bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












‘নীরবতার শব্দ’ কাব্যগ্রন্থের একটি পর্যালোচনা
রিয়াজ হক



“যে কাঠ জ্বলে নাই তাহাকে আগুন নাম দেওয়াও যেমন, যে মানুষ আকাশের দিকে তাকাইয়া আকাশেরই মতো নীরব হইয়া থাকে তাহাকেও কবি বলা সেইরূপ। প্রকাশই কবিত্ব, মনের তলার মধ্যে কী আছে বা না আছে তাহা আলোচনা করিয়া বাহিরের লোকের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। কথায় বলে ‘মিষ্টান্নমিতরে জনাঃ’; ভাণ্ডারে কী জমা আছে তাহা আন্দাজে হিসাব করিয়া বাহিরের লোকের কোনো সুখ নাই, তাহাদের পক্ষে মিষ্টান্নটা হাতে হাতে পাওয়া আবশ্যক”।
(সাহিত্যের সামগ্রী-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।

সাধারণ বিচারে রবীন্দ্রনাথের উপরের বাক্যগুলোকে যুক্তিপূর্ণ ধরে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে আলোচ্য গ্রন্থ ‘নীরবতার শব্দ’এর রচয়িতা সূর্য কিংকর মজুমদার একজন কবি। কারণ আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি শুধু সরবই নন, এর ভেতরের নীরবতার শব্দও তিনি শুনতে পান যা একজন কবির পক্ষেই কেবল সম্ভব।

আপনি যদি ঘাসের ওপর মুক্তোবিন্দুর মত পড়ে থাকা শিশিরের শব্দ শুনতে পান, শীতের হাওয়ায় ভাসতে থাকা পাতা ঝরার গান শুনতে পান বা কোন মৌন ঋষির ধ্যানের বানী শুনতে পান তাহলে বুঝতে হবে কবিতা আপনাকে ভর করেছে, নিশির ডাকের মত তা আপনাকে কবিতা রাজ্যের ভুবনে নিমজ্জিত করতে চাইছে। এ হলো কবিতা শুরুর প্রাথমিক ধাপ। যেটা কবি সূর্য কিংকর মজুমদার খুব ভালো ভাবেই উৎরে গেছেন। অন্তত তার গ্রন্থের সর্বমোট ছাপ্পান্নটি কবিতা পড়লে তা টের পাওয়া যায়।

আমার ধারনা, আর্ট (শিল্প) ফর্মের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হল কবিতা। কেন? কারণ কবিতা কেবল ভাব বা বিষয়ের উপর টিকে থাকে না; হয়না হৃদয়গ্রাহী। কবিতা লিখতে ছন্দের জ্ঞান থাকতে হয় (স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, এবং অক্ষরবৃত্ত), ছবির পর ছবি আঁকতে হয় যাকে আমরা ‘চিত্রকল্প’ বলে থাকি। একে অনেক সাহিত্য বোদ্ধারা চিত্রকলার (পেইন্টিংস)সাথে তুলনা করেছেন। বলেছেন, ‘চিত্রকলা হল নীরব কবিতা আর কবিতা হল এমন চিত্রকলা যা কথা বলে’। এর সাথে কবিতায় থাকতে হয় ইমাজিনেশন যা বর্তমানকে নতুন রূপে হাজির করে আর ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। সেজন্যই প্রাচীন রোমে কবিদের ভ্যাটিস/ভাটেস(vates) বলা হতো। প্রাচীন ল্যাটিন এই ভ্যাটিস শব্দের অর্থ হল ‘নবী’ (“Vates” is a Latin word meaning prophet, seer, or poet.) আর এ কারণেই জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি”।

এসব কথা মাথায় রেখেই আমরা কবিতার আলোচনায় মনোনিবেশ করতে চাই। আমি ছন্দের ব্যাকরণে ঢুকব না। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঠকেরই তা ধরতে ও বুঝতে কষ্ট হবে। আমি বিষয়, চিত্রকল্প ও কল্পনা নিয়ে কথা বলব যা কবিতার প্রাণ।

আসুন কাব্য গ্রন্থের প্রথম কবিতাটা বিবেচনা করি। ‘মা’কে নিয়ে লেখা এ কবিতাটির নাম ‘এক অক্ষরের ছোট্ট শব্দ’। বাঙালি জীবনে ‘মা’ আমাদের এক আবেগের জায়গা। কবি এখানে মাকে ঈশ্বরের সাথে তুলনা করেছেন, তুলনা করেছেন আমাদের চারপাশের প্রকৃতির ঐশ্বর্যের সাথে। নানা বিশেষণে তিনি তাকে অভিষিক্ত করেছেন। দশ স্তবকের চল্লিশ লাইনের এই কবিতায় আমাকে অভিভূত করেছে দু’টি লাইনঃ
“তুমি স্বার্থপর পৃথিবীর নিঃস্বার্থ ভালোবাসার নোনা অশ্রুজল” ও
“মা, তুমি হালখাতাহীন জীবনের স্বল্প পুঁজির অবিশ্বাস্য স্বপ্নচারিণী”।

এই কবিতায় মায়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতার যে পরিচয় আমরা পাই তা এর গদ্য বর্ণনায় অভূতপূর্ব কিন্তু কাব্যের অভিব্যক্তিতে তা উত্তীর্ণ নয়। আপনি এ পুরো কবিতাটিকে কবিতার ফর্ম থেকে সরিয়ে গদ্যের ফর্মে নিয়ে আসুন। দেখবেন তা মাকে নিয়ে কবিতার পরিবর্তে এক শক্তিশালী প্রবন্ধ হয়ে গেছে। উদাহরণ হিসেবে শেষের চার লাইনকেই ধরুন;
“তোমাকে খুঁজি মনের অলিন্দ থেকে নিলয়ে অসংখ্য স্মৃতির মোহনায়, পুরনো চিঠির বাক্সে, অপার্থিব স্মৃতিবন্দী এ্যালবামের পাতায়। ইচ্ছে করে তোমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলি ভালোবাসি। কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করার ইচ্ছার তৃষ্ণায় মন কাঁদে নিঃসঙ্গ আঙ্গিনায়”।

বঙ্কিমের উপন্যাস ও রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প যারা ভালো করে পড়েছেন তারা জানবেন যে তাদের গদ্য হল কাব্য সুষমায় ভরপুর। রবীন্দ্রনাথের ‘কঙ্কাল’ গল্প থেকে একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে। নায়িকার রূপ বর্ণনায় তিনি বলছেন,
“আমি যখন চলিতাম তখন আপনি বুঝিতে পারিতাম যে একখণ্ড হীরা নড়াইলে তাহার চারি দিক হইতে যেমন আলো ঝকমক করিয়া উঠে, আমার দেহের প্রত্যেক গতিতে তেমনি সৌন্দর্যের ভঙ্গি নানা স্বাভাবিক হিল্লোলে চারিদিকে ভাঙিয়া পড়িত। আমি মাঝে মাঝে অনেকক্ষণ ধরিয়া নিজের হাত দুখানি নিজে দেখিতাম-- পৃথিবীর সমস্ত উদ্ধত পৌরুষের মুখে রাশ লাগাইয়া মধুরভাবে বাগাইয়া ধরিতে পারে এমন দুইখানি হাত”।

সূর্য কিংকরের কবিতায় যার অভাব তা হল ছবি বা চিত্রকল্পের। পাঠকের হৃদয়ে আসীন যে কোন বিখ্যাত কবিতায় আপনি ছবির পর ছবি পাবেন। সে ছবি গতি-মুখর। পাঠককে হাত ধরে সামনে নিয়ে চলে। সে রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’, কাজী নজরুলের ‘বিদ্রোহী’, জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’, শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’ বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার কথাই ধরুন। সূর্য কিংকরের কবিতায় যে ছবি আমরা দেখতে পাই তা স্থির চিত্রের মতই স্থবির, গতি-মুখর বা চলমান নয়। এখানেই তাকে কাজ করতে হবে। এসব ছবিকে গতি বা বেগ দিতে হবে; দিতে হবে সারল্য ও মুগ্ধতার সেই শক্তি যা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে পাঠকের হৃদয়কে।

কবিতায় সারল্য এক বড় জিনিষ। সংস্কৃত বা তৎসম শব্দের বিপুল ব্যবহার কবিতার শরীরকে ভারী করে তুলতে পারে। কবিতাকে আপনি মানবীয় সৌন্দর্যের সাথে তুলনা করতে পারেন। যত মেদহীন তত সুন্দর। বিশেষণে বিশেষণে কবিতা ভারাক্রান্ত হলে কখনো কখনো দুর্বোধ্য হয়ে যেতে পারে। সূর্যের কবিতায় যা অনেক ক্ষেত্রেই ঘটেছে। যেমন তার ‘নির্জন বিলবোর্ডে ন্যুব্জ নিবেদন’ কবিতার শেষ চার লাইনঃ
“অবিশ্রান্ত সময়ের অহর্নিশ অন্তর্দহনের ব্যাপক ক্ষয়চিহ্ন মুছে
মন্দগামী ঘড়ির কাঁটা অকালে খুইয়েছে যৌবনের নৈসর্গিক তরুবন
দগ্ধীভূত জ্যোৎস্নায় আমার অমল প্রেমের কবিতার পাণ্ডুলিপি
রাজপথের নির্জন চৌরাস্তায় বিলবোর্ডে একে দিবে ন্যুব্জ নিবেদন”।

এখানে বিষয়, ভাব বা অনুভূতি শব্দ ও বিশেষণের বাহুল্যে ভারাক্রান্ত হয়ে তার মূল বানী (একাকীত্ব ও অসহায়ত্ব) হারিয়ে ফেলেছে। আক্রান্ত হয়েছে দুর্বোধ্যতায়। পাঠকের মগজে তা চাপ সৃষ্টি করে কবিতা থেকে তাকে দূরে নিয়ে যায়। মনে রাখতে হবে যে শেষ বিচারে কবিতাকে পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে হবে। এটা কেবল কবির মেধার ও জ্ঞানের অপরিমিত প্রকাশ নয়, এটা পাঠকের সাথে তার নিবিড় বন্ধন; আত্মীয়তা ও সংযোগের বিষয়। তাই তাকে নিপুণ, পরিমিত ও সহজবোধ্য হতে হবে। বড় বড় সব কবিতাতেই আপনি তা পাবেন।

এ গ্রন্থের যে কবিতাটি আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে তা হল ‘প্রত্যয়ের কারুকার্যে এক টুকরো হাসি’। কবিতাটি ছোট, বর্ণনায় সরল, ভাবে অনন্য। তার মাঝের চার লাইন বললেই সবাই তা উপলব্ধি করতে পারবেন।
“শুধু একটি অতি পরিচিত মুখ
যে মুখে প্রত্যয়ের কারুকার্যে লেগে থাকা
শান্ত এক টুকরো হাসি বৃষ্টি ভেজা বাতাসের মতো
আলতো করে ছুঁয়ে যেত মনের জানালা-
সেই মুখ, সেই হাসি আজ আর নেই”।

‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’ কবিতার অংশে অংশে দারুণ ভাবে বাঙময় হয়ে উঠে কবিতা। যেমনঃ
“বন্ধ্যা অনুভূতির শিরদাঁড়ায় সংঘবদ্ধ বিষাদের যত মুমূর্ষু মেঘ
সকালের বারান্দায় রেখে যায় নজরকাড়া
প্রতারণার বিজ্ঞাপন” বা

“স্বপ্নের মাকড়সা মনের শরীর বেয়ে
ক্রমশ চিন্তার জাল বুনে চলে” বা

“জীবনের অ্যালবাম ঝিনুকের মতো
অকস্মাৎ খুলে দেয়
ফেলে আসা সময়ের পরিত্যক্ত দুর্গের মার্জিত স্মৃতির দুয়ার”।

সারাদিনের গোমট মেঘলা আকাশের মাঝে উঁকি দেওয়া সূর্যের আলোর মতন অনেক উজ্জ্বল লাইন আছে সূর্যের নানা কবিতায়। যেমনঃ

‘রাতের শেষ ট্রেনের মতো ধোয়াটে কুয়াশায়’ (সময় চিহ্ন)

‘নীরব ফাল্গুনের একঝাক সোনালি রোদের দুরন্ত মিছিলে’ (জীবন নদীর খেয়াপার)

‘আমার বরফ অনুভূতি কবেই অসমাপ্ত কথার ফসিল হয়ে গেছে’ (নীল প্রচ্ছদে অসমাপ্ত উপন্যাস)

‘সময়ের জানালায় এখন/শ্রাবণের বিলাসী বৃষ্টির অবিচ্ছিন্ন আশীর্বাদ’ (নীল প্রচ্ছদে অসমাপ্ত উপন্যাস)

‘বিস্মৃতির উপকুলে মৌন জলরেখা রেখে গেছে স্মৃতির বিষণ্ণ বালিয়াড়ি’ (উড়ো চিঠি)

‘শীতের বাতাস রাতের আঁচলে রেখে যায় অস্তিত্বের তপ্ত নিঃশ্বাস’ (নীরবতার শব্দ)

‘আমার বুকের বাম দিকের গভীর গহিনে বিস্তৃত উর্বর জমিতে/
একদিন হবে অনির্বচনীয় ভালো বাসার রকমারি ফুলের চাষ’ (নির্জন বিলবোর্ডে ন্যুব্জ বিনোদন)
‘সূর্যোদয়ের আহ্লাদী ঠোঁটের স্পর্শে জাগে শিশির ভেজা নিদ্রালু দূর্বাঘাস’ (শঙ্খনীল বাসনা)।

‘স্মৃতিগুলো শরীরের নিঃশ্বাসের মতো হারিয়ে যায় চিরতরে’ (টুকরো স্মৃতির সিম্ফনি)

‘নির্জন পুকুরের পাড় ঘেঁসে ঘাসের আদুরে আলিঙ্গনে/
পাতাঝরা রাস্তা ধরে পড়ন্ত বিকেলের আলসে ছায়ায়/
একদিন ফিরে আসবো মাঝরাতের শেষ ট্রেনে/
অতীতে ফেলে আসা আমার সেই পুরনো স্টেশনে’ (মাঝ রাতের শেষ ট্রেন)

সূর্য কিংকর মজুমদারের প্রকৃত কবি হয়ে ওঠার সব চিহ্নই এ গ্রন্থে বিদ্যমান। কেবল প্রয়োজন বেসিকের দিকে খেয়াল করা। বিষয়-চিত্রকল্প-কল্পনার সাথে সরল ও বোধগম্য হয়ে ওঠার নিরলস প্রচেষ্টাই তাকে কবিতার সেই বাগান রচনা করবার সম্ভাবনা তৈরি করে দিতে পারে। পিঠ চাপড়ানো বন্ধু, বাছ-বিচারহীন বাহবা দেওয়া স্বজনদের থেকে কবি যত দূরে থাকবেন ততই মঙ্গল। কারণ দিনশেষে এরা আপনার সমঝদার, কবিতার নয়।

‘নীরবতা শব্দ’ গ্রন্থের প্রচ্ছদ মনকাড়া। রঙয়ের ব্যবহারের পরিমিতি বোধ আমাকে মুগ্ধ করেছে। সেজন্য উত্তম সেনকে অজস্র ধন্যবাদ। বইয়ের ছাপা প্রায় নিখুঁত। এজন্যে প্রকাশক (যুক্ত) কেও অভিনন্দন।

আমি আশা করছি সূর্য কিংকর মজুমদার বিরতি না দিয়ে লিখে যাবেন। কবি হিসেবে তার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করছি।





রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
Jsfn21@gmail.com




Share on Facebook               Home Page             Published on: 7-Jul-2025

Coming Events: