bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












কেন পুনরায় মার্ক্স/লেখক বদরুল আলম খান
(গ্রন্থ আলোচনা)



আপনি পড়ালেখা জানা মানুষ। আপনি স্বশিক্ষিত। আপনি অনুভূতিপ্রবণ। সাহিত্য, শিল্পকলা, বিজ্ঞান বা সমাজতত্ত্বে আপনার আগ্রহ, আর আপনি কার্ল মার্ক্সের কথা শুনেন নি, তাঁকে পড়েন নি এমনটি হতে পারে না। আঠারো শতকের অবিস্মরণীয় প্রতিভা, উনিশ শতকের প্রায়োগিক বিস্ময় আর বর্তমান শতকের নিরুপায় ধাঁধাঁ হচ্ছেন কার্ল মার্ক্স।

কার্ল মার্ক্স হচ্ছেন এমন একজন মানুষ যিনি তার ৬৪ বছরের (১৮১৮-১৮৮৩ খৃষ্টাব্দ) জীবন কে বিশ্ব মানবতার মুক্তির সংগ্রামে উৎসর্গ করে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, “স্বাধীনতার শিকল ছাড়া সর্বহারাদের হারানোর কিছু নেই”। আর তাই আওয়াজ তুলছিলেন “দুনিয়ার মজদুর এক হও”। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সমাজ বদলের সংগ্রামের বাস্তবতায় এটা কতটা কার্যকরী হয়েছিল বা ভবিষ্যতের সমাজ ভাবনায় তা যৌক্তিক অবদান রাখার সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখে কি না! সে হিসেবেই কার্ল মার্ক্স আজও, এখনও অবধারিত ভাবেই প্রাসঙ্গিক। আর সে জন্যই সমাজতত্ত্বের একজন শিক্ষক, গবেষক হিসেবে লেখক বদরুল আলম খানের সাম্প্রতিক প্রকাশিত গ্রন্থ ‘কেন পুনরায় মার্ক্স’ বিশেষ ভাবে অধ্যয়ন ও আলোচনার দাবী রাখে।

লেখক এই গ্রন্থে দুটি পর্বের পনেরটি অধ্যায়ে মার্ক্সের জীবন, তার দর্শন ও বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে মার্ক্সবাদের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ২০২৩ এর বই মেলায় মাসুক হেলালের প্রচ্ছদে, প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত প্রায় তিনশ পৃষ্টঠার ঝকঝকে ছাপার এই গ্রন্থটি দেখলেই পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়ে যায়।

লেখক যে ভাবে সমাজ ও অর্থনীতিতে মার্ক্সীয় বয়ান কে এই গ্রন্থে তুলে এনেছেন তা হলঃ
(এক) বস্তুগত ও চেতনাগত দিকের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্কের উদ্ভাবন ও বিশ্লেষণে তিনি বলেছেন, ভাব নয়, বস্তু জগত থেকে চেতনার উন্মেষ ঘটে।

(দুই) পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় উদ্বৃত্ত শ্রমের শোষণ ঘটে। মুনাফার কথা ভেবে পুঁজিপতি উদ্বৃত্ত পণ্য উৎপাদন করে, শ্রমিকের শ্রম শোষণের মাধ্যমে উদ্বৃত্ত মুনাফা অর্জন করে। এখানে মানব কল্যাণের দিকটি তার কাছে গুরুত্বহীন।

(তিন) আদিম সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা থেকে সামন্তবাদ পার হয়ে যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আমরা উপনীত হয়েছি তা তার আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে শ্রমিক বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক সমাজে পরিণত হবে।

(চার) আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে ধর্মের প্রভাব সীমিত বা ক্ষুণ্ণ হবে।

(পাঁচ) মানুষ পরিবেশ কে বদলে দিয়ে সমাজকেও বদলে দিতে পারে। মার্ক্স বলেছিলেন, “বিপ্লবের জন্য রাজনৈতিক সচেতনতার চেয়ে শ্রেণি সচেতনতার প্রয়োজন বেশি। আর তাই “শ্রমিক আন্দোলনের লক্ষ্য হবে পুরনো কাঠামোকে বদলে দেওয়া, তাকে উৎখাত করা। পুরনো সমাজ কে না বদলে সত্যিকার পরিবর্তন আনা অকল্পনীয়”।

এ প্রসঙ্গে গ্রন্থটির ‘প্রাক কথন’ থেকে একটি অংশ উল্লেখ না করে পারছি না। এখানে লেখক বলছেন, “মার্ক্সের আদর্শের চাঞ্চল্যকর প্রভাব বৈশ্বিক রাজনীতি ও সামাজিক আন্দোলনের ওপর পরিমাণগত ভাবে কতটুকু ছিল সেটা জানা যাবে যদি ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব থেকে হিসাব শুরু করি। ওই বিপ্লবের সঙ্গে মার্ক্সবাদের সংযোগসূত্র তো ছিলই, আরও যেসব ঘটনা সাম্প্রতিক ইতিহাস কে কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে, যেমন চিনের বিপ্লব, কিউবান বিপ্লব, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, স্নায়ু যুদ্ধ, এমন কি ইরানের ইসলামী বিপ্লব বা আফগান গৃহযুদ্ধ এসবের ওপরও মার্ক্সীয় আদর্শের প্রভাব ছিল সর্ব্ব্যাপী” (পৃষ্ঠা ১২)।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় মার্ক্সীয় তত্ত্ব ও এর প্রায়োগিক উপযোগিতা। কারণ রাশিয়া সহ পূর্ব ইউরোপীয় যেসব দেশ মার্ক্সবাদের তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তারা নব্বুইয়ের পর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোকে বিসর্জন দিয়ে আবার পুঁজিবাদী ধারায় ফিরে এসেছে। এতে করে মানুষের সব মৌলিক সমস্যার সমাধান হয়েছে তা যেমন নয়, তেমনি পুঁজিবাদী শোষণ থেকে মানুষের মুক্তি ঘটেছে তাও নয়। বিশ্বব্যাপী ক্রমাগত বাড়ছে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান। তাহলে, কেন এমনটি ঘটল? মার্ক্স বাদের ব্যর্থতা কোথায়? এসব জ্বলন্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে আমাদের আবারও মার্ক্সবাদের কাছেই ফিরে যেতে হবে বলে ‘কেন পুনরায় মার্ক্স’ গ্রন্থের লেখক মনে করছেন। কারণ লেখকের ভাষ্যে, “ম্যাক্সিয় তত্ত্বের মূল কাঠামো আজও তার জায়গায় অমলিন। প্রথমত, উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব এবং মুনাফা সংক্রান্ত মার্ক্সীয় তত্ত্বের গায়ে আজও কোন আঁচড় পড়েনি-তার আভ্যন্তরীণ যৌক্তিকতার ওপর সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় ১৫০ বছর আগে পুঁজিবাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করে মার্ক্স বলেছিলেনঃ প্রতিটি দেশে বুর্জোয়া শ্রেণীর মূল লক্ষ্য বিশ্ববাজারের শোষণ। বুর্জোয়া শ্রেণি উৎপাদন ও পণ্য ভোগকে সার্বজনীন করে গড়ে তুলতে চায়। অতীতে উৎপাদন যে ধরনের সনাতনী চাহিদা পূরণ করত, তার বদলে নতুন চাহিদা সৃষ্টি করা পুঁজিবাদের প্রকৃতির মধ্যে রয়ে গেছে। স্বনির্ভরতা এবং দেশীয় বিচ্ছিন্নতার জায়গায় নানা ধরনের লেনদেন ও বিশ্বজনীন পারস্পরিক নির্ভরশীলতা লক্ষ্য করছি” (পৃষ্ঠা ২৮০)।

লেখক এটাও মনে করছেন যে মার্ক্সবাদ এমন কোন প্রত্যয় নয় যে তা অপরিবর্তনশীল। কোন তত্ত্বই সমাজ বিকাশের চূড়ান্ত বিন্দু বলে নির্ণীত হতে পারে না। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথেই তা পরিবর্তনশীল। তার সংযোজন-বিয়োজন ঘটতে পারে। বর্তমানের বৈষম্যমূলক এই বিশ্বে তা নিয়ে আরো আলোচনা ও বিস্তৃত গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

এ তো গেল মার্ক্সবাদের মূল প্রত্যয় নিয়ে লেখকের ভাবনার কথা। কিন্তু এ গ্রন্থের সবচেয়ে বড় আরেকটি দিক হল ব্যক্তি মার্ক্সের প্রতিদিনের জীবনের কথা। রক্ত মাংসের মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন মার্ক্স। কেমন ছিল পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা বা বন্ধুদের সঙ্গে তার আচরণ। কেমন ছিল তার জীবন ধর্ম ও সংসার। কিভাবে তিনি নির্বাহ করেছেন সংসারের ব্যয়। তা যে কোন ভাবেই আমার আপনার মত সাধারণের জীবনের বাইরে ছিল না, ধার-দেনা, দুর্দিনের আশঙ্কা সহ নানা বৈপরিত্যের ভেতরে কেটেছে মার্ক্সের প্রতিদিনকার জীবন যাঙ গ্রন্থের মূল আকর্ষণের দিক বলে মনে হয়। খুঁটিনাটি এসব জানতে ও একজন তাত্ত্বিক মার্ক্সের আড়ালে ব্যক্তি মার্ক্স কে আবিষ্কার করতে এ বইটি পড়া তাই অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছি।

প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত লেখকের পূর্ববর্তী আরেকটি বই ‘সোভিয়েত রাশিয়া ভাঙল কেন’ যারা ইতিমধ্যে পড়েছেন তারা নিশ্চিত ভাবেই এ বইটি পড়েও হতাশ হবেন না বলে বিশ্বাস রাখছি। এ গ্রন্থটির ভাষাও ঝরঝরে, সাবলীল। একজন মানুষ মার্ক্স ও তার অভূতপূর্ব মেধা কিভাবে তার ভেতরে একজন দার্শনিক মার্ক্স এর জন্ম দিয়েছে তা এ বইটি না পড়লে বোঝা কঠিন। বরাবরের মতই এ বইটি লিখতে লেখক বদরুল আলম খান যে পরিমাণ পরিশ্রম করেছেন তা না বললে ও তার প্রশংসা না করলে অন্যায় হবে বলে বোধ করছি। তাঁকে অভিনন্দন এমন একটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থ উপহার দেওয়ার জন্য।




রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
Jsfn21@gmail.com




Share on Facebook               Home Page             Published on: 17-Apr-2023

Coming Events:


*** মেলার তারিখ ১১ মে থেকে পিছিয়ে ১ জুন করা হয়েছে ***



Lakemba Blacktown Money raised so far



Blacktown Money raised so far