bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













মির্যা গালিব - অবিস্মরণীয় কবি প্রতিভা!
রিয়াজ হক



কবি-সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ এর সময়ে মোঘল সাম্রাজ্যের পতন, ভারতে ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনের প্রতিষ্ঠা এবং ভারত বর্ষের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী; এক যুগ সন্ধিক্ষণের সচেতন সাক্ষী মির্জা গালিবের (আসাদুল্লাহ বেগ খান) মতো প্রতিভাবান, দুরূহ অথচ একই সঙ্গে অসম্ভব জনপ্রিয় কবি ভারতের ইতিহাসে দ্বিতীয় কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। উর্দু, ফার্সি ও তুর্কি ভাষায় সুপণ্ডিত গালিব মাত্র এগার বছর বয়সে কবিতা লিখতে শুরু করেন। তৎকালে তিনিই ভারত বর্ষের একমাত্র কবি যিনি জীবিকার প্রয়োজনে কখনো কোন কাজ করেন নি। মোঘল সম্রাট ও নিকট বন্ধুদের বদান্যতায় চলত তার প্রতিদিনের জীবন ও সংসার। কবিতাই ছিল তার শক্তি, পেশা ও নেশা। তার নিজের কবিত্ব শক্তির উপর কতটা আস্থা ছিল তার প্রমাণ তার একটি অসাধারণ শায়েরিঃ
“হু গরমিয়া নিশাতে তাসাব্বুরসে নাগমা সাঞ্চ
ম্যায় আন্দালিবে গুলশানে না আফরিদাহু”
আমি আমার হৃদয়ের ধ্যানের উত্তাপে অবিরল গান গেয়ে যাই; আমি জানি, আমি যে বাগানের গানের পাখি সে বাগান এখনও পৃথিবীর বুকে জন্মায় নি।

এক প্রিয় বন্ধুর পরামর্শে ১৮৪১ সালে ১১০০টি শায়ের নিয়ে প্রকাশ করেন তার প্রথম দিওয়ান। সেই সূত্রে দিল্লি কলেজের ফার্সি ভাষাশিক্ষার চাকুরীও চলে এসেছিল তার হাতে প্রায়। তখনকার দিল্লি কলেজের পরিদর্শক ছিলেন এক ইংরেজ, নাম জেমস্ থমসন। ফার্সি ভাষায় গালিবের বিশেষ দক্ষতা শুনে তার কাছে প্রস্তাব পাঠানো হলো কলেজের ছাত্রদের পড়ানোর জন্য। গালিবও প্রস্তাব মেনে থমসনের বাড়ি আসলেন। অপেক্ষা করলেন অভ্যর্থনা জানিয়ে তাঁকে ভেতরে নেবার। কিন্তু কেউ এলো না, গালিবও ভেতরে গেলেন না। কিছুক্ষণ পরে থমসন নিজেই বেরিয়ে এসে জানতে চাইলেন, ভেতরে না যাবার কারণ। উত্তরে গালিব জানালেন, আগে প্রতিবারই তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে; এখন ব্যতিক্রম হবার কারণ কি? থমসন স্পষ্ট করে দিলেন বিষয়টি। আগে প্রতিবার গালিব এসেছেন মোঘল দরবারের একজন অতিথি হয়ে, আর এখন একজন চাকুরে। শুনে সাথে সাথেই চাকুরী না নিয়ে ফিরে আসেন মির্জা গালিব। এই ঘটনাই নির্ধারণ করে দেয় কবির প্রবল আত্মসম্মানবোধ; জীবন চেতনা যা এখনকার কাল ও সময়ে বিরল। যেমন তিনি বলেছেনঃ
“না সাতায়িশ কি তামান্না, না ছিলে কি পারওয়া,
গার নেহি হ্যায় মিরে আশার ম্যায় মানি না সাহি।”
প্রশংসা পাবার খায়েশ নেই; কোনো বিনিময়েরও প্রত্যাশা করি না। এমন যেন না হয় যে, আমার লেখার কোনো অর্থ নেই।

তার লেখা অজস্র গজল, শায়েরি, রুবাইয়াতে বিহ্বল হয়েছে আপামর সাধারণ মানুষ, সে সদ্য প্রেমে পড়া ছটফটে তরুণ থেকে বিদগ্ধ পণ্ডিত পর্যন্ত। তার কবিতা উচ্চারিত হয়েছে পথের ভিখারি থেকে সম্রাটের মুখে। তার শায়েরি এবং গজল প্রভাবিত করেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। তিনি নিজেই বলেছেনঃ ‘যে কবির কবিতা বালাখানায় ডোমনি আর রাস্তায় ফকিরেরা গায়, তাকে কে মারতে পারে?’ উপমহাদেশে সঙ্গীতের পুরোধা জগজিৎ সিং, মেহদি হাসান, মোহাম্মদ রফি, গুলাম আলী, গুলজার কিংবা রাহাত ফতেহ আলী খানও ব্যবহার করেছেন তার পঙক্তি। বিভিন্ন আসরে গেয়েছেন, গাচ্ছেন তার লেখা সমৃদ্ধ সব গজল।

তৎকালে নানা ভাষা-ধর্ম-বর্ণের ভারতে জীবিকার সন্ধানে বিভিন্ন সময়ে ঠাঁই নিয়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আগত বহু মানুষ। আরব, আফগান, তুর্কি, পার্শিয়ান এবং মাঙ্গল। তাদের অনেকেই আর ফিরে যাননি নিজ দেশে। মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের যুগে কুক্বান বেগ খান নামে এমন এক ভাগ্যান্বেষী তুর্কি-সেলজুক সৈনিক আগমন করলেন। কিছুদিন লাহোরে বসবাস করে দিল্লিতে গিয়ে চাকুরী নেন সম্রাট শাহ আলমের দরবারে। সেখানেও মন না টিকলে চলে যান জয়পুরের মহারাজার অধীনে। স্থায়ীভাবে বসবাস করেন আগ্রায়। দুই ছেলের মধ্যে নাসরুল্লাহ বেগ খান চাকরি জুটিয়ে নেন মারাঠা শিবিরে। অন্য ছেলে আবদুল্লাহ বেগ খান অতটা ভাগ্যবান ছিলেন না। বহু দরবার ঘুরে ফিরে আলোয়ার মহারাজ বক্তাওর সিং এর সেনাধিনায়ক হিসাবে যোগ দেন। কিন্তু সেখানেও থাকা হয়ে উঠেনি। ১৮০২ সালে মৃত্যু বরণ করলেন বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে।

ইতোমধ্যে দুই পুত্র এবং এক কন্যা রেখে যান আবদুল্লাহ বেগ। বড় ছেলের নাম আসাদুল্লাহ বেগ খান; পরবর্তী সময়ে যিনি মির্জা গালিব নামে বিখ্যাত হন। উর্দু শব্দ ‘গালিব’ এর অর্থ বিজয়ী। গালিব শুরুতে তার নিজের নামের অংশ ‘আসাদ’ নামে লিখতে শুরু করেন। পরবর্তীতে ছদ্ম নাম নেন ‘গালিব’। সাহিত্যে তার অবিস্মরণীয় প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ মোঘল সম্রাট কর্তৃক প্রথমে তাকে ‘দবির-আল-মূল্‌ক’, পরে ‘নিযাম-আদ্‌দৌলা’ ও ‘মির্যা নোশা’ উপাধি দেওয়া হয়। সেখান থেকেই তিনি মির্যা উপাধিটি ‘গালিব’ নামের আগে ব্যবহার করতে শুরু করেন।

১৭৯৭ সালের ২৭শে ডিসেম্বর আগ্রার ‘কালা মহল’এলাকায় জন্ম নেয়া গালিব বেড়ে উঠেছিলেন চাচা নাসরুল্লাহ খানের তত্ত্বাবধানে। কারণ তার পিতার মৃত্যুর সময় গালিবের বয়স ছিল পাঁচ বছরের কিছু বেশি। হাতির পিঠ থেকে পড়ে ১৮০৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন চাচা নাসরুল্লাহ। তার শিশুকাল ছিল অত্যন্ত সংগ্রাম মুখর। নবাবের সুপারিশে ব্রিটিশ রাজের পারিবারিক ভাতায় চলত তার মায়ের সংসার। জীবনের উপলব্ধি নিয়েই পরে তিনি লিখেছেন-
“বাজিচায়ে আতফাল হ্যায় দুনিয়া মেরে আগে,
হোতা হ্যায় সব রোজ তামাশা মেরে আগে।”
আমার সামনে পৃথিবীটা যেন বাচ্চাদের খেলার মাঠ, প্রতিটা রাত্রি আর দিনে কেবল তামাশাই ঘটে যাচ্ছে।

আগ্রায় এক মাদ্রাসার প্রসিদ্ধ শিক্ষক মুহম্মদ মুয়াজুমের ছাত্র ছিলেন গালিব। তৎকালীন মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থায় আরবি ভাষা ও ধর্মকে গুরুত্ব দেয়া হতো। সরকারি ভাষা হবার বদৌলতে পড়তে হতো ফার্সি। শীঘ্রই আবদুস সামাদ নামক জনৈক ব্যক্তির জ্ঞান এবং চিন্তা তাকে প্রভাবিত করে। ভদ্রলোক প্রথম জীবনে জরাথুস্ত্রবাদী থাকলেও পড়াশোনা করে ইসলামে দীক্ষা নেন। আরবি-ফারসি ভাষা এবং বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিল ঈর্ষণীয়। গালিব দুই বছর (১৮১০-১২) তার কাছ থেকে ভাষা, সাহিত্য ও ধর্মের নানা বিষয়ে প্রভূত জ্ঞান লাভ করেন। পরবর্তী জীবনেও তার সাথে গালিবের যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। তাদের মধ্যে পত্রালাপও হয়েছে অনেক।

আগ্রার মকতবে থাকতেই শায়েরি লেখায় হাত পাকান গালিব। প্রথম দিকে ফার্সিতে লিখলেও দ্রুতই উর্দুকে বেছে নেন ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে। ততদিনে শিক্ষিত সমাজে উর্দুর ব্যবহার এবং মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবদুস সামাদের মাধ্যমে পরিচিত হন ফারসি সাহিত্যের প্রাণপুরুষ বেদিল, বুখারী, আসির, রুমি, জামিদের সাথে। গালিব প্রথমদিকে তাদের ব্যর্থ অনুকরণ করে লেখার চেষ্টা করেন। লেখাগুলো তাই ঠিক কবিতা হয়ে ওঠেনি। হতাশ না হয়ে এগিয়ে গিয়েছেন। ক্রমাগত পড়তে পড়তে, লিখতে লিখতে একসময় খুঁজে পান তার নিজস্ব ভাব প্রকাশের অনন্য ভুবন। যে ভুবনে তিনি তৈরি করেছেন জীবনের অগণিত ছবি যা বুদ্ধিবৃত্তিকে অতিক্রম করে হরণ করেছে মানুষের চোখ ও হৃদয়। আর সেখানেই তিনি অন্যদের থেকে হয়ে যান স্বতন্ত্র।

সেই সময়ের সাহিত্য রসিক এক নবাব, নাম হুসামুদ্দৌলা ছিলেন গালিবের কবিতার ভক্ত। একবার কিছু গজল সাথে নিয়ে তিনি সেই সময়ের বিখ্যাত কবি মীর ত্বকী মীরকে দেখান। লক্ষ্ণৌতে বসে উদীয়মান কবির লেখা দেখে মীর এই বলে আক্ষেপ করেছিলেন যে, একটা গুরু পেলে বালকটির বড় কবি হয়ে উঠার সম্ভাবনা আছে; আর না পেলে অসার কথামালা গেঁথেই প্রতিভা শেষ হয়ে যাবে। সেই সময়ে মীরের অবস্থান ছিল উর্দু কাব্য প্রতিভায় সব থেকে উঁচুতে আর তার মৃত্যুর সময় গালিবের বয়স ছিল মাত্র তেরো বছর। সেই বয়সের লেখা গালিবের কবিতা হুসামুদ্দৌলার মাধ্যমে মীরকে দেখানোর ঘটনাই ইঙ্গিত দেয় গালিবের কবি হয়ে উঠবার অনন্ত সম্ভাবনার কথা। শেষ পর্যন্ত হয়েছিলও তাই, গালিব কোনো নির্দিষ্ট কবির ছায়ায় না দাঁড়িয়েই নিজ মেধা ও যোগ্যতায় স্মরণীয় হয়ে উঠেন।

এর মধ্যে ১৮১০ সালের আগস্ট মাসে ইলাহি বক্স খানের কন্যাকে বিয়ে করেন গালিব। ইলাহি বক্স ছিলেন ফিরোজপুরের ঝিরকা এবং লোহারুর নবাব আহমদ বক্স খানের ভাই। খুব সম্ভবত তাদের অনুরোধেই আগ্রা ছেড়ে দিয়ে স্থায়ীভাবে দিল্লিতে বসবাস শুরু করেন। বিয়ের সময় গালিবের বয়স ছিল মাত্র ১৩। এত অল্প বয়সে বিয়েটি যে তার পছন্দ হয়নি তা তার দাম্পত্য জীবন নিয়ে এক চিঠিতে তিনি লিখছেন, “৭ রজব ১২২৫ সালে আমার জন্য যাবজ্জীবন কারাবাসের বিধান হলো। একটা বেড়ি, অর্থাৎ বিবি আমার পায়ে পরিয়ে দেওয়া হলো আর দিল্লি শহরকেই আমার কারাগার সাব্যস্ত করে আমাকে সেই কারাগারে নিক্ষেপ করা হলো।“ তিনি সাত সন্তানের জনক ছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্য তার কোন সন্তানই দীর্ঘ আয়ু পায় নি। প্রায় প্রত্যেকেই শিশু বয়সে মৃত্যু বরন করেছে। শুধু তাই নয়, ছেলেবেলায় দত্তক নেওয়া তার ভ্রাতুষ্পুত্র মির্যা আরিফ মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে মারা যায় যে নিজেও ভালো কবিতা লিখত। এজন্য জীবনের দুঃখবোধ গালিবের কবিতার এক বিশেষ দিক। যেমনঃ
(এক) “কয়েদ-এ-হায়াত ওয়া বন্দ-এ-গাম আসল্ মে দুনো এক হ্যায়,
মওতসে পেহলে আদমি গাম সে নাজাত পায়ে কিউ?”
জীবনের মেয়াদ আর বিষাদের বন্দিত্ব আসলে এক ও অভিন্ন, মৃত্যুর আগেই মানুষ বিষাদ থেকে মুক্তি পাবে কেন?

(দুই) “কাহো কিসসে ম্যাঁয় কি কিয়া হ্যায় শাবে গাম বুরি বালা হ্যায়,
মুঝে কিয়া বুরা থা মারনা আগার এক বার হোতা?”
এই নিঃসঙ্গ আর বিষণ্ণ রাতের অভিযোগ আমি কার কাছে করব? প্রতি সন্ধ্যায় মরার চেয়ে একবারে মৃত্যুটাই কি শ্রেয় ছিল না?

(তিন) “নাজিম থা কি দেখো মেরে রাস্তা কয়দিন ওয়র
তানহা গেয়া হো কিউ, আব রোহো তানহা কয়দিন ওয়র”
তোমার উচিত ছিল আরো কিছুদিন আমার পথ চেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করা। একা কেন গেছ তুমি?

(চার) “দিল মে ভি শিকায়াত হ্যায় গামকো তাঙ্গিয়ে যাকা
কি এক গওহর মে মেহারব হ্যায় দরিয়া কা”
হৃদয়ের মধ্যে দুঃখরা এসে জায়গা না পাওয়ার অভিযোগ দায়ের করে বলছে “তোমার হৃদয় এত ছোট কেন (গালিব)।

গালিব মোগল দরবারে অনিয়মিত হলেও সভাকবি হিসেবে নিজের লেখা কবিতা পড়তেন এবং রাজ পরিবারের সদস্যদের কবিতা লেখার নানা অনুষঙ্গের পাঠ দিতেন। তাকে মোঘল বিচারালয়ের ইতিহাসবিদ হিসেবেও সম্রাট কর্তৃক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।

অন্য কবিদের মতই গালিবের কবিতায় প্রেম এসেছে প্রধান হয়ে, অনিবার্য ভাবেই। তা ছিল কাব্য-রহস্যের সুষমায় অনির্বচনীয় এক সৌন্দর্যের আলোয় আলোকিত। সে জন্য অনেক গবেষক-সমালোচক নিরন্তর চেষ্টা করেছেন তার বাস্তবের একজন প্রেমিকাকে খুঁজে পেতে। কিন্তু বলা যায় এক্ষেত্রে সবার সার্থকতাই আধাআধি। তার প্রেমিকারা অর্ধেক রক্ত মাংসের মানবী, অর্ধেক অধরা, অশরীরী। যেমন তিনি বলছেনঃ
(এক) “হাম থে মরনে কো খাড়ে, পাস না আয়া না সহি,
আখির উস্ শোখকে তারকাশমে কোয়ি তীর ভি থা-?”
আমি তো মরবার জন্যেই দাঁড়িয়ে ছিলাম; সে-ই তো কাছে এলো না। আচ্ছা, মারবার জন্য কোনো তীরই কি ছিল না আজ রূপময়ীর তূণে?

(দুই) “মেহেরবা হোকে মুঝে বুলালো, চাহো যিস্‌ওয়াক্ত
ম্যায় গেয়া ওয়াক্ত নেহি হো, কি ফির আভি না সাকো”
দয়া করে তোমার যখন ইচ্ছা আমায় ডেকে নিও; আমি তো ‘চলে যাওয়ার সময়’ নই যে ফিরে আসতে পারব না।

(তিন) “ওয়াও, ঘরমে হামারা খুদাকি কুদরত হ্যায়
কাভি হাম উনকো, কাভি আপনে ঘরকে দেখতে হ্যায়”
সে আসায় যেন আজ আমার ঘরে খোদার মেহেরবানী নেমে এসেছে। কখনো আমি তাকে, কখনো আমি আমার ঘরকে দেখছি। জানি না কোনটা সত্য!

(চার) “ইয়ে না থি হামারি কিসমাত্ কি বিসাল-এ ইয়ার হোতা,
আগার অওর জিতে রেহতে ইয়েহি ইনতেজার হোতা।”
প্রিয়ের সাথে মিলন হবে; আসলে এ আমার ভাগ্যেই ছিল না। যদি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতাম, অপেক্ষাটাই দীর্ঘতর হতো শুধু।

যেহেতু তার নির্দিষ্ট কোন রোজগার ছিল না তাই অর্থকষ্ট ছিল গালিবের জীবনের নিত্যদিনের সঙ্গী। অর্থকষ্টে গালিব তখন জর্জরিত। তাই যেন আরো বেশি করে জড়িয়ে গেলেন জুয়ার নেশায়। এই অপরাধেই গ্রেফতার হয়ে তিনমাসের জন্য ঢুকলেন জেলে। সেখানেও প্রচলিত আছে এক গল্প। জেলে থাকার সময় একদিন এক যুবককে কাঁদতে দেখেন গালিব। কারণ জানতে চাইলে যুবক উত্তর দেয়, এক মামুলি অপরাধে তার তিনদিনের...


...জেল হয়েছে। গালিব বিস্মিত হয়, মাত্র তিনদিনের কারাবাসের জন্য কান্না! ফোঁপাতে ফোঁপাতে যুবক জানায়, না তা নয়, আসলে তার বিয়ে হবার কথা ছিল; জেলের কারণে তার বিয়েটা ভেঙে গেল সেই দুঃখ থেকে সে কাঁদছে। গালিবের উত্তর ছিল রসাত্মক- “বাহ! মাত্র তিনদিনের জেলের বিনিময়ে সারাজীবনের জেল খাটা থেকে বেঁচে গেলে। তোমার তো বরং আনন্দ করার কথা”।

আরো গল্প প্রচলিত আছে যে একবার বাসা ভাড়ার দেনার দায়ে এক বাড়িওয়ালা গালিবকে বাসা থেকে বের করে দেন। তখন গালিব একটি গাছের নিচে চারপায়া খাটিয়ায় বসে চারদিকে ছড়ানো ছিটানো মালপত্রের দিকে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। এমন সময় আশেপাশের লোকজন এসে জানতে চাইল যে গালিবের কি হয়েছে। গালিব তখন হাসতে হাসতে বলেছিলেনঃ
“আসমাসে সে আতে হুয়ে পুস্তে হ্যায় হার বালা, গালিব কে ঘর হ্যায় কিধার”।
আসমান থেকে আল্লাহতালা যত বিপদ পাঠান, সে বিপদ-আপদ গুলো বিভিন্ন যায়গায় যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করে গালিবের ঘর কোথায়, ওর সাথে একটু দেখা করে যাই।

আজকে গালিবের যা কিছু বিশাল খ্যাতির কথা আমরা জানি তা এসেছে গালিবের মৃত্যুর পর বিদগ্ধ কাব্য রসিক ও সমালোচকদের হাত ধরে গালিবকে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে আবিষ্কারের পর। কারণ গালিব হলেন উর্দু ভাষার এক জটিল অথচ জনপ্রিয় কবি। গজল, মাস্‌নভি ও কাসিদা এই তিন পদ্ধতিতে লেখা তার সব কবিতা। গালিব তার কবিতায় স্রষ্টা কে খুঁজেছেন আধ্যাত্মিকতার ভেতর, কোন নিয়মতান্ত্রিক আচারের মধ্যে নয়। তিনি জীবন কে দেখেছেন এক শেষহীন সংগ্রাম হিসেবে; মৃত্যু যার পরিণতি। প্রতিটি মানুষের জীবন ও বেঁচে থাকা তার কাছে ছিল শিশুদের খেলার মত যা কোন বিশাল উদ্দেশ্য থেকে উদ্ভূত নয়। লেখা ছিল গালিবের কাছে তার পাঠককে আনন্দের ঝর্ণাধারায় ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যম। জীবনকে হাসি-তামাশা-আনন্দের মধ্য দিয়ে দেখার এক অদ্ভুত প্ররোচনা কাজ করেছে গালিবের মধ্যে। তিনিই উর্দু সাহিত্যের প্রথম ব্যক্তি যিনি কবির জীবন ও কবিতাকে মাটির মানুষের পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তাঁকে উর্দু গদ্যের জনক বলা হয়ে থাকে। উর্দু গদ্যে চিঠি-সাহিত্য বলে যা কিছু আজ পাওয়া যায় তাও গালিবের হাতে তৈরি। তিনি চিঠি লিখতে খুব ভালোবাসতেন এবং তার অনন্য প্রতিভা তাকে আজ সাহিত্যের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। তার বিখ্যাত রচনা হচ্ছে ‘দিওয়ানে গালিব’ (গজলের সংগ্রহ), ‘চিরাগ ই দাইর’ প্রভৃতি। ফার্সি ভাষায় লেখা তার প্রায় আড়াই হাজার গজল ও উর্দুতে লেখা দুইশত চৌত্রিশ টি গজলের খোঁজ পাওয়া যায়।

গালিব বেশ কিছু দিন (প্রায় দুই বছর) কোলকাতায় বসবাস করেছিলেন। তৎকালীন ভারতের রাজধানী কোলকাতার বাঙালি জীবন, তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক আবহ, ব্যবসা-বাণিজ্য দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন এবং বাঙ্গালিদের সম্পর্কে এক অমূল্য মন্তব্য করেছিলেন যা আজও চিন্তার খোরাক যোগায়। তিনি বলেছিলেন, “বাঙালি এমন এক জাতি যারা একই সঙ্গে একশ বছর অতীতে ও একশ বছর ভবিষ্যতে বাস করে”। তবে কোলকাতাকে তিনি পছন্দ করেছিলেন নতুন যুগের চিন্তা-ভাবনার সূতিকাগার হিসেবে। তাই তিনি বলেছিলেনঃ
“কোলকাত্তে কা জো জিকির কি তুনে এই হামনশি, এক তীর মেরে সিনে মে মারা কে হায় হায়”!
কোলকাতার কথা কেন তুমি বললে হে বন্ধু, যেন তুমি আমার এ বুকে এক তীর ছুড়ে দিলে, হায় হায়!

এ হেন গালিব নিতান্ত অর্থকষ্ট ও দারিদ্র্যের মধ্যে ১৮৬৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি, বাহাত্তুর বছর বয়সে দিল্লীর চাঁদনী চকের গলি কাশেম জানের হাবেলিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এটাকে গালিবের হাবেলিও বলা হয়ে থাকে। তিনশ বছরের পুরনো এই হাবেলি এখন ‘গালিব স্মৃতি সংগ্রহশালা’ নামে খ্যাত। এখানে বলা প্রয়োজন যে এই বাড়িটি তার কবিতার একজন গুণমুগ্ধ পাঠক চিকিৎসক (হাকিম) তাকে দান করেছিলেন। এই বাড়িতে বসেই গালিব তার বেশ কিছু বিখ্যাত রচনা সৃষ্টি করেছিলেন।

দিল্লির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগার পাশেই কবির সমাধি। যে কবি নিজের অস্তিত্বের ঘোষণা দিয়েছিলেন এই বলেঃ

“ইয়া রব, জামানা মুঝকো মিটাতা হ্যায় কিস লিয়ে,
লাওহে যাহাপে হারফে মুকাররার নেহি হু ম্যায়”!
হে খোদা, এ কাল কেন আমাকে মুছে ফেলতে চায়। জগতের পৃষ্ঠায় ভুল করে দ্বিতীয় বার লিখে ফেলা কোন হরফ তো আমি নই!


(তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেটের বিশাল ভাণ্ডার)





রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া, Jsfn21@gmail.com






Share on Facebook               Home Page             Published on: 26-Oct-2021

Coming Events:



Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far