“MY WIFE NO GOOD SAME SAME YOU GO!!!” রিয়াজ হক
১৯৯৪ সালের জুনের মাঝামাঝি সৌদি আরব যাই এক কন্সট্রাকশন কোম্পানিতে চাকুরী নিয়ে। আমি যে শহরটাতে ছিলাম তার নাম জুবাইল; সৌদি ইস্টার্ন প্রভিন্সের রাজধানী দাম্মাম থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার দক্ষিণে। বিশাল অয়েল রিফাইনারির জন্য শহরটি বিখ্যাত। সেখানে আমার কাজ ছিল কোম্পানির পক্ষ থেকে জুবাইল রয়েল কমিশন এলাকায় রেসিডেনশিয়াল বিল্ডিং কন্সট্রাকশন সুপারভিশন। মাঝে মাঝে আমাকে অয়েল রিফাইনারির কিছু মেইন্টিন্যান্সের কাজেও কর্মীদের নিয়ে যেতে হত। সেখানে থাকা অবস্থায় নানা জনের ইংরেজি ভাষা জ্ঞানের বহর নিয়ে আজকের সব গল্প।
গল্প একঃ “He no You down go”
একদিন আমি খুব সকালে কাজ শুরুর আগে সাইট দেখার জন্য রিফাইনারির চাড় নম্বর গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকব বলে গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হই। বলা বাহুল্য তখনও আমি ড্রাইভিং জানিনা। আমাদের কোম্পানিতে কর্মরত এক বাংলাদেশী ড্রাইভারই গাড়ি চালাচ্ছিল। প্রতিটি গেটে সিকিউরিটি চেকপোস্ট। পোস্টে এসে আগে থেকে নেওয়া প্রয়োজনীয় পারমিট ও আই ডি দেখালে সৌদি সিকিউরিটি আমার দিকে তাকিয়ে, ড্রাইভারকে দেখিয়ে উপরের কথাগুলো বলছিল “He no You down go”।
আমি প্রথম কিছুই না বুঝতে পেরে বোকার মত ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ওর চঞ্চল অঙ্গভঙ্গির প্রকাশ ও চিৎকার করে তিন/চারবার বলার পর আমি ওর আসল কথা বুঝতে পারি। ও আসলে বলছিল, “তোমার ড্রাইভার যেতে পারবে না (He no)। তুমি গাড়ি থেকে নেমে তারপর হেঁটে যাও” (You down, go)।
গল্প দুইঃ “I not go who go”
আমি যে সময় সৌদি আরব ছিলাম সে সময় প্রচুর ইয়েমেনিরা প্রায় বিনা ভিসাতেই সৌদি আরবে এসে কাজ ও ব্যবসা করত। আমি যে রেসিডেনশিয়াল হাউজিং এ থাকতাম তার সমস্ত খাবার সাপ্লাই করত এক মধ্য বয়েসি ইয়েমেনি। হাউজিং এর একটা বিরাট এলাকা জুড়ে ছিল ব্যাচেলর একোমোডেশন। প্রতি বছর এখানে একবার করে নানা ধরনের খেলার প্রতিযোগিতা হত। উপহার সহ এ খেলার সমস্ত ব্যয় বহন করত ঐ ইয়েমেনি ব্যবসায়ী। আমি যাওয়ার প্রথম বছর খেলার প্রতিযোগিতার শেষে ঠিক হল ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত আমরা বাইরে যেয়ে খুব নাম করা এক পাকিস্তানি রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খাব। তো ভদ্রতার সাথে আমরা ঐ ইয়েমেনি ব্যবসায়ীকেও আমাদের সাথে যেতে বলাতে সে ঐ কথা (I not go who go) বলেছিল। আসলে সে বোঝাতে চেয়েছিল, “আমি তোমাদের খেলার স্পন্সর, গেলে অন্যের আগে আমিই তো যাব”।
গল্প তিনঃ “Coffee Tea You to me”
আমাদের ব্যাচেলর একোমোডেশনের ডাইনিং হলটি ছিল এক বিশাল ক্যারাভানের মত। এখানের মূল কুক ছিল বাংলাদেশের; নাম হাশেম। তার মত প্রচণ্ড বুদ্ধিমান, তাৎক্ষনিক সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অসম্ভব ক্ষমতা ও মানুষকে কাছে টানার যাদুকরী প্রভাব আমি খুব কম দেখেছি। মাত্র সতের বছর বয়সে সে ইরাকে যায় ইলেক্ট্রিশিয়ানের ভিসা নিয়ে। কিন্তু তখনও সে ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজের ‘ই’ ও জানত না। ইরাকে যাওয়ার সাথে সাথেই কোম্পানির কাছে তা ধরা পড়ে যায়। তাকে পরবর্তী বাহাত্তুর ঘণ্টার মধ্যে দেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দিলে সে পরদিন সকাল বেলা কোম্পানির এক পরিচালকের কক্ষে ঢুকে তার পা জড়িয়ে ধরে এবং তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হলে তার মৃত্যু ছাড়া আর কোন পথ থাকবে না বলে তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়। ইরাকী পরিচালক দয়াপরবশ হয়ে তার কন্ট্রাক্টের এক তৃতীয়াংশ বেতনে তাকে কুকের হেল্পার হিসেবে ডাইনিং এ কাজের ব্যবস্থা করে দেয়।
এই তার যাত্রার শুরু। পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে সে কুকের সহকারী ও তার পরবর্তী দু’বছরের মধ্যে সে কুক হিসেবে নিজেকে উন্নীত করে। এরপর কুকের চাকুরী নিয়ে বাংলাদেশ হয়ে সৌদি আরবে চলে আসে। ১৯৯৪ সালে আমি যখন সৌদি আরবে তার তখন প্রধান কুক/শেফ হিসেবে ১৬ বছরের চাকুরী চলছে। ইংলিশ, চায়নিজ, ফ্রেঞ্চ আপনি নামকরণ করতে পারেন এমন সব রান্নাতেই সে তখন সিদ্ধহস্ত। আমাদের কোম্পানির ক্যাটারিং সুবিধায় তখন বিভিন্ন জাতি-সম্প্রদায়ের প্রায় চারশো লোক। এদের সবার খাবারের দায়িত্বে সেই হাশেম। যা হোক, যার জন্য এত কথা, সেই হাশেমের হেল্পিং হ্যান্ড ছিল এক নেপালি ছেলে। ছুটির একদিন বিকেলে প্রচণ্ড মাথা ধরাতে আমি ডাইনিং এ ছুটে যাই এক কাপ চা খাওয়ার জন্য। পেয়ে যাই সেই নেপালিকে। তাকে বলাতে সে এক কাপ চা বানিয়ে আমার রুমে নিয়ে আসে এবং ফেরার সময় আমাকে ঐ কথা বলেছিল (“Coffee, Tea, You, to me”)। আসলে সে বোঝাতে চাচ্ছিল, যখনই তোমার কফি, টি লাগবে (Coffee, Tea ); তুমি (You) আমার কাছে (to me) চলে আসবে।
গল্প চারঃ “Me my wife her brother his sister her son ”
আমাদের কোম্পানি একোমোডেশনের বিভিন্ন ভাগের (সিনিয়র, জুনিয়র, লেবার ইত্যাদি ) ঘরগুলির জন্য আলাদা আলাদা বৈদ্যুতিক মিটার লাগানোর কাজে এক সৌদি কনট্রাক্টরকে নিযুক্ত করা হয়। তার নাম কাশিম ইবনে কাশিম। কাজের সুবাদে তার সঙ্গে আমার কিছুটা সম্পর্ক তৈরি হয়, এর যতটা না কথায় তার চেয়ে বেশী বডি ল্যাংগুয়েজের মাধ্যমে।
রোজার সময় একদিন রাতে উৎসবমুখর এক শপিং সেন্টারে দেখি সে একটি পাঁচ / সাত বছরের ছোট্ট ছেলের হাত ধরে দুলকি চালে হাঁটছে। তার পেছনে পেছনে নিকাব পরা দু’জন মহিলা। আমাকে দেখে সে থামল। সালাম বিনিময়ের পর তাকে ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম, “এই ছেলেটি কি তোমার?” অনেক ভেবে চিন্তে সে যে জবাব দিয়েছিল তা হল ঐ “Me, my wife, her brother, his sister, her son ” আসলে সে বোঝাতে চাচ্ছিল, এটা তার শ্যালিকার ছেলে !
গল্প পাঁচঃ “My wife no good same same you go”
রয়েল কমিশন সাইটে মূল কনট্রাক্টরদের পক্ষে কাজ করত এক থাই পে লোডার ড্রাইভার। তার কাজ ছিল বিভিন্ন মালামাল সাইটে পৌঁছে দেওয়া। বিশেষ করে কনক্রিট ব্লক, বালি, সিমেন্ট ইত্যাদি। অনেকগুলো বিল্ডিং আর চরকির মত ও সারাদিন কাজ করার পরও সাপ্লাই দিয়ে শেষ করতে পারত না। আমার কোম্পানি পরিচালকের পরামর্শে ওর আনুকূল্য পাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে ওকে কিছু না কিছু গিফট দিতে হত। এ ছিল কাজেরই অংশ বলা যায়। সে জন্য ওর সাথে আমার একটা সুসম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
একদিন সাইটে যেয়ে দেখি ও নেই। ঘটনা কি ? একজন জানাল ওর শরীর খারাপ। হঠাৎ কি হল ? গতকালও দেখলাম ও খুব হাসিখুশি; শিষ দিয়ে দিয়ে কাজে মেতে ছিল। আজ ‘শরীর খারাপ’ বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমি ওর খোঁজে গাড়ি নিয়ে ওর ডেরায় চলে গেলাম। নক করার পর ও দরজা খুলল। চোখ রক্তবর্ণ। সারারাত ভীষণ কেঁদেছে মনে হল। আমি ইশারায় বললাম, “কি হয়েছে?”। ও ভীষণ ডুকরে কেঁদে উঠল। যা বলল, তা হল ঐ (My wife no good, same same, you go)। অনেক পরে বুঝলাম ওর আসল কথা। পাঁচ ও তিন বছর বয়সের ওর দুই পুত্র সন্তান নিয়ে স্ত্রী দেশে ছিল। গতকাল ও খবর পেয়েছে ওর স্ত্রী দু’সন্তান রেখে আরেকজনের সঙ্গে চলে গেছে। ও যা বলতে চাচ্ছিল তা হল, “আমার স্ত্রী ভাল নয় (My wife no good); তোমার মতই অন্য একজন পর পুরুষের সাথে চলে গেছে (same same you, go)।
বিঃদ্রঃ এই গল্পগুলোর জন্য বেশ কিছুটা কৃতিত্বের অংশীদার আমার ভগ্নীপতি, সিডনির হক্সটনবাসী প্রকৌশলী মিঃ রফিকুল ইসলাম। কারণ, তিনিই আমাকে সৌদি আরব যেতে সহায়তা করেছিলেন। আর গল্পগুলোর পুনরুদ্ধারেও তার অবদান আছে।
রিয়াজ হক, সিডনি
|