হাসান আজিজুল হক কে যে ভাবে চিনি রিয়াজ হক
চেনার পূর্ব কথাঃ মাধ্যমিক স্কুল-পাঠ্যে বাংলা বইয়ের অন্য অনেক প্রবন্ধের মাঝে আমাদের পাঠ্য ছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কেনা’। তখন অতটা না বুঝলেও এখন বুঝি যে ‘বই কেনা’ প্রবন্ধটি আমাদের খুব প্রিয় ছিল মূলত তিনটি কারণে। (এক) গল্পের কাঠামোয় কঠিন বিষয়কে খুব সহজ করে বলার প্রবণতা। (দুই) বই নিয়ে প্রখ্যাত সব লেখকদের মজার কাহিনী। এ যেন ‘কাহিনীর ভেতরে কাহিনী’। (তিন) লেখকের অনন্য রসবোধ, পরিশীলিত রুচি ও গল্প বলে বলে পাঠককে ধরে রাখার অর্জিত ক্ষমতা।
‘বই কেনা’ প্রবন্ধের কিছু লাইন তখন আমাদের মুখস্থ ছিল। (এক) বারট্রান্ড রাসেলের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘সংসারে জ্বালা-যন্ত্রণা এড়াবার প্রধান উপায় হচ্ছে, মনের ভিতর আপন ভুবন সৃষ্টি করে নেওয়া এবং বিপদকালে তার ভিতর ডুব দেওয়া। যে যত বেশি ভুবন সৃষ্টি করতে পারে, যন্ত্রণা এড়াবার ক্ষমতা তার ততই বেশি হয়।’ (দুই) বই কিনে কেউ তো কখনো দেউলে হয় নি। (তিন) প্রকৃত মানুষ জ্ঞানের বাহন পুস্তক যোগাড় করার জন্য অকাতরে অর্থব্যয় করে। একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া।
এখন ভাবি, সৈয়দ মুজতবা আলী বেঁচে থাকলে হয়ত বলতেন, অকাতরে না হলেও বাঙালি এখন বই কেনায় মোটামুটি পয়সা ব্যয় করে ঠিকই তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বাঙালি জানেনা প্রকৃত বই কোনগুলো ! কারণ পয়সা ব্যয় করে বাঙালি যা কেনে অনেক ক্ষেত্রেই তা না বুঝে, শুনে, চলতি হাওয়ায় ভেসে, ঝোঁকের বশে !
বাংলাদেশের বাঙালি পাঠকেরা নিত্য দিনকার জীবনের দুরূহ যন্ত্রণা ভুলে স্বপ্ন-মথিত রঙিন জীবন চায়, ‘না-পাওয়া’ বা ‘পেয়েও হারানো’ সেই ‘কুসুম কুসুম প্রেমের’ অসার আবেশ চায়, প্রশ্নহীন আবেগের দুরন্ত স্রোতে ভেসে যেতে চায় আর তাই যেসব লেখকেরা তাদের পাতে তা দিতে পারেন বাঙালি তাকে নিয়েই আরামে-আমোদে-আহাল্লাদে সময় কাটাতে চায়! সে জন্যেই এ দেশে (বাংলাদেশে) সৈয়দ ওয়ালীউলাহ, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমদ সফাদের কদর নাই। থাকলে, অন্যদের আগে এরাই পাঠযোগ্য হতেন বেশি, সর্বত্র প্রচারিত হত এদেরই নাম-ধাম।
আমার সঙ্গে হাসান আজিজুল হকের (১৯৩৯-২০২১ খৃষ্টাব্দ) কখনো সাক্ষাৎ হয়নি। যেমন হয়নি গী দ্য মোপাসা (১৮৫০-১৮৯৩ খৃঃ), আন্তন চেখভ (১৮৬০-১৯০৪ খৃঃ) ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১ খৃঃ) সাথে। কিন্তু আমি তাদের প্রত্যেককেই চিনি। তারা লেখক, আমি পাঠক। তাদের সাথে লেখক-পাঠকের এক নিবিড় সম্পর্কের ভেতর আমি যেমন নিজেকে বুঝি তেমনি দেখতে পাই তাদের। আমি তাদের জীবনের প্রবাহকে চিহ্নিত করতে পারি, তাদের চিন্তার স্রোতকে ধরতে পারি, আবিষ্কার করতে পারি তাদের মন-মানস ও সময়।
ছোট গল্পের ইতিহাসে সমসাময়িক, গল্প তৈরি ও এর বাঁক বদলে চিহ্ন রেখে যাওয়া অবিস্মরণীয় উপরোক্ত তিন জন লেখকের কথা বলে হাসান আজিজুল হকের কথা বলব। তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে যে কেন হাসান আজিজুল হক স্বদেশেরই অন্য লেখকদের তুলনায় ভিন্ন জাতের ও ব্যতিক্রমী ধাঁচের গল্পকার ছিলেন।
মাত্র তেতাল্লিশ বছর বেঁচেছিলেন মোপাসা। তিনশ’র মত গল্প লিখেছেন। যেমন আমরা আজ বলি, বাংলা ছোট গল্পের রূপকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তেমনি ফরাসি সাহিত্যে্র ছোটগল্পের যাদুকর মোপাসা। সেসময়ে তিনি ছোট গল্পের একটি নতুন কাঠামো দাড় করিয়েছিলেন। ধরুন তার বিখ্যাত সেই ‘নেকলেস' গল্পের কথাই। কেরানি বাবার ঘরে জন্ম নেওয়া দুর্ভাগা, অতীব সুন্দরী, উচ্চাভিলাষী মেয়েদেরই একজন মাথিল্ডে। মুনশিয়র লোসেল মাথিল্ডের স্বামী। সেও কেরানী। এই নিয়ে মাথিল্ডের জীবনে ক্ষোভ ও হতাশার অন্ত নেই। লোক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়ে সেখানে সে বান্ধবীর কাছ থেকে হীরের নেকলেস ধার করে পার্টিতে যায়। পার্টি শেষে বাড়িতে ফেরার পর সে আবিষ্কার করে তার নেকলেসটি হারিয়ে গেছে। দশ বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে নেকলেসের মূল্য শোধের পর যখন জীবন একেবারে বিপর্যস্ত তখন জানা গেল হারিয়ে যাওয়া নেকলেসটি ছিল নকল। মোপাসা হচ্ছেন এমন একজন গল্পকার যিনি ঘটনাকে এমন একটি ক্লাইমেক্সসের দিকে নিয়ে যান যা পাঠকের চিন্তার ভীতকে নড়িয়ে দেয়। তীব্র এক শকে পাঠক বিচলিত ও অসহায় হয়ে পড়েন।
বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিৎসে (১৮৪৪-১৯০০ খৃষ্টাব্দ) তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, ‘আমি জানি না ইতিহাসের আর কোন শতাব্দী একই সঙ্গে এত সূক্ষ্ম এবং একই সঙ্গে কৌতূহলী মনোবিজ্ঞানীদের ধারণ করেছে কি না, যেমনটা করেছে সমসাময়িক কালের প্যারিস; তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন একজন তিনি - গি দ্য মোপাসা। ’
আন্তন চেখভ বেঁচে ছিলেন চুয়াল্লিশ বছর। অনুবাদের মাধ্যমে আমরা তার লেখা প্রায় দুইশত গল্প পাই। গল্প বলার ধরনের দিক থেকে মোপাসার প্রায় বিপরীত ছিলেন চেখভ। তার আঁকা চরিত্রগুলো নিরেট বাস্তবমুখী। তারা নিজেরাই নিজেদের গল্প বলে যায়। এখানে ক্লাইম্যাক্স বলে খুব একটা কিছু নেই। যা আছে তা হল আমাদের প্রতিদিনের চোখে দেখা, জীবন-যুদ্ধে অবিরত সঙ্কটে পড়া একদল মানুষ। ধরা যাক তার ‘কুকুর সঙ্গী মহিলা’ নামের গল্পটির কথা। ব্যবসায়ী গুরভ ও বিবাহিতা আন্না প্রায় প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খায় খায় অবস্থা। প্রেমের পার্থিত পরিণতির অনন্ত সম্ভাবনার আশায় তারা যখন এক হোটেলে মিলিত হয় তখনই গল্পের ইতি টানেন চেখভ। বাকিটা ছেড়ে দেন পাঠকের নিরন্তর কল্পনায়।
চেখভের ছিল অভাবনীয় রসবোধ। মোপাসা যেখানে প্রচণ্ড ধাক্কা দেন চেখভ সেখানে নির্লিপ্ত, শেষহীন এক শেষের পথে ঠেলে দেন পাঠককে। চেখভ বলতে চান, কেবল শেষটা নয়, গল্পের সবটুকু নিয়ে ভাব তুমি, জীবনটা যেমন; তার কোন কিছুই অপাংতেয় নয়। অসম্ভব মেধাবী চেখভ ছিলেন ‘জীবন যেমন, তেমন’ এর গল্পকার।
সেদিক থেকে রবীন্দ্রনাথ এক অসাধারণ প্রতিভাই বলতে হবে। তিনি প্রায় শ-খানেক গল্প লিখেছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্পকে পথ দেখিয়েছেন। তার গল্প শুধু ঘটনা বা চরিত্র নির্মাণের কুশলতায় নয় গীত-কাব্যের অনন্য রসে ভরা। কোন কোন ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের গল্প যেন এক একটি দীর্ঘ গদ্য কবিতা। যেমন ‘পোস্টমাস্টার’ বা ‘কঙ্কাল’। তবে ফর্মের দিক থেকে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ চেখভের দলের একথা বলা যায়। তারপরও তার গল্পের চরিত্রদের জীবন-দর্শন স্ব-মহিমায় অনন্য। যেমন পোস্টমাস্টার গল্পে তিনি বলছেন, “তখন পালে বাতাস পাইয়াছে, বর্ষার স্রোত খরতর বেগে বহিতেছে, গ্রাম অতিক্রম করিয়া নদীকূলের শ্মশান দেখা দিয়াছে- এবং নদীপ্রবাহে ভাসমান পথিকের উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হইল, জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার”। এরকম অন্য কারো গল্পে পাওয়া কঠিন।
হাসান আজিজুল হকঃ
নিজের জীবন সম্পর্কে একবার এক সাক্ষাৎকারে হাসান আজিজুল হক বলেছিলেন, 'আমার এই জীবনটা ভাঙা–গড়ার ভেতর দিয়েই কেটে গেল। জীবনের এই সব ভাঙা–গড়াই নানাভাবে ফিরে ফিরে এসেছে আমার গল্পে, উপন্যাসে। তাই পেছনে তাকানোর কথা যদি বলো, আমি দেখতে পাই একটি কিশোর ছুটছে, ক্রমাগত ছুটছে।'
রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় ১৯৬০ সালে কবি সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত 'সমকাল' পত্রিকায় তাঁর সাড়া জাগানো ‘শকুন’ গল্পে আমরা দেখতে পাই সেই দুর্বীনিত ছুটে চলা একদল কিশোরকে। সাথে তাকেও।
মানুষ মূলত গল্প করে তার নিজ জীবনেরই যা সে দেখে তার বাল্যে-কৈশোরে-যৌবনে-পৌঢ়ে। যা তাকে অনিমেষ আন্দোলিত করে, ভীষণ ভাবায় ও গভীর প্রশ্ন জাগায় তাকেই সে কথার সেলুলয়েডে বন্দী করে তৈরি করে গল্প। যে কোন ভাল গল্প রচয়িতাই জীবনকে আমূল খুঁড়ে জীবনের সঙ্কট-সম্ভাবনা-প্রাপ্তি কে পাঠকের বোধের কাছে তুলে ধরতে চান। কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে চান। হাসান আজিজুল হক তাঁদের মধ্যেই পড়েন।
সন্ধ্যার পর বসে থাকা, বাড়ী না ফেরা ছেলের দলের গোল হয়ে বসে গল্প করার মধ্য দিয়ে শুরু ‘শকুন’ গল্পের। এমন সময় শব্দ করে মাটিতে আছড়ে পরে ‘সমস্ত সুন্দর জিনিসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মত সেই কুৎসিত জীবটা’। শকুন। ‘নির্বাক, নিরুদ্যম, নিরুৎসাহ...... লড়াইয়ের শেষ চিহ্ন নিয়ে’ মাটি ছেঁচড়ে চলে সেই শকুন। ‘নিস্তেজ উপায়হীন শকুনি’কে তাড়া করে মজা লোটার চেষ্টায় এর পিছু ছুটছে বাউন্ডেলে ছেলের দল। এখানে একটি বাক্যের বিন্যাস দেখুন, কি শক্তিশালী তার চিত্রকল্প ও শব্দের ব্যবহার ! এক কথায় অসাধারণ ও অভাবিত। “মাতামাতি চলে, আল টপকে টপকে, উঁচু-নিচু জমির উপর দিয়ে, ক্ষত বিক্ষত মনে হয় দাগরা দাগরা ঘায়ে, শেয়াকুল আর সাঁইবালার বনে,লম্বা শুকনো ঘাসে, পগারে, শাপের নিঃশ্বাসের মত উষ্ণ ফাটা মাটির ভ্যাপসা হাওয়ায়, আঁখ আর অড়হর কাটা জমির বল্লমের মতো সূক্ষ্মাগ্র সরল গুঁড়ির আক্রমণ ও আর্তনাদে।” বালক কুলের দুরন্ত পথ চলার মতই নিঃশ্বাস-হীণ এই বাক্য। এই ছবি যারা দেখেছে বা যারা এ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে তাদের পক্ষেই কেবল সম্ভব একে ভাষার বর্ণনায় অবিকল তুলে আনা।
বিপর্যস্ত শকুনি যখন বালকদের আনন্দ-অত্যাচারে প্রায় অসাড় দেহ তখন বালকেরা কিছু দূরে, বিলের পানিতে দেখতে পায় জমিরুদ্দি আর কাজু শেখের বিধবা বোনকে। তা দেখেও না দেখার ভান করে তারা চলে যায় যার যার বাড়িতে। পরদিন দেখা যায় শকুনি মরে পড়ে আছে। তারপর লেখকের নিজের ভাষায়ঃ “দলে দলে আরো শকুনি নামছে তার পাশেই। কিন্তু শকুনি শকুনির মাংস খায় না। মরা শকুনিটার পাশে পড়ে আছে অর্ধস্ফুট একটি মানুষের শিশু। তারই লোভে আসছে শকুনির দল”।
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র শকুনি। তাকে সমার্থক হিসেবে লেখক দেখাচ্ছেন এই বলে, “সুদখোর মহাজনের চেহারার মত মনে হয় ওকে দেখলেই। নইলে মহাজনকে শকুনি বলে কেন”। এক পর্যায়ে বালক দলের শকুনির পাখা ছেড়ার মধ্য দিয়ে মহাজনী প্রথা উপড়ে ফেলারও প্রচ্ছন্ন মেসেজ দিতে চান তিনি সমাজের কাছে। অন্যদিকে অসহায় শকুনি যেমন বালক দলের কাছে পরিহাস ও করুণার পাত্র তেমনি মানুষও শকুনি-দলের কাছে যখন সে নির্জীব, মৃত। সেই শকুনির পাশে পড়ে থাকা অর্ধস্ফুট মৃত মানব শিশু যেমন।
বাংলা ছোট গল্পের অন্দরে শকুনি এক অসম্ভব শক্তিশালী গল্প। কি তার কেন্দ্রীয় চরিত্রের নির্বাচন ও চিত্রণে। কি তার মানুষ সহ প্রাণীকুলের অসহায়ত্ব বোধের দিক থেকে। কি তার সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরার দিক থেকে। শকুনি শুধু মোপাসার গল্পের মত ঝাঁকুনিই দেয় না একই সাথে চেখভের গল্পের মত একরাশ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। পাঠককে চিন্তা করতে শেখায়। সেখানেই লেখকের বড় সফলতা।
হাসান আজিজুল হকের সবচেয়ে বিখ্যাত গল্প বলে যে গল্পটির কথা আমরা পাঠকেরা বলি তা হল 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ'। এই গল্পের প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, “বর্ধমান থেকে ১৯৬১ সালে আমরা খুলনার ফুলতলায় চলে এসেছি। তবে আমরা তো বিতাড়িত হয়ে আসিনি, সামর্থ্য ছিল, নিজেরাই চলে এসেছি। কিন্তু সবার তো এই সামর্থ্য ছিল না। ওখান থেকে চলে আসার পরই আমরা খুলনার ফুলতলার এই বাড়িটি বদলাবদলি করে পেয়েছিলাম। সেখানে থেকে আশপাশের জীবন দেখতাম; আমাদের মতো উদ্বাস্তু আরো পরিবার এসেছিল। আমরা তো মোটামুটি স্বাবলম্বী হিসেবেই এসেছি। আমি দৌলতপুর কলেজে শিক্ষকতা করি, আমার ভাই চাকরি করে। আমাদের চলে যায়। কিন্তু সব মানুষের তো সে দশা হয়নি। তাদের এই রকম পরিস্থিতি হয়েছিল। সেটি বোঝানোর জন্য অর্থাৎ কী বিষবৃক্ষই না আমরা রোপণ করেছি ১৯৪৭ সালে—এই গল্পটি তাই লেখা। ফুলতলায় প্রচুর উদ্বাস্তু থাকত। তারা এসে ওভাবে থাকত। উপার্জনের পথ নেই, জায়গাটিও বসবাসের অযোগ্য। চাষবাস, বাগান ছেড়ে চলে এসেছে। খাবে কি? কোনো রকম একটি ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। মেয়ে বড় হচ্ছে। কি করবে, কি করবেন সেই বৃদ্ধ? তাদের কারো কারো বাড়ির খবর পেতাম। কেউ কেউ বাড়িতে যে এ রকম ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হচ্ছেন, সে খবরও পেতাম। তখন আমার মনে অসম্ভব কষ্ট হতো। মানুষের এমন অসহায়ত্ব আমার মনে খুব আঘাত করল—এটি নিয়ে লিখতে হবে। সমাজের মধ্যে এমন ব্যাধি ঢুকেছে! দেশভাগ করে কিন্তু আমরা খুবই খুশি হয়েছি। আসলে কাকে ভাগ করেছে তারা? নিজের অংশকেই তো ভাগ করেছে।”
অর্থাৎ ৪৭ এর দেশভাগে মাতৃভূমি চ্যুত মানুষের বিপর্যয় ও হাহাকারের গল্প 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ'। করবী গাছ এখানে একটি বিষ বৃক্ষের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত। যেখানে আমরা দেখি একজন বৃদ্ধ বাবা অনন্যোপায় হয়ে, শুধু বেঁচে থাকবার জন্য তার মেয়েকে দেহ ব্যবসার কাজে নিযুক্ত করেন।
গল্পের শুরু এক স্নিগ্ধ শান্ত গ্রামের ছায়ায়। লেখকের বর্ণনায়, “নির্দয় শীতকাল। ঠাণ্ডা নামছে হিম, চাঁদ ফুটে আছে নারকেল গাছের ছায়ায়”। বড় গঞ্জের রাস্তার মোড়, টিনের বাড়ি, রাস্তার পাশের বনবাদাড়, ভাঙ্গা বাড়ির ইটের স্তূপ, পোড়ো জমি, জঙ্গল, পানের বরজ, কাশবন, মজা পুকুর, বিল, উঠোনে ধান সেদ্ধ সব কিছু নিয়ে এক মায়ায় ভরা চির-চেনা গ্রাম বাংলা। এই গ্রামের বাসিন্দা হচ্ছে গল্পের তিন বখাটে যুবক। ইনাম কর্মহীন যাকে বলে বেকার, ফেকু পকেটমার আর সুহাস নাপিত। নানা গল্পের মাঝে তারা পরিকল্পনা করছে জনৈক বৃদ্ধের কুমারী কন্যার সাথে সময় কাটানোর।
এরা বুড়োর বাড়ীতে এসে উপস্থিত হয়। লেখকের নিজের বর্ণনায়, “ফেকু নিজের পকেট থেকে দুটো টাকা বের করে, দলা পাকায়, ভাবে ভয় পায়, শেষে বুড়োর দিকে ঝুঁকে পড়ে বলে, ‘সুহাস আর আমি দিচ্ছি’। তখন বুড়ো বলে, “যাও, তোমরা কথা বলে এসো, উই পাশের ঘরে”।
গল্পের প্রায় শেষে বুড়ো বলছে, “আমি একটা করবী গাছ লাগাই বুঝলে? ………বিচির জন্যে, করবী ফুলের বিচির জন্য। চমৎকার বিষ হয় করবী ফুলের বিচিতে”।
উর্দু সাহিত্যের জনপ্রিয় নামী লেখক সাদত হাসান মান্টো যেমন তার নানা গল্পের (“ঠাণ্ডা গোশত”, “টোবা টেকসিং”) মাঝ দিয়ে ৪৭ এর দেশ ভাগের ফলশ্রুতিতে মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশার প্রতিবাদ জানিয়েছেন তেমনি করেছেন হসান আজিজুল হক। যারা এ দেশ ভাগে যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাননি তাদের জন্য এ ধরনের গল্প চোখ খুলে দিয়ে মানবিক মূল্যবোধের জাগরণ ঘটানোর মত বিষয়।
একটি সম্পূর্ণ হৃদয়বিদারক, মর্মস্পর্শী গল্প এই 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ'। এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র বুড়ো নন, নন তার আত্মজা। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘দেশভাগ’। তাও সে নায়ক হিসেবে নয়, চিত্রিত হয়েছে ভিলেন হিসেবে। এখানেই লেখকের গল্প বলার মুনশিয়ানা। বুড়ো যখন বলেন, “দেশ ছেড়েছে যে তার ভেতর-বাইরে নেই, সব এক হয়ে গেছে”। তখন হৃদয় মুচড়ে উদ্গত কান্না চোখে জ্বালা ধরায়। হু হু করে উঠে মন। জীবনের চারপাশ শূন্যতায় ভরে যায়।
লিখতে হলে প্রচুর পড়তে হয়। সেদিক থেকে হাসান আজিজুল হক চষে ফেলেছিলেন ইউরোপ-আমেরিকা সহ ল্যাটিন আমেরিকার নানা লেখকদের লেখা। সেখান থেকেই তিনি নিজেকে ঋদ্ধ করে নিজের ভূমিতে জুড়িয়েছেন লাঙ্গল। চাষ করে ফলিয়েছেন অমূল্য গল্প-কথা। একবার তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, গল্পকার হিসেবে আপনি কি তৃপ্ত? সঙ্গত কারণেই তিনি বলেছিলেন, “কোনো লেখকই বোধ হয় নিজের লেখা নিয়ে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হতে পারেন না। ফলে আমার নিজের কাছে নিজের লেখা কোনো প্রিয় গল্প নেই। নিঃসন্দেহে যে লেখাটি আমি লিখতে চাই, সেটি লেখা হয়নি”। এ হল একজন সৃষ্টিশীল, প্রতিভাবান ও পরিশ্রমী লেখকের কথা। নিঃসন্দেহে তিনি বাংলাদেশের হাতে গোনা দু’চার জন গল্পকারদের একজন যাদের কিছু গল্প শত বছর পরেও পঠিত হওয়ার ও তা নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা রাখে।
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া Jsfn21@gmail.com
|