অভিমানী অনিক রিয়াজ হক
(গত ২৯শে সেপ্টেম্বর সিডনি’র দক্ষিণে ক্লিফটনের ক্লিফ ব্রিজের পাশের উঁচু জায়গা থেকে পড়ে মৃত্যু ঘটে অসম্ভব প্রতিভাবান এক বাংলাদেশী তরুণের। নাম মুনাওয়ার সরকার (অনিক)। মুনাওয়ার কেবলমাত্র মেধাবী ছাত্র ও প্রকৌশলীই ছিল না। সে ছিল প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর বিকশিত এক হৃদয়। তার পরিচয় পাওয়া যায় তার অল্প সময়ের জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত, কাজ ও অপ্রকাশিত কিছু লেখায়। এখানে খুবই অল্প পরিসরে তাকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে)
 মায়ের সঙ্গে অনিক | গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী সিসিফাস ছিলেন করিন্থের রাজা। স্বাধীনচেতা। জ্ঞানী। বিধাতা তাকে তার অবাধ্যতার জন্য এক ভয়ানক শাস্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। শাস্তিটা ছিল এরকম যে অনন্তকাল ধরে, পৃথিবীর বিনাশ হওয়া অব্দি প্রকাণ্ড একটি পাথরের বল তিনি ঠেলে খাঁড়া পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যাবেন। কিন্তু বিধাতার ইচ্ছায় সে বল পাহাড়ের চূড়ার কাছাকাছি পর্যন্ত যেয়ে আবার গড়িয়ে চলে আসবে পাহাড়ের পাদদেশে। আবারও তিনি তা ঠেলে পাহাড়ের চূড়ায় তুলবেন। এবং এভাবেই তা চলতে থাকবে। চলতে থাকবে অন্তহীন। নিরন্তর। এই সিসিফাস কে নিয়েই ফরাসী লেখক দার্শনিক আলবেয়ার ক্যামু’র (Albert Camus) বিখ্যাত দার্শনিক রচনা ‘The myth of Sisyphus’. ক্যামু তার যুগকে অতিক্রমকারী এক আলোচিত লেখক। জ্যা পল সাত্রের অস্তিত্ববাদী দর্শনের একজন নিঃস্পৃহ অনুসারী হয়েও জীবনের অবারিত অনিশ্চয়তা ও অমোঘ মৃত্যুকে লেখার ভেতর দিয়ে তিনি ক্রমাগত প্রশ্ন করে গেছেন। সুখ-দুঃখ, আলো-অন্ধকার তথা জীবন-মৃত্যুর খেলাকে তিনি অসঙ্গত, অযৌক্তিক, অনন্য ও অভূতপূর্ব হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এমনকি কারো কারো জন্য বেঁচে থাকাকে তিনি ক্রমাগত দার্শনিক মৃত্যুর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ বলেও ভেবেছেন। এই আলবেয়ার ক্যামু’র একনিষ্ঠ মনোযোগী পাঠক ছিল চব্বিশ বছরের অনিক।
এসময় অনিকের লেখা একটি ছোট গল্পের মাঝ থেকে উদ্ধৃত করছি কয়েক লাইনঃ
“And as I look into her eyes again in the morning, there's the sudden realization that I'm not quite as available as I was the night before, and she sees it, in my eyes, darkened and blood-shot amidst the hangover and cheap whiskey, then she's gone, and I'm haunted by yet another road not taken. So I start off again, a new path, a new journey into the unfamiliar territory of the world, never looking back. Why would I? There's darkness both ends, and I have no idea where I'm going. The signs are lost, and the path is dangerous, but I expose myself, shouting "GIVE IT YOUR BEST SHOT!" in the loudest silence my endearing heart can bear to shout”.
বাবার জীবনের ছায়ায়ই যেন বেড়ে উঠছিল এই সপ্রতিভ সম্ভাবনাময় অনিকের কৈশোর ও তারুণ্য। বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। সমাজ রাজনীতির দর্শন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে যিনি পড়েন। পড়ান। চিন্তা করেন। কথা বলেন। লিখেন।
১৯৮৭ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন বিভাগে শিক্ষকতার পর আবার ১৯৯৮ সালের জানুয়ারিতে অনিকের বাবা ফিজির ইউনিভার্সিটি অব সাউথ প্যাসেফিকে পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন ও ম্যানেজমেন্ট বিভাগে সেই একই শিক্ষকতার চাকুরী নিয়ে পুরো পরিবার সহ মেলবোর্ন ছাড়লে ওখানেই শুরু হর অনিকের শিক্ষা জীবনের। ২০০০ সালে ফিজির তৎকালীন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় বংশোদ্ভূত মাহেন্দ্র চৌধুরীকে উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তির চাপে সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা পরিত্যাগ করতে হয়। এ নিয়ে এক সাঙ্ঘর্সিক টালমাটাল পরিস্থিতিতে অনিকের বাবা আবু ইলিয়াস সরকার ফিজি ছেঁড়ে ইউনিভার্সিটি অব সারজা’র ব্যবস্থাপনা বিভাগে ফ্যাকাল্টি মেম্বার হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে পূর্ণ প্রফেসরের মর্যাদায় প্রায় আঠার বছর ধরে তিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন।
সারজায় অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ইয়ার টু তে শিশু অনিকের স্কুল জীবন নতুন করে শুরু হয়। স্কুলে পড়া, আঁকা, লেখায় ও ক্রীড়ায় অনিক ছিল প্রবলভাবে উৎসাহী ও উদ্যমী এক শিশু। উন্মুখ এক কিশোর। বাবা যেমন সক্রেটিস, এরিস্টটল, রুশো, জন লক, রাসেল, সার্ত্ত, ফুকোর লেখা পড়ে জীবনকে পরিশীলিত করেছেন তেমনি চেয়েছিলেন দু’ছেলের জীবনও গড়ে উঠে সে আবহে। স্কুলে থাকতেই অনিক ছোটদের চার্লস ডিকেন্স, সেকশপীয়ার, ওস্কার ওয়াইল্ড, টি এইচ লরেন্স সহ অনেকের রচনা পড়ে আত্মস্থ করে ফেলে। সারজাহ বা সিডনিতে দু’হাতে টাকা খরচ করে বই আর বই কিনে দিতে কোনদিনও কার্পণ্য করেননি শিক্ষানুরাগী বাবা।
ভিক্টোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল স্কুল সারজায় অষ্টম শ্রেণীর পড়া শেষ করে ২০০৯ সালে সারজাহ থেকে সিডনিতে চলে আসে অনিকরা দু’ভাই সহ মা। বাবা থেকে যান সারজাতেই। মায়ের আদর, অনুশাসন ও একনিষ্ঠ অভিভাবকত্বে ছেলেরা বড় হয়ে উঠতে থাকে সিডনিতেই। বাবা সেখানে কেবলমাত্র ছুটিতে আসা-যাওয়ার মধ্যের এক প্রিয় আগন্তুক। তরুণ অনিক বুঝে যায় পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে কিছুটা হলেও বাবার ভূমিকা নিয়ে সংসারকে আগলে রাখার দায়িত্ব তারও। গার্হস্থ জীবনের নিত্য প্রয়োজনে নিজেকে প্রস্তুত রাখা, মাকে নানা কাজে সাহায্য করা, ছোট ভাইয়ের পড়াশুনার দেখভাল করা, সামাজিকতা রক্ষা সহ সবকিছুতেই সে নিজেকে দেখতে পায় তার বাবার ভূমিকায়।
সিডনিতে এসে অনিক দু’বছর পড়াশুনা করে হোমবুশ বয়েস এ। সেখান থেকে চলে আসে সিডনি টেক এ। সিডনি টেক থেকে এইচ এস সি’র পর সারজায় বেড়াতে গেলে তার বাবা তাকে নিয়ে যায় সারাজায় তৈরি প্রায় ২৭২০ ফুটের সর্বোচ্চ টাওয়ার বার্জ খলিফায়। এর স্থাপত্য, গঠন কাঠামো ও নির্মাণশৈলী তরুণ অনিক কে এতোটাই মুগ্ধ করে যে সে মনে মনে স্থির প্রতিজ্ঞ হয় যে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ও আর্কিটেকচার নিয়েই সে তার ভবিষ্যৎ জীবন গড়ে তুলবে। যদিও তার মা চাচ্ছিলেন অনিক মেডিসিন নিয়ে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শুরু করুক। মাকে প্রায় না জানিয়ে, মায়ের প্রত্যাশাকে সকৌতুকে এড়িয়ে অনিক ভর্তি হয়ে যার তারই পছন্দের বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস এ।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন তার জন্য খুলে দেয় জীবনকে নানা রঙ-রস-রূপে পাঠ করার অনির্বচনীয় অধ্যায়। এসময় অনিকের লেখা একটি সনেট এর শেষ চার লাইনঃ
“When saying love did not strike up maladies, Only a future we were creating. When all is said, you compel me to the truth – That our love is timeless, not just for youth”.
স্বপ্ন ও বাস্তবের বিপরীতমুখী অবস্থানকে সম্পূর্ণ নতুন বাস্তবতার ভেতরে নির্মাণে সচেষ্ট নিয়তিবাদী জাপানিজ লেখক হারুকি মুরাকামি একসময় তার মানস-সঙ্গী হয়ে উঠে। তাকে শেখায় জীবনকে নতুন করে বিশ্লেষণ ও বিন্যাস করতে। যেমন পাশাপাশি শেখাচ্ছে আলবেয়ার ক্যামু’র ‘The Stranger’। যে গল্পের নায়ক সমাজের সবার মধ্যে থেকেও চিন্তা ও ধারনায় সবার থেকে আলাদা। এমনকি অনিকের জীবনের চারপাশে দেখা প্রতিটি মানুষের জীবনের বেঁচে থাকার সংগ্রামেরই করুন সমার্থক হয়ে যায় ক্যামু’র অবিস্মরণীয় রচনা ‘The myth of Sisyphus’ । জার্মান বংশোদ্ভূত আমেরিকান কবি ঔপন্যাসিক Charles Bukowski ও অনিক কে টানে প্রবলভাবে। কাজ-সঙ্গ-মদের ঘূর্ণাবর্তে সমাজের দরিদ্র মানুষগুলোর বিপন্ন জীবনের ছবি অনিকের বোধকে চমকে দেয়। সন্দেহ, বিশ্বাসহীনতা, স্বার্থ উদ্ধারের প্রবণতা কিভাবে জীবনকে ছন্নছাড়া ও বিপর্যস্ত করে তুলছে দেখে বিচলিত হয় অনিক। ‘হায়! এই কি জীবন’! এ সময়ে অনিকের লেখা দীর্ঘ আট পাতার একটি গল্পের অংশ বিশেষঃ
“I feel ill, I'm compelled to move astray from my path of remembrance and discovery and simply sleep it off. My edges withering, my extremities falling out of psyche, as though someone had switched off the circuits upstairs to my body. Like the autumn leaves, they turn colour, from health to death, and withering the in wind, each leaves, one distinctive life broken and dying undone from the branch from whence it was born, and slowly, but swiftly, falls in the passing air to the ground, trampled on by the monotonous movement of daily life circling the world in dull, adulterated, routine. Truly, their lives must be so horrible, would it not”?
২০১৭ তে গ্রাজুয়েশন শেষ করে এ জি এল এর গবেষণা ও উন্নয়ন শাখায় চাকুরী নিয়ে নেয় অনিক। কিন্তু তার মাথায় তখনও ঘুরপাক খাচ্ছে জীবনকে গড়ে তোলার অন্য ছন্দ। অন্য সুর। সেই যে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে ‘আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব সারজা’য় চার মাসের একটি রিসার্চ প্রোজেক্ট এ কাজ করার সময় থেকে গবেষণা ও শিক্ষকতার বিষয়টি তাকে মোহন বাঁশীর মত ক্রমাগত টানছে। ঠিক সে লক্ষেই ২০১৭ এর মে’র দিকে পূর্ণ বৃত্তি প্রাপ্ত হয়ে সে সিডনি ইউনিভার্সিটিতে পি এইচ ডি কোর্সে এডমিশন নিয়ে নেয়। কোর্সের অংশ হিসেবে Integrated Engineering ও Structural Dynamics নামের দু’টি বিষয়ে ক্লাসে পড়ানোও শুরু করে। খুশী হয়ে বাবাকে লিখে জানায় ‘I am enjoying my teaching in Sydney Uni’ । এই সময়ে লেবানীজ আমেরিকান গবেষক লেখক Nicholas Taleb তার মনোযোগ কেড়ে নেয়। তালেবের লেখায় অপার্থিব ভালোবাসার অবিনশ্বরতা, একাকীত্বের স্বাদ বিস্বাদ ও সেই সাথে বিদ্রূপাত্মক রাজনীতির মিশ্রণ তাকে আলোড়িত করে তোলে। অনিক ‘Stand by Humanity’ গ্রুপে যোগদান করে। নিয়মিত রেডক্রসে রক্তদান শুরু করে; এমন কি কখনও কখনও মায়ের যৌক্তিক আপত্তি অগ্রাহ্য করেও।
যেমনটি বাবা চেয়েছিলেন, মানবিক মূল্যবোধের ভিতকে শক্ত করে জীবন গঠন, সব শুভ ও সুন্দর কে জীবনের অংশ করে নেওয়া অনিক যেন তার প্রতিটি কাজ ও পদক্ষেপে তারই মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠছিল। চব্বিশ বছরের একটি জীবন যেন তার বয়সের তুলনায় অনেক পরিণত, অনেক পূর্ণ। সে যেন আমার প্রিয় শিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ভাষায় ‘প্রজাপতির জীবন’! প্রজাপতির মতই রঙের উজ্জ্বলতা, মাধুর্য আর বিস্ময় নিয়ে সে যেন দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। না হলে কেন অসম্ভব সম্ভাবনাময়, বিপুল বিকশিত হওয়ার অপেক্ষায় অধীর একটি জীবন এমন অকালে বিদায় নেবে পৃথিবী থেকে। এর ব্যাখ্যা কি! একি আলবেয়ার ক্যামু’র সেই অসঙ্গত, অযৌক্তিক, অনন্য জীবনেরই কোন করুন দৃশ্যপট! একি পৃথিবীর প্রতি অভিমান! অনিকের বাবা যখন অশ্রু সজল চোখে বলেন, “ছেলেটি আমার বড় অভিমানী ছিল”! তখন কি তাই বিশ্বাস করেই আমরা মেনে নেব তার অপ্রার্থিত অযাচিত এই মৃত্যুকে!
(কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ আনিকের বাবা, বন্ধু ও ভাল একজন মানুষ আবু ইলিয়াস সরকার)
 রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|