ব্যক্তি, সুফি সাধক ও কবি জালাল আল-দিন রুমি রিয়াজ হক
পুরো নাম জালাল আল-দিন মুহাম্মদ বাল্খি। কিন্তু সারা বিশ্বে তিনি ‘রুমি’ নামে সমধিক পরিচিত। মূল নামের পদবীতে ‘বাল্খি’ এসেছে যেহেতু তার জন্ম বর্তমানের আফগানিস্তানের অন্তর্ভুক্ত তৎকালীন খোরাসানের ‘বলখ’ শহরে, ১২০৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। আর পরবর্তী কালে তিনি ‘রুমি’ নামে পরিচিত হয়েছেন যেহেতু তার প্রায় পুরো জীবন কেটেছে তৎকালীন ‘রুম’ সাম্রাজ্যের রাজধানী কোনিয়াতে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর একজন অসম্ভব প্রতিভাবান ফার্সি কবি ও শিক্ষক হিসেবে সারা বিশ্বে তিনি তার পরিচিতি ও শিল্প সৃষ্টির স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তার রচিত দু’টি বিশ্বখ্যাত গ্রন্থ হলো মসনভী (Masnavi-yi Ma’navi) ও দিওয়ান-ই-শামস (Divan-e Shams)। পরিসরের বিবেচনায় তার রচনা হোমার (খৃষ্ট পূর্ব ৮ম শতক) রচিত প্রাচীন গ্রীক মহাকাব্য ‘ওডিসি’র তুলনায় প্রায় চার গুন দীর্ঘ। কেবল দৈর্ঘ্যেই নয়, বিষয় ও কাব্যের ঐন্দ্রজালিক সুষমায় তা যুগকে অতিক্রম করে আজও সারা পৃথিবীতে সমান ভাবে আদৃত। আর এজন্যই আধুনিক এ যুগের অন্তত চারটি দেশ রুমিকে তাদের নিজ দেশের নাগরিক বলে দাবী করে। স্বভাবতই আফগানিস্তান, যেহেতু তার জন্ম সেখানে। উজবেকিস্থান, যেখানে কেটেছে তার শৈশবের কিছু কাল। আধুনিক তুরস্ক, যেহেতু তুরস্কের বর্তমান আনাতোলিয়ায় কেটেছে তার পুরো লেখক-শিক্ষকের জীবন। ইরান, যেহেতু মূলত ফার্সি ভাষায় রচিত তার কাব্যগ্রন্থ। যদিও প্রয়োজন মত তিনি আরবি, তুর্কী ও গ্রীক শব্দেরও আশ্রয় নিয়েছেন তার বিভিন্ন লেখায়।
তার পরিবারের ভৌগলিক অবস্থান ও ইতিহাসের বিবেচনায় একটি ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সময়ে রুমির জন্ম। তখন ইউরোপের পশ্চিমার্ধ থেকে আনাতোলিয়া পর্যন্ত সর্বত্র ক্রুসেডের ভয়াবহতা ও পূর্ব দিক থেকে ধেয়ে আসা দুর্ধর্ষ মোঙ্গল বাহিনীর বীভৎসতা চলছিল। ধরা হয়ে থাকে যে রুমির পিতা অভিযানকারী মোঙ্গলদের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য অথবা ‘সমরখান্দ’ বা ‘বলখ’ এর স্থানীয় শাসকদের সাথে মতভেদের বা বিরোধের কারণে পুরো পরিবার সহ ১২১৮ সালে তার জন্মস্থান ত্যাগ করেন। রুমির পিতা বাহা আল-দিন ওয়ালাদ একজন আধ্যাত্মবাদী ধর্মতত্ত্ববিদ ছিলেন। তিনি নিজেও একজন উচ্চ মার্গের লেখক ও শিক্ষক ছিলেন। কথিত আছে যে ‘বলখ’ ছেড়ে ইরাক হয়ে মক্কা যাওয়ার পথে তার পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে তৎকালীন পারস্যের নামকরা আধ্যাত্মবাদী কবি ফরিদ আল-দিন আতারের সাথে। তিনি মাত্র শৈশব পেরোনো রুমি কে তাঁর শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ জানিয়েছিলেন। মক্কা থেকে দামেস্ক হয়ে পুরো পরিবার ‘রুম’ এ (বর্তমান তুরস্ক) যেয়ে পৌঁছান। তখন ‘রুম’ শাসন করছিল তুরস্কের সেলজুক রাজবংশ। সে সময় ‘রুম’ ছিল শান্তি ও সমৃদ্ধির এক অন্যতম পীঠস্থান। বাহা আল-দিন তার পরিবার সহ কিছুকাল রুমের কারমানে বসবাস করে ১২২৮ সালে চলে আসেন রুমের রাজধানী কোনিয়া (Konya) তে। এখানে তিনি অন্যতম প্রধান একটি ধর্মীয় শিক্ষার স্কুলে (মাদ্রাসায়) শিক্ষকতা শুরু করেন। ইসলামিক আইন, জীবন বিধান ও সুফি আধ্যাত্মবাদে তাঁর জ্ঞান ছিল অপরিসীম। জ্ঞানী পিতার হাত ধরেই রুমির প্রাথমিক শিক্ষা জীবনের শুরু। দেশ থেকে দেশান্তরে ভ্রমণ ও রুমে স্থায়ী আবাস গড়ার আগ পর্যন্ত নানা প্রতিকুল পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে জীবন অতিবাহিত হলেও পুত্রের শিক্ষার প্রতি ছিল পিতার অখণ্ড মনোযোগ। রুমি পিতার শিক্ষা ও জীবনাদর্শের আলোকেই নিজেকে বড় করে তুলেছিলেন। পিতার কাছ থেকেই তিনি কোরান-হাদিসের অন্তর্নিহিত অর্থ, ব্যাখ্যা, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন ও সুফি তত্ত্বের উপর পাঠ নেন। জানার প্রতি প্রবল আগ্রহ, মেধা ও তীব্র স্মৃতি শক্তির কারণে অল্প সময়ের ভেতরই তিনি নিজেকে জ্ঞানের নেশায় উদগ্রীব একজন বলে প্রমাণ করতে সক্ষম হন।
রুমি তার পিতা ইচ্ছানুযায়ী ১৮ বছর বয়সে গওহর খাতুন নামক এক মহিলাকে বিয়ে করেন এবং সেই ঘরে সুলতান ওয়ালাদ ও আলাউদ্দিন চালাবি নামে দুই পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু হলে রুমি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সেখানে আমির আলিম চালাবি নামে এক পুত্রসন্তান ও মালাখি খাতুন নামে এক কন্যাসন্তান জন্মলাভ করে।
১২৩১ সালে রুমির বয়স যখন ২৪ বছর তখন তার পিতার মৃত্যু ঘটে। তৎপরবর্তী কালে শিক্ষক হিসেবে তিনি সেই স্কুলেই পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। এর এক বছর পর তার পিতার একজন প্রাক্তন ছাত্র ও শিষ্য বুরহান আল-দিন মুহাক্কিক কোনিয়াতে আসেন এবং জালাল আল-দিন কে ইরানে প্রচারিত আধ্যাত্মবাদ সম্পর্কে বিশেষ ধারনা দেন। তিনি প্রায় আট বছর রুমির সাহচার্যে ছিলেন। তার কাছ থেকে তিনি ইসলামী তরিকাহ, শরিয়াহ সম্পর্কে প্রচুর জ্ঞান লাভ করেন। ১২৪০ সালে বুরহান আল-দিন কোনিয়া ত্যাগ করেন। এমনও ধারনা করা হয় যে এই সময়ের ভেতর ভ্রমণের সূত্রে রুমির সঙ্গে সিরিয়ার আধ্যাত্মবাদীদের সাথে পরিচয় ও যোগাযোগ ঘটেছিল। এমন কি সে সময়ের বিখ্যাত সুফি কবি ও ইসলামিক ধর্মতত্ত্ববিদ ইবন আল-আরাবির (১১৬৫-১২৪০ সাল) সাথেও রুমির দেখা হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। কারণ আরাবির সৎ পুত্র সদর আল-দিন আল কুনায়ির সাথে রুমির বন্ধুত্ব ছিল ও তারা একসাথে মাদ্রাসায় শিক্ষকতায়ও যুক্ত ছিলেন।
রুমির জীবনের মোড় ফেরানো ঘটানো হল ১২৪৪ সালে যখন তার বয়স ৩৭ বছর তখন কোনিয়ার রাস্তায় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে তাবরিজের শামস আল-দিনের সাথে। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় যে শামস তাবরিজের সঙ্গে তার পরিচয় বা সাক্ষাতের দুটি ঘটনা প্রচলিত আছে।
ঘটনা একঃ রাস্তার পাশে বাজারে জীর্ণ পোশাকধারী শামস তাবরিজ রুমির পরিচয় জেনে রুমিকে জিজ্ঞাসা করলেন- হে রুমি, তোমার মতে ইমানের সংজ্ঞা কি? রুমি নানাভাবে তাকে ইমানের সংজ্ঞা দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু পাগল বেশের সেই জীর্ণ পোশাকধারী ব্যক্তি তার উত্তরে কোন ভাবেই সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি বললেন, রুমি, ইমানের সংজ্ঞা হচ্ছে, নিজেকে নিজের কাছ থেকে পৃথক করে ফেলা। তার উত্তর শুনে রুমি বিস্মিত হয়ে তাকে জানতে তার জ্ঞানের অনুরাগী হয়ে গেলেন।
ঘটনা দুইঃ জালাল আল-দিন রুমি ধর্ম তত্ত্ব, যুক্তি ও দর্শনের নানা গ্রন্থ নিয়ে প্রায়শই ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়ালেখা করতেন। এ বিষয়টি তাবরিজ লক্ষ্য করে একদিন রুমির নিকট এসে জানতে চাইলেন যে এ গ্রন্থগুলো কিসের? রুমি উত্তরে বললেন এগুলো যুক্তিবিদ্যা ও দর্শন বিষয়ক গ্রন্থাবলী। খুবই জটিল ও দুর্বোধ্য। এগুলো তার মত ছন্নছাড়া ব্যক্তির পক্ষে বোঝা অসম্ভব। তাবরিজ কোন উত্তর না দিয়ে পুস্তকগুলো এনে পাশে পানি ভর্তি চৌবাচ্চায় ফেলে দিলেন। রাগে-ক্ষোভে উত্তেজিত হয়ে রুমি বললেন, “ওহে মূর্খ! তুমি যদি জানতে এসব অমূল্য সম্পদ বিনষ্ট করে তুমি আমার কি পরিমাণ ক্ষতি সাধন করেছ তাহলে নির্বোধের মত তুমি এ কাজ করতে না।” নির্বাক তাবরিজ চৌবাচ্চা থেকে পুস্তকগুলো উঠিয়ে অবিকৃত শুষ্ক অবস্থায় রুমিকে ফেরত দেন। রুমি বিস্মিত হয়ে বলেন- এ কিভাবে সম্ভব? তাবরিজ তার উত্তরে বলেন, “এসব অলৌকিকতা তোমার বোধগম্য হওয়ার কথা নয়।” রুমি অভিভূত হন এবং কালক্রমে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এই ব্যক্তির সাথেই রুমি গভীর আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও সুফি ধ্যান সাধনায় নিয়োজিত হতেন। যার মাধ্যমে তিনি পেয়েছিলেন চরম আধ্যাত্মিকতার গভীরে বিলীন হয়ে যাওয়ার অতুলনীয় স্বাদ। রুমির সঙ্গে যখন শামস তাবরিজির পরিচয় হয় তখন তাবরিজির বয়স তেষট্টি বছর। তিনি কোন বিশেষ মতাদর্শ, গোষ্ঠী বা ঘারানার লোক ছিলেন না। শামস তাবরিজ কে তার এলাকার লোকজন স্রষ্টার খোঁজে দিশেহারা একজন আধ্যাত্মিক পুরুষ বা দরবেশ হিসেবে জানত। মূলত তিনিই রুমিকে আধ্যাত্ম জগতের গোপন রহস্যের সন্ধান দেন। যা সুফি মতবাদের ধারায় স্রষ্টা কে পাওয়ার সাধনা বলে সবাই মত দিয়েছেন। নবম ও দশম শতাব্দীতে এ ধারা ইসলামের ভেতরই জায়গা করে নেয় যেহেতু এর উৎপত্তিও ইসলাম থেকেই। এ ধারায় স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝখানের দূরত্বকে বিলীন করে একাত্ম হয়ে মিশে যাওয়ার এক অনির্বচনীয় অনুভূতিকে বোঝায়। এমন কি সুফি সাধকদের মতে মানুষের আত্মা যেহেতু এক বিশাল পরমাত্মার অংশ সেহেতু মানবতার নিরঙ্কুশ সেবার মধ্য দিয়ে তাকে পাওয়ার সাধনাও সুফি সাধনা বলে তারা ভেবে থাকেন। সংসার বিচ্ছিন্ন হয়ে স্রষ্টা রহস্যের অতি মাত্রার দূরান্ত আরাধনা নয়, এমন কি সাধারণের নিয়ম তান্ত্রিক উপাসনার শৈথিল্যেও নয়, রুমি এক্ষেত্রে নিয়েছিলেন মাঝামাঝি পথ। যা ছিল আবেগ, জ্ঞান ও বুদ্ধির মিশেলের উজ্জীবিত এক আলোকিত ধারা। শামস তাবরিজ রুমির সঙ্গে দু’বছর ছিলেন। দু’জনের সম্পর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে রুমি তার পরিবার ও স্কুলের প্রতি দায়িত্ব পালনেও অমনোযোগী হয়ে পড়েন। সেজন্য পরিবার ও বন্ধুদের চাপের মুখে ১২৪৬ সালের প্রথম দিকে তাবরিজ কোনিয়া ত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু এর ফলশ্রুতিতে রুমি এতটাই মুষড়ে পড়েন যে তার বড় সন্তান ওয়ালাদ প্ররোচিত হন সিরিয়া থেকে আবার তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে। কিন্তু বছর শেষ না হতেই তিনি আবার চিরকালের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যান। এ সম্পর্কে নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচলিত আছে। এমন কি রুমির পরিবারের সদস্য কর্তৃক তাকে হত্যা ও মরদেহ গুম করার কথাও অনেকে বলে থাকেন। আবার অনেকের মতে, সবার অজান্তে যেমন তিনি কোনিয়ায় আবির্ভূত হয়েছিলেন, তেমনি সবার অজান্তেই একদিন তিনি সম্পূর্ণ রূপে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তবে বাস্তবতা হল শামস তাবরিজের এই অন্তর্ধান রুমির মানসিক জগতে এক বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করে। তাবরিজের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত রুমি ছিলেন ধর্ম তাত্ত্বিকতায় উদ্ধত চিন্তার গোঁড়া এক মানুষ। কিন্তু তা থেকে তিনি নিজেকে রূপান্তরিত করেন আবেগ ও ভালোবাসার নদীতে সাঁতরে চলা এক অন্তর্ভেদী মানুষ রূপে। কারণ শামস আল-দিন তাবরিজ খুলে দিয়েছিলেন তার ভেতরের অনুভব, জীবন বোধ, ভালোবাসার আর্তির বন্ধ দরোজা। আর সে দরোজা খুলে বাধ ভাঙ্গা বন্যার মত কবিতা এসে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল জালাল আল-দিন রুমির জীবন, তার মৃত্যু পর্যন্ত।
আধুনিক জগতে আমরা দু’জন মানুষের সম্পর্ক কে নানা ভাবে দেখতে পারি বা নানা নামও দিতে পারি। কিন্তু তাদের মধ্যকার সম্পর্ক কে কেবল মাত্র স্বর্গীয় রহস্যের অন্তর্লিন ধারা বলেই বিবেচনা করা যেতে পারে যা উলটপালট করে দিয়ে গেছে রুমির মনোজগৎ। গভীর রহস্যের জাল ভেদ করে যেখান থেকে কেবল জেগে উঠেছে কবিতা আর কবিতা। সে কবিতা কি তার বিষয়বস্তুতে, কি তার কাব্য সুষমায়, কি তার চিন্তা ও কল্পনার অসাধারণত্বে, কি তার গল্প বলার অভিনবত্বে অম্লান হয়ে জেগে থাকে পাঠকের হৃদয়ে। তাঁর বিশ্বখ্যাত অনবদ্য সৃষ্টি: মসনভী (Masnavi-yi Ma’navi), দিওয়ান-ই-শামস (Divan-e Shams) ও ‘রুবাইয়াত’ তার প্রমাণ।
১২ বছর ধরে তিনি ছয় খণ্ডে ‘মাসনভি’ রচনার কাজ করেছেন। এটি তিনি তার প্রিয় শিষ্য হুসাম চালাবিকে উৎসর্গ করেন। ধরা হয়ে থাকে যে রুমির অন্যতম বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ মাসনভি (‘Masnavi-yi Ma’navi’) লেখায় হুসাম আল-দিনের বিশেষ প্রভাব ছিল। কারণ তিনিই রুমিকে তৎকালীন আধ্যাত্মবাদের সুফি লেখক আতা আল-দিনের অনুসরণে উপাখ্যান, উপকথা, গল্প ও প্রবাদের সন্নিবেশে মূল বক্তব্য তুলে ধরতে অনুপ্রাণিত করেন। রুমি তার উপদেশ আমলে নিয়ে পরবর্তী এক বছরে বিশ হাজারেরও অধিক শ্লোক (Couplets) রচনা করেন। যা পরে পূর্বের লেখা আরো কিছু রচনা সহ ‘মাসনভি’ নামে প্রকাশিত হয়। এখানে বয়সের প্রেক্ষিতে তেরশ শতকের সুফি মতবাদের নানা স্তরকে দেখতে পাওয়া যায়। এখানে ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় ভেদ করে উঠে এসেছে মানবতা ও মানব সিদ্ধির কথা। স্বর্গীয় বা অতীন্দ্রিয় ভালোবাসার গভীরতাকে সহজেই অনুমান করা যায় এই কাব্য গ্রন্থের কবিতা গুলো পড়লে। রূপক অর্থে সুফি দরবেশরা জীবনের লক্ষ্য হিসেবে কি বেছে নিবেন, কোন আলোকে পথ চলবেন এখানে বিশেষ ভাবে তাই বলা হয়েছে। এখানে দুইশ’র উপর গল্প আছে। এ গল্পগুলো পশুপাখি, জীবজন্তু, মানুষ সবার মুখ থেকেই এসেছে। এর প্রত্যেকটি নানা অর্থ বহন করে। মাসনভি তে কোরানের বানী বা ঘটনা প্রসঙ্গ এসেছে অন্তত দু’হাজার বার। আরবি ভাষার মাসনভির প্রকাশে রুমির নিজেই বলেছেনঃ “This is the book of Masnavi and it is the roots of the roots of the roots of the (Islamic) religion…………..and it is the illuminator of The Quran.” দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’র (চৌদ্দ হাজার পংতি বা লাইন) চেয়ে তিন গুন দীর্ঘ এই রচনা। কোরান ও আধ্যাত্মিক জীবনের অতল গভীর সমুদ্র-সম বোধের এক সৃষ্টিশীল প্রকাশ এই মাসনভি। মানব জীবনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা থেকে যে মনঃকষ্ট ও বেদনার উৎপত্তি তা প্রশমনের পথে স্রষ্টার ভালোবাসায় তার অস্তিত্বে বিলীন হয়ে যাওয়ার যে যাত্রা তাকেই রুমি তার উপলব্ধির আলোকে গল্পে-কবিতায় উপস্থাপিত করেছেন মাসনভি তে। একজন বিশ্বাসী তার বিশ্বাস ও ভালোবাসার শক্তিতে জীবনকে সব ক্ষুদ্রতা ও তুচ্ছতা থেকে মুক্ত করে স্বর্গীয় বোধের প্রাপ্তি ঘটাতে পারে বলে মনে করতেন রুমি।
পরের অংশ
|