রাজ্জাক ভাই ও মুকুল ভাই দু’টি মৃত্যু, দুই প্রেক্ষাপট রিয়াজ হক
রাজ্জাক ভাই বয়সে আমার যথেষ্ট বড় ছিলেন। অন্তত ১৪/১৫ বছর তো হবেই। সেক্ষেত্রে সাধারণ হিসেবেই আমার বড় ভাই। মুকুল বয়সে আমার ৫/৬ বছরের ছোট, কিন্তু তবুও মুকুল ভাই। সিডনীতে পরিচয় ও সম্পর্কের ধারাগুলো এভাবেই আবর্তিত। আমার দু’মামা ও এক খালু এই সিডনীতেই থাকেন। তাদের যারা বন্ধু বা ভাই তারাও আমার ভাই এবং ক্ষেত্র বিশেষে বন্ধুও বটে। আমার কাছে এ খুবই ফ্যাসিনেটিং বা যাকে বলে চিত্তাকর্ষক। এখানে বয়োজ্যেষ্ঠ বা কনিষ্ঠ কোন বড় বিষয় নয়। বিষয় নয় সম্পর্কের ধাপ বা শ্রেণীবিন্যাস। বিষয় হল যোগাযোগ, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও হৃদয় থেকে হৃদয়ে পৌঁছে যাওয়া।
আমি প্রথম সিডনীতে আসি দু’হাজার সালের মাঝামাঝি। মাত্র সাত দিন থেকে চলে যাই। এরপর পাকাপোক্ত ভাবে আসি দু’হাজার তিন সালের ডিসেম্বরে। দ্বিতীয় বারে আসার পর নিজের আত্মীয়ের বাইরে যে মানুষগুলোর সাথে আমার দ্রুত পরিচয় ঘটে তাদের মধ্যে অন্যতম রাজ্জাক ভাই। এটা বোধকরি দু’হাজার চার সালের এপ্রিল মাসে হবে। এখানে একটা কথা বলে নেই যে রাজ্জাক ভাই আমার বড় ভায়রার ( সান্না দুলাভাই) একেবারে ছোট বেলার বন্ধু, যাকে বলে বাল্য বন্ধু। একই জেলায় বগুড়ায় তাদের বাড়ি, একই সঙ্গে তাদের বেড়ে ওঠা। একই স্কুলে তারা পড়াশুনা করেছেন। সান্না দুলাভাই বগুড়ার আজিজুল হক কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে আর রাজ্জাক ভাই চলে যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি সেখান থেকে সাফল্যের সঙ্গে শিক্ষা শেষ করে সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন ও পরে একসময় উচ্চ শিক্ষার্থে আমেরিকা চলে যান। অন্যদিকে সান্না দুলাভাই চাকুরী নিয়ে চলে যান সৌদি আরব। অনিয়মিত হলেও চিঠি পত্রের মাধ্যমে তাদের যোগাযোগ ছিল বরাবর। প্রায় এক যুগের বেশী সৌদিতে চাকুরীর পর ‘৮৬ সালে দুলাভাই ঢাকায় ফিরে এলে তাদের দু’বন্ধুর মধ্যে যোগাযোগ ক্রমান্বয়ে বেড়েছে বৈ কমেনি। অস্ট্রেলিয়া থেকে যখনই রাজ্জাক ভাই বাংলাদেশে গেছেন, তার নিশ্চিত বিরতি ছিল ঢাকায় তার প্রিয় বন্ধুর বাড়িতে।
যা বলছিলাম, দু’হাজার চার সালের সেই এপ্রিল মাসের কোন একদিন রাজ্জাক ভাই আমাদের এপিং এর বাসায় এলেন আমাদের দেখতে ও খবর নিতে; বোধকরি সান্না দু’লাভাই দ্বারা উৎপীড়িত হয়ে। এখনও মনে পড়ে, বললেন, “চল সব তোমরা, (মানে আমি, আমার স্ত্রী ও আমাদের দু’সন্তান) আমার সঙ্গে, তোমাদের নিয়ে এক বাসায় যাব, ওটা হ্যাপি-স্বপ্নার বাসা। ওখানে অনেকেই আসবে। সবার সঙ্গে পরিচয় হবে। তাছাড়া ও বাসায় কাদেরি কিবরিয়া আছে, ওর রবীন্দ্রসঙ্গীতও শুনতে পাবে। আমাদের বৈশাখী মেলার জন্য ও অতিথি হয়ে এসেছে”। আমরা চারজন ওনার গাড়িতে চড়ে বসলাম। সে গাড়ীতে ওনার স্ত্রী রুনু ভাবী সহ আমরা হয়ে গেলাম ছ’জন। উনি বললেন, “কোন সমস্যা নেই”। বুঝলাম, এই হলেন রাজ্জাক ভাই, যিনি নিজের নিয়মে চলতে ভালোবাসেন।
যতদূর মনে পড়ে সেদিন উনি আমাদের কোগরার দিকের কোন এক এলাকায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ঐদিন এক পর্যায়ে পথ ভুল করে হয়ত অন্যদিকে বা সে বাসা ছেড়ে আরো সামনে চলে এসেছিলেন, বুঝতে পেরে বললেন, “গাড়ি ঘোরাতে হবে”। ভাবী বলছিলেন, “তুমি খবরদার এই মেইন রোডে ইউ টার্ন করবে না”। ভাবীর বলা শেষ হতে না হতেই উনি দ্রুত গতিতে গাড়ি ইউ টার্ন করে স্বচ্ছন্দে যাওয়া শুরু করলেন। বুঝলাম, এই হলেন রাজ্জাক ভাই, যিনি স্ত্রীকে কিঞ্চিৎ রাগাতেও পছন্দ করেন।
সান্না দুলাভাই সিডনী বেড়াতে এলে উনি আমাদের বাসায় এসেছেন। উনার সাথে আরো দেখা ও কথা হয়েছে জুলি’র বাসায়। জুলি, সান্না দুলাভাইয়ের বড় মেয়ে, দু’হাজার সালের গোড়া থেকেই সিডনীতে আছে। উনার শ্যালিকা চম্পা ভাবীর বাসায়ও উনাকে দেখেছি। উনার কথা মনে হলেই পান বা জর্দা খাওয়া সেই স্মিত হাসি মুখ চোখে ভেসে উঠে। আমার সবসময় মনে হয়েছে উনি একজন বহির্মুখী চরিত্রের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন দিলখোলা মানুষ। উনার যা বলার তা বলে ফেলতেন, যা করার তা করে ফেলতেন।
উনি সবশেষ অসুস্থ হয়ে যখন হাসপাতালে তখন আমার স্ত্রী বেশ ক’বার বলেছে, “চল, দেখে আসি”। আমাদের আর যাওয়া হয়নি। যখন সময় হল, উনি তখন পরপাড়ে। তাই ভেতরের গ্লানি দূর করতে সব বাদ দিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম লাকেম্বা মসজিদে ওনার জানাজায়, অন্তত শেষ বিদায়ের ক্ষণে ছিলাম, মনকে এ প্রবোধ দিতে।
রাজ্জাক ভাই অসুস্থ ছিলেন। অসুস্থ ছিলেন এমন এক মরণ ব্যাধি ক্যান্সারে যে তার জীবন হয়ে পড়েছিল সংশায়চ্ছন্ন। তবুও যেহেতু মানুষ বাঁচে আশা নিয়ে, তাই ওনার প্রিয়জন সহ প্রত্যেকের প্রার্থনা ছিল উনি যেন সমস্ত প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে সেরে উঠেন। বাস্তবে সেটা হয়নি। কিন্তু মুকুল?
মুকুলের বয়স ছিল মধ্য পঞ্চাশের কোঠায়। আমার জানামতে ওর নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ছিল। এর বাইরে তেমন কোন মারাত্মক অসুখ ছিল না যে মুকুল কে চলে যেতে হবে এখনই। মুকুলের মৃত্যুর খবর শুনে আমি যার পর নাই ব্যথিত হয়েছি ও কষ্ট পেয়েছি। আমি যাকে বলে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম।
বিস্তারিত জানতে আমি শাহাদত কে ফোন করি। টুঙ্গাবি তে এই শাহাদতের বাসায়ই মুকুলের সঙ্গে আমার পরিচয়। ওদের এ আই টি (এশিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলোজি) তে পড়াশুনা করা বন্ধুবর্গের এক বেশ বড়সড় দল আছে। শাহাদতের বাসায় গেলেই ওদের সবার সঙ্গে দেখা হত।
মুকুল আর শাহাদত একসঙ্গে নটেরডেম, বুয়েট, এ আই টি হয়ে এই সিডনীতে এসে পৌছায়। মুকুলই শাহাদতকে খবর দিয়ে এ আই টি তে ওর স্কলারশিপ পাওয়ার কথা জানায়। ব্যাংককের এয়ারপোর্ট থেকে শাহাদতকে রিসিভ করে এই মুকুলই। শুধু তাই নয়, মুকুল অস্ট্রেলিয়াতে আসার ছ’মাস পর সিডনী এয়ারপোর্টে আবার যায় শাহাদতকে স্বাগত জানাতে। শাহাদতের সঙ্গে মুকুলের বন্ধুত্ব প্রায় চল্লিশ বছরের। এসবই আমার শাহাদতের মুখ থেকে শোনা।
বয়সে আমার আমার ছোট হলেও সেই যে এখানে এসে দেখা ও পরিচয়ের পর দুজনকেই ভাই বলে ডাকতে শুরু করেছিলাম, তাইই বহাল আছে।
মুকুল কতটা ভাল মানুষ ছিল এখন সে গল্পটাই বলি। বছর দশেক আগের কথা হবে। আমি একটা ভাল চাকুরী খুঁজছিলাম। শাহাদত বলল, মুকুল বলছিল সিডনি ওয়াটেরে কিছু ইঞ্জিনিয়ার নিবে। আপনি ট্রাই করে দেখতে পারেন। বলে মুকুলের সঙ্গে আমাকে ট্যাগ করে দিল। বলা বাহুল্য মুকুল তখন সিডনি ওয়াটারে কাজ করে। মুকুল আমাকে কোন রিক্রুটিং এজেন্টের সাথে কথা বলতে হবে, কি ভাবে সি ভি তৈরি করতে হবে বলে দিলেন। এমন কি ওর নিজের ও স্ত্রীর (যিনি নিজেও সিডনি ওয়াটারের একজন প্রকৌশলী) সি ভি আমাকে ইমেইল করে পাঠিয়ে দিলেন। মুকুল ও শাহাদত মিলে অনেকটা শিক্ষকের মতই আমাকে ঐ পদের জন্য সম্ভাব্য প্রশ্নের ধরন ও উত্তর নিয়ে রীতিমত কোচিং করাতে লেগে গেলেন। কখনো ফোনে কখনো বা শাহাদতের বাসায় মুখোমুখি। যা হোক তাদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় আমি ইন্টারভিউ এর জন্য শর্ট লিস্টেড হয়ে গেলাম। ইন্টারভিউ এ কি ধরনের পোশাক পড়ে যেতে হবে তাও আমাকে ফোনে বলে দিলেন মুকুল।
মনে আছে, ইন্টারভিউ এ যথারীতি প্রশ্নের উত্তর দিলেও আমি ছিলাম প্রচণ্ড নার্ভাস। আমি নিজেই বুঝতে পারছিলাম যে আমার গলা-তালু শুকিয়ে কথা বের হচ্ছে অত্যন্ত ক্ষীণ স্বরে। হাত-পা ঘামছে।
ইন্টারভিউ এর পরদিন মুকুল ফোন করে আমাকে বললেন, “চিন্তা করবেন না। আমি খবর নিয়েছি। ওরা বলেছে আপনার ইন্টারভিউ ভাল হয়েছে”।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে চাকুরীটা আমার হয়নি। আমি জানি এর কারণ আমার ঐ নার্ভাসনেস। আজীবন লিখিত পরীক্ষায় মোটামুটি ভাবে উতরে গেলেও ইন্টারভিউ এ এসেই কেন জানি না কোন এক অজানা কারণে বরাবর আমার হৃদকম্পন শুরু হয়। যাক। এরপর বহুদিন মুকুলের সঙ্গে আর আমার দেখা হয় নাই।
দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে, শাহাদতের বাবার মৃত্যুর পর তার জন্য দোয়া ও স্মৃতিচারণের অনুষ্ঠানে টুঙ্গাবীর এক পাবলিক স্কুল মিলনায়তনে আবার মুকুলের সঙ্গে দেখা। সে অনুষ্ঠান শুরুর আগে শাহাদত আমাকে বললেন, “আপনি আব্বা সম্পর্কে কিছু বলবেন ?” বলা বাহুল্য শাহাদতের সঙ্গে আমার এক আত্মীয়তার সম্পর্ক। ওর একমাত্র খালা আমার ছোট মামী। যদিও আমি ওর আব্বাকে দেখেছি অত্যন্ত তরুণ বয়সে, কিছু কথাবার্তাও হয়েছে যা স্মৃতিতে ধুসর তবুও বললাম, “হ্যাঁ, বলব”।
ওখানে বাংলাদেশী ছাড়াও অন্য ভাষাভাষীর লোক ছিলেন। সবাই ইংরেজিতেই বক্তব্য রাখছিলেন। আমি হিসেব করে দেখলাম, নব্বুই শতাংশের বেশী যেখানে বাংলাদেশী আর ইংরেজিতেও আমি অতটা স্বতঃস্ফূর্ত না তখন পুরোপুরি বাংলাতে বলাই সমীচীন। কথা শেষ হল। সবার মত খাবার নেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। সেই সময় কেউ একজন কানের কাছে এসে বললেন, “খাঁটি বাংলায় খুবই ভাল বলেছেন”। তাকিয়ে দেখি, মুকুল।
মনে হয় এইতো সেদিনের কথা। মুকুল, এ আপনি কি করলেন! কোন রকম সতর্কবাণী ছাড়া এত তাড়াতাড়ি, এত অল্প বয়সে মানুষ চলে যায় বা চলে যেতে পারে ভেবে ভীষণ যন্ত্রণা ও রাগ হচ্ছে। এর নামই কি জীবন!
‘হায়! এই কি জীবন’!
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া, Jsfn21@gmail.com
|