bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












“মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে......”
রিয়াজ হক



(“THE FIRST STEPS TO BE A GOOD MAN IS THIS: YOU MUST DEEPLY
FEEL THE BURDEN OF THE STONES SOMEONE ELSE IS CARRYING”)



সালাম দিয়ে গাড়িতে ঢোকা মাত্রই খুবই ক্ষীণ স্বরে মুকুল মামা বললেন, “জুয়েল তুমি কেমন আছ”? স্বরটাকে স্বগতোক্তি বলা যায়, ঠিক প্রশ্ন নয়। প্রশ্নের জোরের চেয়ে তাঁর দুর্বল কণ্ঠে জানা ও কথা বলার ইচ্ছেটাই যেন প্রকাশ পাচ্ছিল।
আমি বললাম, “ভাল”। “আপনি”?
উনি বললেন, “এই চলছে আর কি। বয়স হয়ে যাচ্ছে। শরীরে কখন যে কি ঘটছে বোঝা মুশকিল”। দশটার রৌদ্রস্নাত সকালের মিষ্টি আলোতেও ওনার মুখটাকে কিছুটা বিবর্ণ হয়ে যাওয়া পুরনো ছবির মত লাগছিল। ভাবছিলাম ইনিই কি আমার দেখা শৈশব ও কৈশোরের দৃষ্টিতে তীব্র উজ্জ্বল, শানিত চেহারার, কোমল হাসি মুখের সেই সপ্রতিভ তরুণ!

২০১৯ এর ফেব্রুয়ারির কথা বলছি। ষোল তারিখ। আমরা যাচ্ছি মুন্সীগঞ্জের আনারপুরে। ছোট খালুর (মিন্টু খালু) বাপ-দাদার পৈত্রিক বাড়ি বিবি’র ভিটায়। খালু ও তার ভাইরা মিলে ওখানে একটি পাকা দালান তুলেছেন। আজ তার শুভ উদ্বোধন ও দোয়া। আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে একসঙ্গে হওয়া।
খালাম্মা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন যে মুকুল মামা ধানমন্ডি থেকে এসে আমার বর্তমান অবস্থান কলাবাগান থেকে আমাকে তুলবেন ও আমরা এক সঙ্গে যাব আনারপুর। সে মতেই এ যাত্রা।

“তুমি অস্ট্রেলিয়ায় আছ না” জিজ্ঞেস করলেন মুকুল মামা। এবার একটু জোরের সাথেই।
বললাম, “হ্যাঁ”।
-কত বছর হল তোমার?
-আঠারো-উনিশ বছর মামা।
-কেমন লাগে তোমার বিদেশে থাকতে? প্রশ্নটা এমন ভাবে করলেন যেন মনে হল উনি এক আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি। যেন নিজের ভেতরের কোন উত্তরের সাথে আমার উত্তর কে মিলিয়ে দেখতে চাচ্ছেন কে ঠিক!

বুঝতে পেরে আমি জবাবটাকে দীর্ঘ করলাম। বললাম, “ভালই”। “আত্মীয় স্বজন অনেক আছে বলে হয়ত খারাপ লাগাটা টের পাই না। তবে যদি বলেন নিজের দেশের মত, তা কিন্তু না। দেশ মানে দেশ। এর জল-বায়ু, গাছ-পাখি, নদী-মানুষ সব যেমন আপন মনে হয়, তেমন নয়”।

উদাস হয়ে, জানালা দিয়ে তাকিয়ে পেছন ছেড়ে যাওয়া মানুষ, ঘরবাড়ি, গাছপালা, আকাশ দেখতে দেখতে বললেন, “আমার মেয়েরা অনেকবার বলেছে আমেরিকায় যেয়ে ওদের ওখানে থাকার জন্য। কিন্তু বোঝ তো এ বয়সে এটা সম্ভব না। দু’চার দিনের জন্য বেড়াতে যাওয়া যায় কিন্তু থেকে যাওয়া যায় না। এ বয়সটাই একটা বোঝা। বোঝা হয়ে কারো উপর ভর করা যায় না। সে নিজের ছেলে মেয়ে যেই হোক না কেন।”

তখন আমি জানতে চাইলাম, “তা হলে আপনি ঢাকায় কার সাথে আছেন বা কে আপনার সাথে আছে? মানে আপনার কোন হেল্পিং হ্যান্ড”? “যতদূর জানি আমেনা খালাম্মা তো মেয়েদের কাছে আমেরিকায় তাই না”?

বললেন, “হ্যাঁ। আছে, ঐ একটা মহিলা আছে যে আমার রান্নাবান্না, কাপড় ধোয়া, ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা সহ সব কাজ করে দেয়”। তা ছাড়াও আরো একটা মেয়ে আছে। সেও হেল্প করে। অনেক ছোট বেলা থেকেই ও আমাদের সাথে আছে।

এসব কথার ফাঁকে ফাঁকে উনার কাছে নানা জনের ফোন আসছিল। উনি তাদের নানা রকম আদেশ-নির্দেশ-উপদেশ দিচ্ছিলেন। কারো স্বাস্থ্য, কারো চাকুরী, কারো ব্যবসা, পারিবারিক ঝামেলা প্রভৃতি নিয়ে অবিরত কথা বলে যাচ্ছিলেন। তবে সবই খুব সংক্ষেপে টু দ্যা পয়েন্টে সেরে ফেলছিলেন। অনেক সময় দেখলাম একটু বলেই উনি ভেতর থেকে টেনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। মনে হচ্ছিল যেন উনি খুব ক্লান্ত, উনার দরকার অখণ্ড অবসর। এভাবেই টুক টাক নানা কথাবার্তার মধ্য দিয়ে একসময় আমরা পৌঁছে গেলাম মুন্সীগঞ্জের আনারপুরে।

মুকুল মামার সাথে আমার জানা-শোনা ১৯৬৭ সাল থেকে। তখন আমি পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। আর তিনি তখন মাত্র বছর দুয়েক আগেই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে আসা একজন প্রতিশ্রুতিবান তরুণ প্রকৌশলী। উনি আমার ছোট খালুর বন্ধু। বলা যায় বন্ধুর চেয়েও বেশী। আমাদের বৃহত্তর পরিবারের প্রতিটি সদস্যের সাথেই উনার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। ঐ ছোট বয়সেই তার কান্তিময় দেহ, নিখুঁত সজীব মুখমণ্ডল ও সর্বোপরি তার কেতাদুরস্ত পোশাক আমার চোখ ও মনে জায়গা করে নিয়েছিল। পরে আরো বড় হয়ে দেখেছি চলনে-বলনে তার স্মার্টনেস। হাঁটেন দৃঢ় পদক্ষেপে। কথা বলেন অত্যন্ত স্পষ্ট, শোভন স্বরে। তবে তার কথা ও কাজ দেখে আমার বরাবরই মনে হয়েছে তিনি ছুটছেন কোন অধরা স্বপ্নের পেছনে। তিনি প্রকৌশলী, তিনি ব্যবসায়ী। কোনটাকে জীবনে প্রধান করে তুলবেন এ দ্বিধা দ্বন্দ্বে কেটেছে তার জীবনের বড় একটা সময়। অন্তত বিভিন্ন সময় উনার সাথে কথা বলে আমার তাইই মনে হয়েছে।
যাহোক, খালুর বাড়িতে অনুষ্ঠান শেষ করে আবার আমাদের ঢাকায় ফেরার পালা। সন্ধ্যার বেশ আগেই আমরা রওনা হয়ে গেলাম সাথে বয়োজ্যেষ্ঠ এক দম্পতিকে সঙ্গে করে। ফেরত যাত্রার প্রথম দিকটা ভালই ছিল, মুশকিল বাঁধল ঢাকার প্রবেশ মুখে যাত্রাবাড়ীতে। বিশ্রী ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ে গেলাম। গাড়ি একটু যায়, থামে, আবার যায়। মুকুল মামা ও ড্রাইভার মিলে এ রাস্তা, ও রাস্তা করে আগে যাওয়ার চেষ্টা করেও খুব একটা সুবিধা করতে পারলেন না।

আমাদের সঙ্গের যারা, উনারা যাবেন মালিবাগ। কথা ছিল উনাদের ওখানে নামিয়ে দিয়ে তবে আমরা যাব আমাদের গন্তব্যে। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে উনাদের রেলওয়ে হাসপাতালের সামনে নামিয়ে দিতে হল। আমি আর মুকুল মামা গাড়ি থেকে নেমে উনাদের জন্য একটা সি এন জি’র ব্যবস্থা করে দিয়ে আবার গাড়িতে ফেরার মুহূর্তে উনি বললেন, “বুঝলা জুয়েল, আমাদের জীবনটা হল ঢাকার এই যানজটের মতই, বহু পরিকল্পনা করে রাস্তায় বের হয়েও পরিস্থিতির কারণে মধ্য পথে সে পরিকল্পনা পরিবর্তন করে আবার নতুন করে পরিকল্পনা করতে হয়। এতে করে গন্তব্যে হয়ত পৌঁছানো যায়, কিন্তু বড় বেশি দেরী হয়ে যায়”।

গাড়ীতে উঠে মুকুল মামা সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “জুয়েল তোমার কোন তাড়া নাই তো?
আমি বললাম, “কেন মুকুল মামা”?
বললেন, “আমার একটু নিউমার্কেট যাওয়া দরকার। কিছু জিনিস কিনতে হবে”। যদিও সারা দিনের জার্নি-যানজট মিলিয়ে আমি খুবই ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত তবুও বললাম, “না মামা, চলেন”। বললাম এই ভেবে যে উনার এই বয়সেও যদি উনি পারেন তাহলে আমারও পারা উচিত।

গাড়ি কোনমতে নিউমার্কেটের সামনের রাস্তায় রেখে আমরা নিউমার্কেট সংলগ্ন বিশাল দ্বিতল মার্কেট ভবনের দিকে যাওয়া শুরু করলাম। হাঁটতে যেয়ে দেখি উনি কিছুটা ভারসাম্যহীন হয়ে যাচ্ছেন। পা ফেলছেন এলোমেলো। মাঝে মাঝে উনার বাঁ হাত দিয়ে আমার ডান হাত শক্ত করে চেপে ধরছেন। আমার অভ্যাস সবসময় একটু দ্রুত হাটা, সঙ্গীকে ছাড়িয়ে একটু সামনে চলে যাওয়া। তাই গতি স্লথ করে উনাকে কিছু না বলে আমি উনার পাশাপাশিই হাঁটতে থাকলাম যাতে উনি আমাকে ধরেই হাঁটতে পারেন। উনিও জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে তাইই করলেন।

যত্ন করে রাখা একটি সূতা খুব সন্তর্পণে মানিব্যাগ থেকে বের করে এক দোকানীকে দিয়ে বললেন, “ঠিক এই মাপের স্যান্ডেল দরকার”। দোকানীরা সাধারণত সূতা স্যান্ডেলের উপর রেখে টেনেটুনে বলতে চায় যে এটা একদম মাপ মত। উনার পছন্দ হয়না। এভাবে দু’তিন দোকান ঘুরে স্যান্ডেল কিনলেন।
আমাকে বললেন, “বাসার মেয়েটা বেরোবার সময় একটি লিস্ট দিয়েছে। এগুলো আজকেই কিনতে হবে। এর আগেও দু’তিনবার মুখে বলেছিল, আমি ভুলে যাই। আজকাল অনেক কিছুই ভুলে যাই। নামধাম, কাজের কথা, কারো ফরমায়েশ, অনুরোধ অনেক কিছুই আর আগের মত মনে রাখতে পারি না”।
বললাম, “মামা, আমিই ভুলে যাই আর আপনি? আপনি তো আমার চেয়ে ১৫/১৬ বছরের বড়।
কথা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে এক অর্থপূর্ণ হাসি দিলেন। যার অর্থ হল, তুমিও তাহলে আমার পথেই হাঁটছ!

এরপর উনি আরেক দোকানে গেলেন একটি বিদেশী ব্র্যান্ডের তেল কেনার জন্য, মাথার চুলের যত্নের। পাঁচ/ছ দোকান ঘুরে অনেক কষ্টে মিলল সেই তেল। দোকানী দাম বেশী হাঁকাল। উনি বুঝলেন, তবুও কিনলেন। কেনার আগে ফিসফিস করে আমাকে বললেন, “দাম বেশী চাচ্ছে, পরে পাই কিনা, আবার কবে আসতে পারব কে জানে, কিনে ফেলাই ভাল, কি বল?”
আমি বললাম, “জী মামা, নিয়ে নেন”।

আমি চাচ্ছিলাম যেন তাড়াতাড়ি কেনাকাটা শেষ হয়, বাসায় ফিরতে পারি। উনার অসম্ভব ধৈর্য ও সহ্য শক্তি দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম।

তেল কেনার পর ফিরব এমন সময় উনি বলে উঠলেন, “জুয়েল, আমার একটু টয়লেটে যেতে হবে”।

মনে মনে বললাম, রক্ষা কর বিধাতা কিন্তু মুখে বললাম, “ঠিক আছে মামা চলেন”। সমস্যা হল এখানে টয়লেট খুঁজে পাওয়া। দু’তিন জনকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল টয়লেটের জন্য মার্কেটের দোতলায় যেতে হবে। আমার হাত ধরে এক পা দু’পা করে উনি উঠলেন দোতলায়। টয়লেট খুঁজে পেলেও দেখলাম ওখানে লাইন হয়ে আছে। একজন ভেতরে, বাইরে আরো দুজন অপেক্ষায়।

সময় যেন আগায় না। পাথরের মত মগজে চেপে বসে আছে। মনে হচ্ছে লোকগুলো যেন বেশী সময় নিচ্ছে। ঢুকলেও যেন বেরুতে চাচ্ছে না। এক পর্যায়ে উনি বলে উঠলেন, “জুয়েল, চলে যাব নাকি”?
আমি বললাম, “মামা, জরুরী হলে অপেক্ষা করাই ভাল”।
ভরসা পেয়ে উনি বললেন, “হ্যাঁ, করে যাওয়াই ভাল। বুঝলা জুয়েল বয়স হওয়ার পর দেখলাম পৃথিবীটা আসলে বড়ই কঠিন। কাজ করা কঠিন। নিজের যত্ন নেওয়া কঠিন। মানুষের আবদার মেটানো কঠিন। সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। চার পাশের সবকিছু মেনে নেওয়াও কঠিন”।
একটু থেমে বললেন, “আসলে জীবনটাই কঠিন”।

কি ভেবে জানি না উনাকে আশ্বস্ত করতে অনেকটা যুক্তিহীন ভাবে আমি বললাম, “আসলে মামা, জীবন না, জীবনের বোধটাই বোধহয় কঠিন। আপনার বয়স যখন পঁচিশ ছিল তখন কিন্তু জীবন সুন্দরই ছিল। তখন স্বপ্ন ছিল। আশা ছিল। এখন এই পচাত্তুরেও সেই স্বপ্ন আর আশাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেই জীবন আবার সহজ হয়ে যাবে”। বলে হেসে ফেললাম।
উনিও আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “বয়স আরেকটু সামনে আগাক, তখন বুঝবে মামা ঠিক বলেছিল কি না”।

এখনও কানে বাজে উনার পরিণত বয়সে পৌঁছে জীবন-সত্যের এই চরম উপলব্ধির কথা। সামনে এমন দিন কি আসছে যখন সত্যিই মনে হবে জীবনটা আসলেই কঠিন!

(বিঃদ্রঃ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মুকুল মামা মারা গেছেন ২০২০ এর ১৯শে মে। তার আত্মার শান্তির জন্য স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করছি কায়মনোবাক্যে। উনার সম্পর্কে একটি কথাই বলব যে উনি আপাদমস্তক একজন ভালো মানুষ ছিলেন। আমাদের চারপাশে অনেক মানুষ কিন্তু ভাল মানুষ? অনেক কম!)




রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
Jsfn21@gmail.com




Share on Facebook               Home Page             Published on: 6-Jul-2022

Coming Events:



A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far