bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













“যেমন-তেমন-এমন”, কেমন বন্ধু চাই!
রিয়াজ হক



সত্তুর দশকের শুরু। আমরা তখন ঢাকার ধানমন্ডি সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী বা নবম শ্রেণীতে পড়ি। আমাদের ইংরেজি পড়াতেন শরীফ স্যার। শরীফ স্যার এর আগে গভ; ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে ছিলেন। সম্প্রতি তিনি বদলি হয়ে আমাদের স্কুলে এসেছেন। তখনকার ল্যাবরেটরি স্কুল ছিল যে কোন বিচারে ঢাকার বা সারা বাংলাদেশের (মানে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের/বাংলাদেশের ষাট-সত্তুর দশকের) একটি সেরা স্কুল। শরীফ স্যার বলতেন না, এমন কোন বিষয় তাঁর নিজের সিলেবাসে ছিল না। তার কথায় ছিল না কোন রাখঢাক। বলতেন সরাসরি। খোলাখুলি। চোখের উপর চোখ রেখে।। হাস্যরসে ভিজিয়ে ভিজিয়ে। যদিও বেশীর ভাগ সময় আমরা লজ্জায় আমাদের চোখ মেঝের দিকেই নামিয়ে রাখতাম। বিশেষ করে যখন স্যার বলতেন নর-নারীর গোপন জীবনাচরণের কথা। যা শোনার জন্য ওই বয়সে আমাদের আকুতি ছিল আদমের নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণের মতই স্বাদের ও সুখের। তাতে স্বর্গ থেকে আজীবন বিতারণও তথাস্তু!

আমাদের বয়স তখন তের থেকে পনেরর মধ্যে। বাংলায় যাকে বলে বয়স সন্ধি কাল, ইংরেজিতে Adolescence Period. এ এমন একটা বয়স যখন বেশ দ্রুতই শরীরের বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। ক্ষুধা বাড়তে থাকে। শরীর ও মনের অনিয়ন্ত্রিত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। জীবন-জগত, রহস্যের সব গভীর উন্মোচন নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। নানা প্রশ্ন, কৌতূহল আর জিজ্ঞাসা ছোট্ট এই জীবনকে নানা দিক থেকে অস্থির ও উদভ্রান্ত করে তুলে। রবীন্দ্রনাথ যাকে “বালাই” বলে উল্লেখ করেছেন তার বিখ্যাত “ছুটি” গল্পে।

নতুন আগত শরীফ স্যারই প্রথম আমাদেরকে জানান দিলেন যে আমরা এখন “এডাল্ট” হওয়ার পাসপোর্ট পাওয়ার অপেক্ষায়। কোন মেয়ের দিকে আড় চোখে তাকানো বা তার শরীরের সৌন্দর্য লক্ষ্য করা বা তাতে মুগ্ধ হওয়া দোষের কিছু নয় বরং একেবারে স্বাভাবিক। আমাদের উচাটন মন আউলা বাতাসে আরো আউলা করে ছেঁড়ে দিলেন আর কি ! ভো কাট্টা ঘুড়ির মতই বাউল বাতাসে ভেসে চলা সে জীবন। ঠিক এমনি সময়েই আমাদের ক্লাসের, লজ্জাহীন দাঁড়ি-গোঁফের সরব উপস্থিতিতে সবচেয়ে পরিণত যে সেই ইকবাল দিল নিষিদ্ধ পানীয়ের সন্ধান। হাতে তুলে দিল “তিন যু......... গোপন কথা”।


মনে পড়ে, অনেক আগে পড়েছিলাম একটি Best Friend Jokes:
“Just remember, if we get caught, you are deaf and I don”t speak English”. বন্ধু ছাড়া কে পারে এভাবে দু”জনের স্বার্থই রক্ষা করতে!

শরীফ স্যার অনেক কথার মধ্যে বন্ধু সম্পর্কে একটি বাক্য বলেছিলেন তা বলার জন্যই আসলে আজ স্যার কে স্মরণ। আর তা হল, “Friendless life is the sun less universe”. অর্থাৎ বন্ধুহীন জগৎ সূর্য হীন জগতের তুল্য।

বন্ধু হল সে যে তোমার অতীত জানে। অনাগত ভবিষ্যতের উপর বাজী রাখে। আর বর্তমান কে আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ভাল বন্ধু পাওয়া তাই যেমন কষ্টকর, ত্যাগ করা তেমনি দুঃসহ, ভোলা অসম্ভব।

কাহলিল জীবরান (Kahlil Gibran; জীবন কালঃ ১৮৮৩-১৯৩১ খৃষ্টাব্দ। একজন নামকরা লেবানীজ-আমেরিকান লেখক, কবি ও দার্শনিক। “The Prophet” তার একটি পৃথিবী বিখ্যাত বই। ) তিনি বন্ধুত্বকে বলেছেন সকালের শিশির বিন্দুর মুক্তো ঝরানো সেই হাসির মত যা দেখে হৃদয় সতেজ ও প্রসন্ন হয়।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায়ঃ
“শুনলে কথা কান জ্বলে যায়
হাসলে পেটের খিল খুলে যায়
থাকলে এরা মন ভরে যায়
আমার কিছু বন্ধু আছে।।”

“Nicomachean Ethics”, অনুযায়ী পৃথিবী খ্যাত দার্শনিক এরিস্টটল (জীবন কাল ৩৮৫-৩২৫ খৃষ্টপূর্ব। এরিস্টটল প্রাচীন গ্রীসের শিল্প-সাহিত্যের স্বর্ণ যুগের একজন মহান জ্ঞানী ও দার্শনিক ছিলেন। তিনি সে সময়ের আরেক বিশ্বখ্যাত দার্শনিক প্লেটোর ছাত্র ছিলেন। তিনি শিক্ষা, বিজ্ঞান, দর্শন, বিষয় আলোচনা, বক্তৃতা ও সঙ্গীত শিক্ষার প্রতিষ্ঠান লাইসিয়াম (Lyceum) এর প্রতিষ্ঠাতা) বন্ধুত্বকে তিন ভাগে ভাগ করেছেনঃ

এক। নিছক আনন্দের সঙ্গীঃ হাতে পাওয়া বাড়তি সময় কাটানো, বিশেষ কোন খেলা ও সখ (ভ্রমণ, মাছ ধরা, সাঁতার কাটা প্রভৃতি) মেটানো, কোন পার্টি, কনসার্ট বা মেলায় ঘুরে বেড়ানো মানুষের যে সঙ্গ সে ধরনের বন্ধুত্ব। নিছক আনন্দের জন্য।

দুই। সৌজন্য ও সুবিধার বন্ধুত্বঃ কাজের ক্ষেত্রের সহকর্মী, প্রতিবেশীর সঙ্গে যে বন্ধুত্ব। তা হতে পারে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, সমাজে , গোত্রে বা রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে।

তিন। প্রকৃত বা খাটি বন্ধুত্বঃ যে বন্ধুত্ব আয়নার মত; যাতে প্রতিবিম্বিত একই ছবি (Mirror to each other). এরিস্টটল যাকে বলেছেন, “a single soul dwelling in two bodies”. অর্থাৎ এক আত্মার ভেতরে দুই দেহ। বা দুই দেহ নিয়ে এক আত্মা।

খৃষ্ট পূর্ব যুগের প্রথিতযশা চৈনিক দার্শনিক ও শিক্ষক কনফুসিয়াস (৫৫১-৪৭৯ খৃষ্ট পূর্ব) বন্ধুত্ব প্রসঙ্গে বলেছেন, “সমতা ও সম মর্যাদা বন্ধুত্বের পূর্ব শর্ত”। তার মতে, বন্ধু হল সে যে তোমাকে সব কাজে শুধু সমর্থনই দিবে না প্রয়োজনে সতর্কও করবে। বন্ধু হবে নির্ভরতার প্রতীক যেমন তীব্র শীতের দুঃসময়েও পাইন ও সিপরিস গাছের পাতা থাকে মোহনীয় সবুজ।

জীবনের দুর্ভোগ ও কষ্টে নির্ভরতা ও আশ্রয় হল খাঁটি বন্ধুর হৃদয়। যে ডানে-বাঁয়ে সামনে-পেছনে না তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিবে বন্ধুর দুর্দশায়। অনেক আগে কোথায় যেন পড়েছিলামঃ
“Friends pick us up when we fall, and if they can”t pick us up, they lie down and listen for a while”. অর্থাৎ যখন আমরা বিপর্যস্ত হই বন্ধুরা এসে আমাদের উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে। যদি সাহায্য করতে নাও পারে অন্তত সময় নিয়ে আমাদের কথা শুনে ও সহমর্মী হয়।

যাকে অনন্য দার্শনিকতায় বিশেষায়িত করেছেন আলবেয়ার ক্যামু (Albert Camus: জীবন কালঃ ১৯১৩-১৯৬০ খৃষ্টাব্দ। একজন পৃথিবী খ্যাত ফরাসী দার্শনিক, সাংবাদিক ও লেখক। ১৯৫৭ সালে মাত্র চুয়াল্লিশ বছর বয়সে পৃথিবীর দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম ব্যক্তি হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন।)
“Don”t walk in front of me; I may not follow. Don”t walk behind me; I may not lead. Just walk beside me and be my friend.” অর্থাৎ আমার সামনে থেকো না কারণ আমি হয়ত তোমাকে অনুসরণ করতে পারব না। আমার পেছনে থেকো না কারণ আমি হয়ত তোমাকে নেতৃত্ব দিতে পারব না। আমার পাশে থাকো প্রকৃত বন্ধুর মত।

আরো ভাল করে বললে, বন্ধু কখনও নেতা বা সাগরেদ নয়। বন্ধু তার অবস্থান ও পরিচয়ে সবসময়ের সহযাত্রী। তাই দেখবেন অনেক বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায় যখন বন্ধুদের মাঝে কেউ সহ-যাত্রীর ভূমিকা বাদ দিয়ে নিজেকে নেতা বা অন্যকে শিষ্য বানানোর অর্বাচীন চেষ্টায় মেতে উঠে।

বন্ধু হচ্ছে সেই যে অক্টোপাসের মত জড়িয়ে থাকে আষ্টেপৃষ্ঠে। কি ভালো-তে, কি মন্দ-তে। যে নিজের আগে দেখে বন্ধুর স্বার্থ। যাকে প্রয়াত কবি আবুল হাসান বলেছেনঃ
“........যে আমার ফুসফুস থেকে ভাগ করে নেবে দূষিত বাতাস।”

রবীন্দ্রনাথ তার “বন্ধুত্ব ও ভালবাসা” প্রবন্ধে বলেছেনঃ
“বন্ধুত্ব আটপৌরে, ভালবাসা পোশাকি। বন্ধুত্বের আটপৌরে কাপড়ের দুই-এক জায়গায় ছেঁড়া থাকিলেও চলে, ঈষৎ ময়লা হইলেও হানি নাই, হাঁটুর নীচে না পৌঁছিলেও পরিতে বারণ নাই। গায়ে দিয়া আরাম পাইলেই হইল। কিন্তু ভালবাসার পোশাক একটু ছেঁড়া থাকিবে না, ময়লা হইবে না, পরিপাটি হইবে। বন্ধুত্ব নাড়াচাড়া টানাছেঁড়া তোলপাড় সয়, কিন্তু ভালবাসা তাহা সয় না……………বন্ধুত্ব বলিতে তিনটি পদার্থ বুঝায়। দুই জন ব্যক্তি ও একটি জগৎ। অর্থাৎ দুই জনে সহযোগী হইয়া জগতের কাজ সম্পন্ন করা। আর, প্রেম বলিলে দুই জন ব্যক্তি মাত্র বুঝায়, আর জগৎ নাই। দুই জনেই দুই জনের জগৎ। অতএব বন্ধুত্ব অর্থে দুই এবং তিন, প্রেম অর্থে এক এবং দুই।”

অসংখ্য পথে তৈরি হতে পারে বন্ধুত্ব। তবে বন্ধুত্ব কখনোই সংখ্যায় নয়, হিসাব হয় এর গুনগত মানে। ভাল ও প্রকৃত বন্ধু তাই আঙ্গুলে গোনা যায়। ভাল বন্ধুত্বের লক্ষ্য ও গন্তব্য একটাই নিঃশর্ত গ্রহণ ও সমর্থন। “যে আমারে দেখিবারে পায় ভাল-মন্দ মিলায়ে সকলি.........”। সাথে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। এ জন্যই মহান জ্ঞানী সক্রেটিস বলেছেন, “Be slow to fall into friendship; but when thou art in, continue firm and constant.” অর্থাৎ, তাড়াহুড়া নয়, দেখে শুনে সময় নিয়ে বন্ধুত্ব গড়ে তোল। আর একবার তা গড়ে উঠলে শক্ত রশির মত তাকে ধরে রাখ।

কঠোর কঠিন বাস্তবতার এই দুনিয়াতে একটি উর্দু শায়েরিতে বন্ধুত্ব এসেছে অনেকটা এই ভাবে (খুব কাছাকাছি একটা বাংলা ভাবার্থ করলাম) :
“তোমার অসুস্থতার দাওয়াই খুঁজছ ?
যাও তোমার পুরনো বন্ধুদের কাছে।
ওরা মুহূর্তে উড়িয়ে নিয়ে যাবে তোমার বয়সের চাঁদর।
ওদের গল্পে, হাসিতে, খুশীতে।
ওরা মনে করিয়ে দেবে তোমার শৈশব, কৈশোর আর যৌবন।
তোমার সব বেয়াকুফি, তোমার গৌরব আর আনন্দ নেচে উঠবে ওদের হুল্লোড়ে।

দ্যাখো, ছেলেমেয়েরা তোমার সম্পদের দিকে তাকিয়ে
আত্মীয়েরা তোমার পদমর্যাদা আর বিত্তের দিকে তাকিয়ে
অন্যদিকে বন্ধুরা?
ওরা তোমার নির্মল সঙ্গ ও নিষ্কলুষ ভালোবাসার দিকে তাকিয়ে।”

A good friend can finish your sentences… a best friend will do the same, but make it sound 10 times dirtier (হাহ-হাহ-হা)।





রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া, Jsfn21@gmail.com






Share on Facebook               Home Page             Published on: 3-Sep-2020

Coming Events: