আপনি কার জীবন যাপন করছেন! (গল্প ১) রিয়াজ হক
(To be yourself in a world that is constantly trying to make you something else is the greatest accomplishment (Ralph Waldo Emerson)
‘এ কোন জীবন আমি বেঁছে নিলাম প্রভু’। ‘এমন জীবন আমি চাই নি’। ‘ও আমার জীবনটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। আমার নিজের বলে আর কিছু নেই।‘ ‘তুমি আমাকে আর কত নিয়ন্ত্রণ করবে?’ ‘এ শহর ছেড়ে তুই পালা শিশির’।
প্রতিদিনের জীবন থেকে তুলে আনা এ বোধ ও উচ্চারণই বলে দেয় যে আমাদের জীবন কোন না কোন নিয়ন্ত্রণের বেড়াজালে বন্দী। যাদের নিয়ে আমরা চলাফেরা করি, সঙ্গী হই, সঙ্গ দেই বা দূর থেকে শুভেচ্ছা রাখি, দেখি, ভালো করে লক্ষ্য করলে বুঝবেন এদের অনেকেই তার নিজের জীবনের চালকের আসনে নেই। তার আসন অধিকার করে নিয়েছে তার কোন বন্ধু, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী, মা, বাবা, অভিভাবক, ধর্মীয়-রাজনৈতিক গুরু, সোশাল মিডিয়া বা অন্য কেউ, অন্য কিছু! ফলে সঙ্গত ভাবেই বলা যায় যে এই বহু আমরা আর আমাদের নিজের জীবন যাপন করছি না। আমরা যাপন করছি অন্য ব্যক্তি, বিষয়, আদর্শ বা মাধ্যমের জীবন। ফলে আমাদের সমাজে সৃজনশীল মৌলিক মানুষের বড় অভাব। সব অতি সাধারণ মামুলি মানুষে ভরা! এরকম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নানা মানুষের গল্প বলব বলেই এ লেখা।
মামি’স বয়! এ ছেলেটি একসময় এই সিডনি শহরেই ছিল। এখন আর নেই। দেশ থেকে পড়তে এসেছিল। আশা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে ‘পি আর’ নিয়ে এ দেশেই থেকে যাবে। মা-বাবার ইচ্ছেও ছিল তাই। শুরুতে তাকে নানা স্ট্রাগলের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, যা খুবই কমন। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে অর্থনৈতিক ভাবে টিকে থাকতে তাকে যেমন কাজের যোগার করতে ও রাতবিরেতে কাজ করে পড়াশুনা চালাতে হিমসিম খেতে হয়েছে তেমনি কোথায় থাকবে, আশেপাশের কাকে বিশ্বাস করবে, কাকে করবে না, কার সাথে মিশবে বা মিশবে না এসব নিয়েও নিরন্তর বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এসব বিভ্রান্তির অনেক কিছুর জন্যই দায়ী তার জন্মদাত্রী মা। মায়ের উপর তার প্রশ্নহীন অতি নির্ভরতা তাকে এখানের বাস্তবতার স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ করে ফেলেছিল।
তার মা’র সাথে তার কথা হত প্রায় প্রতিদিন। হয় সে ফোন করত নয়ত তার মা। সে আমাকে নিজেই বলেছিল যে প্রতিদিন তার কণ্ঠ না শুনতে পেলে তার মা অস্থির হয়ে যেত। কখন কোথায় খাবে, কি রান্না করবে দেশ থেকে যেমন তার ইন্সট্রাকশন আসত, তেমনি বাজার থেকে কি কিনবে বা কিনবে না, সিডনিতে কার সাথে যোগাযোগ রাখবে বা রাখবে না তারও নির্দেশ আসত সুদূরের বাংলাদেশ থেকেই।
ঐ ছেলের মায়ের তরফের আত্মীয়, সিডনিতে বসবাসকারী এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে তাকে একবার আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে সে তাদের সাথে যোগাযোগ করে কিনা বা তাদের বাসায় যায় কিনা। সে জবাব দিয়েছিল, “না, তার মা’র বারণ আছে”। যদিও উচিত ছিল না তবুও কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে তাকে আমি এর কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলাম। উত্তর শুনে আমার হতভম্ব হওয়ার যোগার। ঐ ভদ্রলোকের এক কন্যা তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ত তাই তার সঙ্গে পরিচয় ও মেলামেশার সম্ভাবনা এড়াতে তার ওই বাসায় যাওয়া নিষেধ ছিল। অথচ ঐ ভদ্রলোককে আমি অত্যন্ত সজ্জন ও তার শুভার্থী বলেই জানতাম!
একসময় লক্ষ্য করলাম দেশ থেকে আসা সবল স্বাস্থ্যবান এই তরুণ বেশ কিছুটা ওজন হারিয়েছে মনের দিক থেকে খানিকটা অস্থির হয়ে উঠেছে। কারণ খুঁজে দেখলাম যে সে প্রায়শই রাত জেগে কাজ করছে। দিন দিন বেশি টাকা রোজগারের আকাঙ্ক্ষা তার ভেতরে প্রবল হয়ে উঠছে। কথা প্রসঙ্গে জানাল যে দেশে ফেলে আসা দুই বোন ও এক ছোট ভাইয়ের জন্য সে নানা উপহার কিনে পাঠাচ্ছে। এতে নাকি সবাই খুশি। বিশেষ করে তার মা। বুঝলাম সে এদের কাছে যেভাবে প্রিয় ও মূল্যবান হয়ে উঠছে তা দারুণ উপভোগ করছে। পড়া লেখার চেয়ে তাই তার কাছে টাকা রোজগার প্রাধান্য পাচ্ছে তা নিজের শরীরের ক্ষতি করে হলেও!
অনেক দিন তার কোন খবর নেই। হঠাৎ একদিন মেসেজ পেলাম যে সে অসুস্থ হয়ে দু’দিন হাসপাতালে ছিল, এখন বাসায় ফিরেছে যেখানে সে বন্ধুদের সঙ্গে মেস করে থাকত। তার পেটে ব্যথা তথা গ্যাস্ট্রিক-আলসারের সমস্যা হয়েছিল বলে তাকে বাধ্য হয়ে হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। কারণ অনুসন্ধান করে জানলাম যে রান্না করার অনাগ্রহে প্রায়ই না খেয়ে বা অনিয়মিত খেয়ে তার আজকের এই অবস্থা। কেন সে বাইরে থেকে রেডিমেড খাবার কিনে খায়নি প্রশ্ন করাতে সে জানাল যে তার মা বাইরের কেনা খাবার খেতে নিষেধ করেছে তাই খায়নি।
বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখতে যাবে, মায়ের পারমিশন পাচ্ছে না; উইক-এন্ডে বেড়াতে যাবে, সমুদ্রের পানিতে গোসল করবে, ঠাণ্ডা লেগে শরীর খারাপ করবে বলে মা সাবধান করে দিচ্ছে ফলে আর যাওয়া হচ্ছে না। এভাবে নানা ‘না’ এর বৃত্তে বন্দী হয়ে গিয়েছিল তার জীবন। এসব ক্ষেত্রে যা হয় আর কি, পোষ মানা পাখির মত, খাঁচায় বন্দী, শৃঙ্খলিত জীবন জানে না শৃঙ্খলমুক্ত স্বাধীন জীবনটা কেমন! ফলে একসময় সে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে ঐ শৃঙ্খলিত জীবনেই!
জীবন নানা অভিজ্ঞতার ফসল। জীবনকে কণায় কণায় নানা ঘাটে ছড়িয়ে দিয়ে তাকে কানায় কানায় ভরে তুলতে হয়। অভিজ্ঞতার আকাশটাকে বড় করতে হয় যেন যে কোন পরিস্থিতিতে হাত বাড়ালেই তা মোকাবেলার পাথেয় নাগালের মধ্যে পাওয়া যায়। এটা কোন বই, আদেশ-উপদেশ আপনাকে শেখাতে পারবে না, এটা আপনি পাবেন বাস্তব জীবনে নানা ইন্টার্যােকশনের মাধ্যমে। অন্য জীবন ও প্রকৃতিই আপনাকে তা শেখাবে। এখান থেকে আপনি নিজেকে যত আড়ালে নিয়ে যাবেন জীবন কে তত অসহায়, ন্যুব্জ ও দুর্বল করে ফেলবেন। হচ্ছিলও তাই।
যা হোক মুল গল্পে ফিরে আসি। ইতিমধ্যে চার বছর পার হয়ে গেছে। ছেলেটির গ্রাজুয়েশন হয়ে গেছে। বাবা-মা ও সে মিলে যতটুকু আশা করেছিল ফলাফল সে রকম ভাল কিছু হয় নাই। তবুও স্বস্তি যে তার কোর্স কমপ্লিট হয়েছে। সে জানাল যে ‘পি আর’ এর জন্য এপ্লাই করবে, কাজ খুঁজছে। কিন্তু এর মধ্যে মা তলব করেছে যে তাকে দেশে যেতে হবে, খুব ভাল একটি মেয়ে উনি ঠিক করেছেন, তাকে বিয়ে করতে হবে।
এসময় যে বিয়ে করা ঠিক হবে না, সামনে যে তার আরো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে, বিয়ে করলেও যে মেয়েটিকে এখনই নিয়ে আসতে পারবে না এসব নানা কথা বলেও সে মাকে বোঝাতে পারে নি। তার মায়ের একটিই ভয়, ছেলে না আবার কোন বিদেশীকে বিয়ে করে ফেলে! কোন আন্টি নাকি বলেছে এখনই ছেলেকে বিয়ে দিতে না পারলে এ ছেলে আপনি হারাবেন! সুতরাং উনি ছেলে হারাতে চান না, তাকে বিয়ে করতেই হবে।
মায়ের অতি বাধ্য সন্তান দেশে যেয়ে বিয়ে করে সপ্তাহ দু’য়েক থেকে আবার সিডনি ফিরে এর। এর মাস দুয়েক পরে একদিন জানতে পেলাম সে আবার দেশে যাচ্ছে। ঘটনা কি! যা সে বলল, তার মোদ্দা কথা হল, সে দেশ থেকে চলে আসার তিন দিনের মাথায়ই মেয়েটি সেই যে বাবার বাড়ি চলে গিয়েছে আর তাদের বাড়ীতে আসে নি এবং সবার সঙ্গে যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছে। এমন কি এও বলেছে, এ বাড়িতে আর কোন দিন সে আসবে না।
আমি বললাম, “তোমার সঙ্গে কি যোগাযোগ আছে?” সে বলল, “না, আমার সঙ্গেও মাস খানেক কোন যোগাযোগ নেই”। আমি বললাম, “কারণ কি বলে তোমার মনে হয়?” সে বলল, “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আর সে জন্যই আমি যেতে চাই। যেয়ে মুখোমুখি হয়ে বুঝতে চাই।” আমি বললাম, “তোমার মা কি বলে?” ও বলল, “মা বলছে, তিনিও কিছু বুঝতে পারছে না।”
এসবই বছর দুয়েক আগের কথা। সেই যে ছেলেটি সিডনি ছেড়ে চলে গেল, এখন পর্যন্তও সিডনিতে আর ফিরে আসে নি। এমন কি যতদূর শুনেছি মেয়েটিও ঐ বাড়িতে বা ওর জীবনে ফিরে আসে নি!
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া Jsfn21@gmail.com
|