bangla-sydney












AS A MAN THINKETH BY JAMES ALLEN
(মানুষ যেভাবে চিন্তা করে বা ভাবে)
একটি গ্রন্থের কথা

রিয়াজ হক



লেখক পরিচিতি

জেমস এলেন ১৮৬৪ সালে ইংল্যান্ডের Leicester এ জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি আত্নোন্নয়ন প্রচেষ্টার (Self help movement) একজন পুরোধা লেখক হিসেবে পরিচিত। তার বাবা ছিলেন কাপড়ের কারখানার শ্রমিক; মা কোন লেখাপড়া জানতেন না।

১৮৭৯ সালের কথা, মধ্য ইংল্যান্ডের কাপড়ের কারখানাগুলো ব্যবসা ক্ষেত্রে সফল হচ্ছিল না। তাই নিজের ও পরিবারের ভাগ্য ফেরাতে এলেনের বাবা একাই আমেরিকা পাড়ি জমান। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমেরিকা আসার মাত্র দু’দিনের মাথায় তিনি দুর্বৃত্ত কর্তৃক খুন হন।

এহেন পরিস্থিতিতে পারিবারের ব্যয় নির্বাহে মাত্র পনের বছর বয়সে এলেন কে স্কুলের পাঠ চুকিয়ে কাজে ঢুকে পড়তে হয়।

১৮৯০ এর পরবর্তী দশকে এলেন স্বশিক্ষায় নিজেকে শিক্ষিত করে তোলেন। পণ্য উৎপাদনের বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ করেন ও সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন। বিশ শতকের প্রথমে তিনি তার লেখা প্রকাশ করতে শুরু করেন। ১৯০২ সালে প্রকাশিত আজকের আলোচ্য বইটি (AS A MAN THINKETH) তার লেখা এক অসাধারণ বই। আত্নোন্নয়নের ক্ষেত্রে এটি একটি মৌলিক রচনা; বহুল পঠিত, পাঠক ও গ্রন্থ সমালোচকদের কাছে সম-আদরণীয়।

১৯১২ সালে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে তিনি মারা যান। নয় বছরে তিনি ১৯ টি গ্রন্থ রচনা করেন।


বইয়ের কথা

সাতটি ছোট ছোট অধ্যায়ে বিভক্ত মাত্র একুশ পৃষ্ঠার এই বইটি চিন্তা ও মনের বিকাশ ও বিচারের ক্ষেত্রে আপনাকে কেবল অনুপ্রাণিতই করবে না করবে সম্মোহিত।

বইয়ের ভূমিকায় এলেন বলছেন যে মানুষই হচ্ছে তার নিজ জীবনের রচয়িতা। সেই-ই তার জীবনের ভাঙা-গড়ার প্রধান শক্তি। মানুষ তার মনেরই নির্যাস। সে যেভাবে চিন্তা করে ও সিদ্ধান্ত নেয় তত বেশি সে যা চায় তাই-ই গড়তে পারে। তার জীবনের হাজারো খুশি ও হাজারো বাঁধা তার চিন্তা ও কাজেরই প্রতিফলন।


প্রথম অধ্যায় (Thought & Character বা বিচার ও চরিত্র)

এলেন বলছেন, মানুষ মনে মনে যেমনটা ভাবে ঠিক তেমনটাই হয়ে উঠে তার চরিত্র যা তার নানা চিন্তা বা বিচারের যোগফল ছাড়া আর কিছু নয় (A man literally what he thinks, his character being the complete sum of all his thoughts.)। তিনি আরো বলছেন যে চিন্তা বা বিচারকে ডানা মেলার সুযোগ দেওয়ার অর্থই কর্ম, আর সুখ বা দুঃখ হল তার ফলাফল (Acts is the blossom of thoughts and joy and suffering are its fruits.)


দ্বিতীয় অধ্যায় (Effects of thoughts on circumstances বা পরিস্থিতির উপর বিচারের প্রভাব)

এলেন বলছেন যে একজন মালী যেমন সবার আগে বাগানের মাটি খুঁড়ে তার থেকে আগাছা ও ইট পাথরের টুকরো সরিয়ে ফেলে সেখানে নিজের প্রয়োজন অনুসারে ফল বা ফুলের চাষ করে ঠিক তেমনি মানুষকেও তার মন থেকে অশুদ্ধ, খারাপ বিষয়গুলিকে সমূলে উৎপাটন করে সেই মনের বাগানটিকেও সুন্দর চিন্তার ফুলে-ফলে ভরিয়ে তুলতে হবে।

অস্তিত্বের নিয়মানুসারে প্রতিটি মানুষ তার সঠিক স্থানেই আছে অর্থাৎ যেখানে তার থাকা উচিত সে সেখানেই আছে। নিজের চিন্তা, বিচার ও সিদ্ধান্তের বলে সে যে চরিত্রের নির্মাণ করছে তাই তাকে সে স্থানে নিয়ে এসেছে। জীবনের ক্ষেত্রে আচমকা বলে কিছু হয় না, বরং সবই নিয়মের পরিণাম যাতে কখনোই ভুল হতে পারে না।

যে মানুষ সময়ের যে কোন গণ্ডীতে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মশুদ্ধির অভ্যাস করতে শিখে যায় সে ভালো করেই জানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয় তার চিন্তা, বিচার ও সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করেই। পরিস্থিতি মানুষকে তৈরি করে না, পরিস্থিতি অনুসারে মানুষ নিজের প্রকাশ ঘটায় (Circumstances does not make the man; it reveals him to himself.)। মানুষ যা চায় সেটাকে আকর্ষিত করে এমনটা নয় বরং সে যেমন ঠিক তেমন বিষয়গুলিকে আকর্ষণ করে (Man do not attract that which they want, but that which they are)।

তিনি বলছেন যে দুঃখজনক বিষয় হল মানুষ নিজের প্রতিকুল পরিস্থিতি বদলানোর চিন্তায় বিভোর ও বিচলিত হয়ে পড়ে কিন্তু কোন ভাবেই নিজেকে সংশোধনের চিন্তা করে না। তিনি আরো বলছেন যে এই পৃথিবীর প্রবল প্রকাশ হল তার ব্যবস্থায়; অবস্থায় নয়। জীবনের আত্মা হল ‘ন্যায়’, অন্যায়ের নয়। ঠিক যে রকম নিয়ম-নীতির আধ্যাত্মিক শাসনের দ্বারা এই পৃথিবী গড়ে উঠেছে মানুষকেও সে শাসনের সঙ্গে সামঞ্জস্য পূর্ণ শক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে। আর সে শক্তি হল ন্যায় ও সততা; অন্যায় ও অসততা নয়।


তৃতীয় অধ্যায় (Effects of thought on health and body বা শরীর ও স্বাস্থ্যের উপর চিন্তা বা বিচারের প্রভাব)

শরীর মনের সেবক (The body is the servant of the mind)। মন যদি কলুষিত হয় তবে শরীরও কলুষিত হয়ে যাবে। আর তার থেকে আপনি পাবেন কলুষময় এক নিরানন্দ জীবন। চিন্তা, বিচার, সিদ্ধান্ত, কাজ হল জীবনাচরণের ঝর্ণাধারা। এ ঝর্ণাধারাকে পবিত্র রাখতে পারলে সবকিছুই পবিত্র হয়ে যাবে।
শরীরের অসুখ দূর করার জন্য প্রসন্নতাপূর্ন চিন্তা বা বিচারের চেয়ে বড় ডাক্তার আর কেউ নেই (There is no physician like cheerful thought for dissipating the ills of the body.)।


চতুর্থ অধ্যায় (Thought & Purpose বা বিচার ও উদ্দেশ্য)

মানুষকে নিজের হৃদয়ে কোন ন্যায়সঙ্গত উদ্দেশ্য ধারণ করতে হবে আর তা সার্থক করে তোলার জন্য কৃতসংকল্প হতে হবে। এই উদ্দেশ্য যেন তার ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে।

আপনার মন যদি একবার বলে দেয়, ‘হ্যাঁ, আমি এই কাজটা করতে পারব’ তাহলে সমস্ত শক্তি আপনার মধ্যে নিজের থেকেই চলে আসবে। সন্দেহ আর ভয় এই জ্ঞানের বড় শত্রু। যে মানুষ তাকে বধ করতে জানে না , যে সে ভয়কে আরো চেপে বসার প্রশ্রয় দেয় সে প্রতি পদক্ষেপে অসফলতার মুখ দেখে। অর্থাৎ জীবনের সব কাজে পজিটিভ আটিচিউড নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। বাঁধা বিঘ্নকে অতিক্রম করতে হবে সাহস ও ধৈর্যের সাথে।


পঞ্চম অধ্যায় (The thought-factor in achievement বা উপলব্ধির সাথে চিন্তা বা বিচারের সম্পর্ক)

মানুষ যা পায় বা পেতে অসফল থেকে যায় সোজা কথায় তা তার চিন্তা বা বিচারের পরিণাম ছাড়া আর কিছু নয় (All that a man achieves and all that he fails to achieve is the direct result of his own thoughts)।

এলেনের মতে মানুষের দুর্বলতা ও শক্তি, পবিত্রতা ও অপবিত্রতা সম্পূর্ণরূপে তার নিজের উপর নির্ভর করে। অন্য কারো উপর সে দায় চাপিয়ে দেওয়া যায় না। মানুষ তার নিজের চিন্তা ভাবনা, বিচার ও সিদ্ধান্তগুলিকে পর্যালোচনা করে সঠিক পথ নির্ধারণ করেই উঁচুতে উঠতে ও জয়ী হতে পারে। যদি সে নিজের বিচার বিবেচনা বোধ কে উন্নত করতে না চায় তাহলে সারা জীবন দুর্বল, দুঃখী ও অন্যের দয়ার পাত্র হিসেবেই থেকে যাবে।

প্রকৃত জ্ঞানের সন্ধানে আমাদের মধ্যে বিচার বোধের জাগরণ ঘটে। মূলত জীবন ও প্রকৃতির মধ্যে যে সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে তা খুঁজে বের করার জন্য যে সত্যের কাছে মানুষ নিজেকে সমর্পণ করে তাইই মানুষের মধ্যে প্রকৃত জ্ঞানের জন্ম দেয় যার থেকে মানুষের মধ্যে বোধোদয় ঘটে।

যে কোন ধরনের প্রাপ্তি আপনার চেষ্টার ফলাফল, আপনার চিন্তা বা বিচারের পরিণাম। যে ব্যক্তি কম কিছু অর্জন করতে চায় তার ত্যাগও কম করতে হয়। যে ব্যক্তি বেশি কিছু পেতে চায় তার ত্যাগও বেশি করতে হয়। যার মনে উচ্চতম লাভের আকাঙ্ক্ষা থাকে তাকে মহান ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।


ষষ্ঠ অধ্যায় (Visions & Ideals বা পরিকল্পনা ও আদর্শ)

স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষেরা এই বিশ্বকে উদ্ধারের কাজ করে থাকে। লেখক, দার্শনিক, চিত্রকর, কবি, সাধু-সন্ত, মুনিঋষি সকলেই পরলোকের সৃষ্টিকর্তা তথা স্বর্গের রচয়িতা। এই ধরনের মানুষেরা এই বিশ্বে আছেন বলেই বিশ্ব এত সুন্দর। এদের ছাড়া সংঘর্ষরত এই মানবতা নষ্ট হয়ে যেত। অনেক বড় বড় প্রাপ্তিও কোন একটা সময় স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু ছিল না।

যে সমস্ত মানুষের মধ্যে কোন রকম বিচার বোধ থাকে না, যারা অজ্ঞ, অকর্মণ্য তারাই কেবল সংযোগ, সৌভাগ্য ও সুযোগের কথা বলে থাকে।


সপ্তম অধ্যায় (Serenity বা শান্তি)

বুদ্ধিমান মানুষের মধ্যে একটি বহু মূল্যবান রত্ন লুকানো থাকে যার নাম প্রশান্তি (Calmness of mind is one of the beautiful jewels of wisdom)। মানুষ ভেতর থেকে যত শান্ত হয়ে যাবে, ভালো কোন কাজে তার সফলতা, প্রভাব ও শক্তি ততই বৃদ্ধি পাবে।

শান্ত ও প্রভাবশালী মানুষ সর্বদা সম্মান ও স্নেহের পাত্র হয়। মরুভূমিতে মরূদ্যান যেমন তৃষ্ণার্ত মানুষের পিপাসা দূর করে, প্রবল ঝড়ের মধ্যে পর্বতের গুহা যেমন মানুষকে আশ্রয় দেয় এই মানুষেরা তেমন ধরনের হয়ে থাকে।

মানুষের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু হল তার বিবেক। এই বিবেক সোনার চেয়েও মূল্যবান আর বিশুদ্ধ সোনার চেয়েও তা অনেক বেশি আকাঙ্ক্ষিত। শুধুমাত্র অর্থের পেছনে ছুটে কোন লাভ হয় না, তার চেয়ে একটি শান্তির জীবন লাভ করা অনেক জরুরী। যে জীবন সত্যের মহাসাগরে বাস করে, সমুদ্রের তুফানের মধ্যেও এমন জীবন শাশ্বত বা চির শান্তিতে থাকে।

সবশেষে এলেন বলছেন, আত্মনিয়ন্ত্রণ হল মনোবল, সঠিক চিন্তা বা বিচারের নৈপুণ্য এবং শান্তির শক্তি। নিজের হৃদয়কে বলুন, “চাই নীরবতা। চাই শান্তি। শান্ত হয়ে থাকো” (Self control is strength; right thought is mastery; calmness is power. Say unto your heart, peace, be still.)।




রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
Jsfn21@gmail.com




Share on Facebook               Home Page             Published on: 23-May-2024

Coming Events: