপ - (এক) ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় পুরোটা জুড়ে সাহিত্যে রুশ সমাজ মানসের প্রতিধ্বনি হিসেবে বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের দুটি পরস্পর বিরোধী ধারার অন্তস্রোত প্রবাহিত ছিল যাকে আমলে নিতে বলশেভিকরা ব্যর্থ হয়েছিল। (দুই) হাজার বছরের রুশ সমাজ জীবনের ধারাবাহিকতাকে অবহেলা ও উপেক্ষা করা হয়েছিল। (তিন) সোভিয়েত সাম্রাজ্যের অতি-মাত্রিক প্রসার ঘটেছিল। (চার) মিশ্র জাতি গোষ্ঠীর এক জাতিতে রূপান্তরের অবিশ্বাস্য ও অযৌক্তিক নিপীড়নমূলক প্রচেষ্টা শেষ হয়েছিল বাক-স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের করুণ নির্বাসন দিয়ে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে বিপ্লবের পক্ষে ও বিপক্ষে দুটি প্রণিধানযোগ্য ধারাকে তিনি ‘দস্তয়েভস্কির কথা মনে পড়ে’ শিরোনামে বিশদ আলোচনার মাধ্যমে স্পষ্ট করার প্রয়াস পেয়েছেন। সমাজ পরিবর্তনে বিপ্লবের পক্ষের ধারার সাহিত্য-প্রতিনিধি ছিলেন পুশকিন, লেরমন্তভ, চেরোনোশেভস্কি, ম্যাকসিম গোর্কি প্রমুখরা। লেখকের উল্লেখ মত বিপ্লব-পন্থী প্রধান লেখকদের একজন চেরোনোশেভস্কি ও তার লেখা ‘ইশতো দিয়েলাত’ বা বাংলায় ‘কি করিতে হইবে’ উপন্যাসটি বিপ্লব সমর্থনকারীদের মেনিফেস্টো হিসেবে বিবেচিত ছিল। এতে চেরোনোশেভস্কি নারীমুক্তির কথা ও ভবিষ্যৎ সমতা-ভিত্তিক সমাজের মানচিত্র এঁকেছিলেন।
অন্যদিকে বিপ্লব-বিরোধী ধারার মুখপাত্র হিসেবে ছিলেন রুশ সাহিত্যের মহীরুহ সম নানা দিকপালেরা। দস্তয়েভস্কি ছিলেন এ ধারার প্রধান। বিপ্লব আর জুয়া খেলার মধ্যে তিনি কোন পার্থক্য দেখেন নি আর তাই এভাবে সামাজিক পরিবর্তন ভাবনা দস্তয়েভস্কির কাছে নৈতিকতা বিরোধী মনে হয়েছে। এমন কি তিনি বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ধর্মতত্ত্বের মিল খুঁজে পেয়েছেন। ধর্ম যেমন স্বর্গ প্রাপ্তির স্বপ্ন দেখায় বিপ্লবীরাও তেমনি সুখময় দিনের আশ্বাস দিয়ে থাকে যার সবটুকুই ইউটোপীয় বলে তিনি মনে করতেন। দস্তয়েভস্কি ধারার আরও অনুসারী ছিলেন তলস্তয় ও চেখভ। তলস্তয় যেমন ভাবতেন ‘নিয়ম নয়, আকস্মিকতাই জীবনের চালিকা শক্তি’, তেমনি ছিলেন চেখভ ‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্ত দিয়ে জীবনের গতিপথ তৈরি হয়’ বলে যিনি বিশ্বাস করতেন। অর্থাৎ জীবনের চলার ক্ষেত্রে বিপ্লবের মত বড় মাপের তত্ত্বের উপরি প্রয়োগকে তারা অবাঞ্ছিত ভেবেছেন।
তৃতীয় অধ্যায়টির শিরোনাম ‘শিকড় বিহীন সোভিয়েত সভ্যতা’। রাশিয়ার মূল সমাজ জীবন জারতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, ভূমিপ্রথা ও আধ্যাত্মিকতার সংমিশ্রণে গড়ে উঠা। হাজার বছরের সেই জীবনধারাকে বলশেভিক বিপ্লব সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে পুরনো ও অচল বলে বাতিল করে দেয়। বলশেভিকদের সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনকে কেবলমাত্র বস্তুবাদী ধ্যান-ধারনার আলোকে বিচার করা দেশ ও রাষ্ট্রের জন্য যে কতটা আত্মঘাতী হয়েছিল লেখক তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। এখানে তিনি রুশ ভাষার জন্মের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেছেন, বলেছেন রুশ সভ্যতার সঙ্গে নদীর (যেমন, ভোলগা) সম্মিলনের ইতিহাস, রাজতন্ত্রের ধারাবাহিকতার ইতিহাস আর সেই সাথে রুশ নগর রাষ্ট্রের উদ্ভবের আদি কথা। এসব ক্ষেত্রে রুশ জাতির জীবনে যারা বিশেষ অবদান রেখেছেন তাদের কথা বলতেও তিনি ভুলেননি। এর সবকিছু জুড়ে আছে জীবন-সমাজ-রাষ্ট্রের অবিরত দ্বন্দ্ব, সংঘাত, সংগ্রাম, যুদ্ধের কাহিনী। আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের সহাবস্থানের বিপরীতে বলশেভিক বিপ্লবকে লেখক তাই সঙ্গত কারণেই দেখেছেন এভাবেঃ “রুশ জাতিসত্তা গঠনে একদিকে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ঘটনার সমাবেশ, আরেক দিকে সৃজনীর আধিপত্য ছিল। যুদ্ধ, ষড়যন্ত্র, হত্যা, এদের সঙ্গে ক্ষমতার যূথবদ্ধতা যে ভয়াবহ সখ্য এনে দেয়, তার বিস্তৃতি রুশ জাতির আদি প্রতিষ্ঠাতা ভাইকিং নেতা রুবিক থেকে পিটার দ্য গ্রেট অথবা ক্যাথেরিন পর্যন্ত বিস্তৃত। প্যাগান থেকে রুশ অর্থোডক্স ধর্ম, আবার তারই পাশে দেশপ্রেমের শক্ত ঘাঁটি গড়ে উঠেছে। এভাবে একটু একটু করে রুশ আত্মার ধারনা জাতি পরিচয়ের দেহে যুক্ত হয়েছিল। বলশেভিক বিপ্লব রুশ আত্মাকে বোঝেনি। জীবনের মূল কথা যেখানে সমন্বয়, সেখানে অতীতকে ধুয়েমুছে ফেলা বিপ্লবের বড় দুর্বলতা”। (পৃষ্ঠা-৯৮-৯৯)
চতুর্থ অধ্যায়ে লেখক ‘মধ্য এশিয়া ও বাল্টিকের তিন কন্যা’ শিরোনামে সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশ যথা কাজাকিস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্থানের ধর্ম-ইতিহাস-ঐতিহ্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া সমাজতন্ত্রকে জাতিগত নিপীড়ন হিসেবেই দেখেছেন। লেখকের উদ্ধৃতিতেঃ “১৯২৬ সাল থেকে ভাষা বা ধর্মের বদলে জাতি-পরিচয় দিয়ে এলাকা গঠনের কাজ শুরু হলেও জাতি-ভিত্তিক ভৌগলিক সীমানা নির্ধারণের কৌশল হিসেবে নিপীড়নের পথ বেছে নেওয়া হয়। জন্মস্থান থেকে লাখ লাখ মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়। এই নীতির আওতায় ১২ লাখ কোজাককে কাজাকিস্তান এবং সাইবেরিয়ায় স্থানান্তর করা হয়েছিল। ১৯৩১ থেকে ১৯৩২ সালে স্থানীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করে যৌথ খামার গড়ে তোলার ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে অনেকে গৃহহীন হয়ে পড়ে, ২০ লাখ কাজাকের মৃত্যু হয়। দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধ চলাকালে বালকার, কারচাই ও ক্রিমিয়া অঞ্চলের তাতারদের অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়। সব মিলিয়ে ৩ কোটি মানুষকে বেআইনিভাবে স্থানান্তর করা হয়েছিল”। (পৃষ্ঠা-১০৭-১০৮)
ঠিক এভাবেই সাইবেরিয়ার স্থানীয়দের জাতি পরিচয় ধ্বংস করে রুশিকরণ প্রক্রিয়া সঙ্ঘটিত হয়েছিল। স্তালিনের নেয়া প্রকল্প অনুযায়ী ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ এর মধ্যে এক কোটি মানুষকে নির্বাসনের নামে এখানে নিয়ে আসা হয়।
এস্তোনিয়া, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া নামের তিনটি বাল্টিক রাষ্ট্রও কখনো রুশ বা স্লাভ জাতিভুক্ত রাষ্ট্র ছিল না। ছলে-বলে-কৌশলে এদেরকে সোভিয়েত রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এমনকি অভিন্ন এক জাতিরাষ্ট্র গঠনের নামে এখানেও রুশ জাতিভুক্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। শুধু তাই নয়, স্তালিন প্রায় ৪২ হাজার লাতভিয় নাগরিককে সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠিয়েছিল। ফলে “এদের কাছে সোভিয়েত শাসন এক ধনের ঔপনিবেশিক কতৃত্ববাদ ছাড়া আর কিছুই ছিল না”। (পৃষ্ঠা-১২৩)
পঞ্চম অধ্যায়ে ‘বেসুরো সিম্ফনি’ নামের শিরোনামে লেখক মূলত সোভিয়েত রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক ক্ষমতার হাত বদল ও তাদের অবাস্তবোচিত জন-বিচ্ছিন্ন সিদ্ধান্ত ও আচরণের উল্লেখ করেছেন। সেখানে লেনিন (১৯২২-১৯২৪), স্তালিন (১৯২৪-১৯৫৩), ক্রুসচেভ (১৯৫৩-১৯৬৪), ব্রেজনেভ (১৯৬৪-১৯৮২) পর্যন্ত শাসনের সংক্ষিপ্ত সার বর্ণিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও দুর্নীতি কি ভাবে কমিউনিস্ট পার্টিকে গ্রাস করেছিল, তার রোমহর্ষক বর্ণনা এখানে আছে। স্তালিনের নির্দেশে ভিন্নমতাবলম্বী লাখ লাখ মানুষ শ্রম শিবিরে প্রাণ হারিয়েছে, স্তালিন ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটির ১৩৯ জনের মধ্যে ৯৮ জনকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন। ব্রেজনেভের শাসনামলে শুধু তুলা উৎপাদনে দুর্নীতির ফলে রাষ্ট্রের ৬ বিলিয়ন ডলার নানা পথে পাচার ও আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছিল। এর সাথে ব্রেজনেভের জামাতার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। ব্রেজনেভের ক্ষমতাচ্যুতির পাঁচ বছর পর তার জামাতাকে গ্রেফতার করা হয়। এই একটি মাত্র ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ৫০ হাজার লোককে চাকুরিচ্যুত করা হয়।
ষষ্ঠ ও সপ্তম অধ্যায়ে লেখক সোভিয়েত ভাঙনের সময় কালকে চিত্রিত করেছেন। গরবাচভের (১৯৮৫-১৯৯১) সংস্কার পরিকল্পনার (পেরেস্ত্রইকা ও গ্লাসনস্ত) স্লথ গতির ফলে জনমানুষের অসন্তোষ ও পুঁজিবাদী সমাজের পক্ষে বরিস ইয়েলেতসিনের জনতুষ্টিবাদী আন্দোলন সোভিয়েত শাসন ব্যবস্থার ধ্বংসকে অনিবার্য করে তোলে যার বর্ণনা এখানে স্থান পেয়েছে। মোদ্দা কথা, তৃনমূল থেকে পরিবর্তনের পরিকল্পনা না করে উপর থেকে আরোপিত পরিকল্পনার ফলে একটি পার্টি ও রাষ্ট্র যে আমলাতন্ত্রের গহ্বরে ঢুকে পড়েছিল, তার অদূরদর্শিতা ও নিষ্ঠুরতার ফলেই সোভিয়েত নামের প্রবল সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রটি ভেতর থেকে ক্ষয়ে গিয়েছিল।
গ্রন্থের উপসংহার টেনে লেখক দাবী করেছেন রুশ জাতিসত্তাকে বুঝতে না পারা, একক জাতিসত্তার নামে অন্য জাতি গোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন, গণতন্ত্রহীনতা, বাক স্বাধীনতার বিলোপ, অর্থনীতির ক্ষেত্রে ভারী শিল্পে ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগের ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্প প্রসারিত না হওয়া, কৃষির স্থবিরতা, সমাজ-প্রশাসনে দুর্নীতি, দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি (প্রায় ২ কোটি লোকের মৃত্যু), অস্ত্র প্রতিযোগিতা, সোভিয়েত অর্থ সহায়তায় পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহে কমিউনিজম বহাল রাখা ও সর্বশেষ বিপ্লব-রফতানিতে আফগানিস্তান দখল করে এক দশক ধরে এক অসম যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার ফলশ্রুতিতে এই রাষ্ট্র তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়েছিল। ‘পরিশিষ্ট’তে লেখক সঙ্গতই উল্লেখ করেছেন যে “রুশ বিপ্লবকে ঘিরে যে ট্র্যাজেডি, তাকে আবেগ দিয়ে বুঝতে চেয়েছি”। সে জন্য এর প্রেক্ষাপটে একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক হিসেবে নিজ মাতৃভূমিকে নিয়েও তার সংশয় ও উৎকণ্ঠাকে আড়াল করেন নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘কর্তব্যনীতি’ নামক প্রবন্ধের এক জায়গায় বলেছেন, “এ কথা কল্পনা করিতে সাহস হয় না যে, মানুষের বুদ্ধি ও শক্তি কোনোকালে কালের গতিকে প্রতিহত করিতে পারিবে”। এখন এটা বললে অন্যায় হবে না যে সোভিয়েত রাষ্ট্রের কর্ণধার ও ব্যবস্থাপকরা এ কথা বুঝতে পুরোপুরি অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন।
বদরুল আলম খানের গদ্য মেদহীন, সাবলীল; স্রোতস্বিনীর মত বহমান। শব্দ চয়নে তিনি সহিষ্ণু ও একনিষ্ঠ। বর্ণনায় তার রয়েছে গল্প বলার এক আনন্দময় ঝোঁক। ফলে এটি সুখ-পাঠ্য। বইটির প্রচ্ছদ (মাসুক হেলাল) ও প্রকাশনা (প্রথমা) ত্রুটিহীন, চোখে স্বস্তি নিয়ে আসে। বইটির নাম হতে পারত ‘সোভিয়েত রাশিয়ার পতন’ বা ভাঙ্গন’। তা না হয়ে যে হয়েছে ‘সোভিয়েত রাশিয়া ভাঙল কেন’ তাইই পাঠককে উত্তর খোঁজার মানসে এ বইয়ের দিকে ধাবিত করবে বলে আশা করছি।
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|