|
"মিঠে আর কটু মিলে, মিছে আর সত্যি, ঠোকাঠুকি ক'রে হয় রস-উৎপত্তি। মিষ্ট-কটুর মাঝে কোনটা যে মিথ্যে সে কথাটা চাপা থাক কবির সাহিত্যে" রবীন্দ্রনাথের ‘আধুনিকা’ কবিতাংশের উপরের এই বানীকে সামনে রেখে কথোপকথনের শুরু
আগের পর্ব
কথোপকথন – (১০) রিয়াজ হক
২০১৭ এর মঙ্গল বারের সকালের এনজাক ডে’র ছুটির আমেজটা খুব রয়ে সয়ে উপভোগ করছিল জামি। সকালের নাস্তার পর চা বানিয়ে নিয়ে, রাহী এসে বসল জামির পাশে, নরম সোফায়।
জামি রাহীর হাত থেকে চায়ের মগটা নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল, “রাহী, তোমার কি আজকের দিনটির কথা মনে আছে?”
“তুমি কেমন করে ভাবতে পারলে যে ন’বছর আগের আজকের এই অনন্য দিনটির কথা আমি ভুলে যাব? তাছাড়া তুমি নও, আমিই কিন্তু অনেক বাধা-বিপত্তি ঠেলে, অনেক সাহস ও আস্থা নিয়ে তোমার দিকে এগিয়ে এসেছিলাম। কাজেই, আমার ভোলার প্রশ্নই আসে না”।
জামিঃ অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে, “নিশ্চয়ই তুমি সে বিশ্বাস ও আস্থার প্রতিদান পেয়েছ” !
রাহীঃ বিস্ময় বিমুঢ় মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে, “জানি না। এখনও মাঝে মাঝে মনে হয় তোমাকে আমি পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি”।
জামিঃ হো হো করে হেসে উঠে, “কি আশ্চর্য, তোমার ব্যাপারে আমারও তো একই কথা মনে হয়”
রাহীঃ অবাক হয়ে, সন্দেহের চোখে তাকিয়ে, “মানে”?
জামিঃ মানে ওই কবিতাংশের মত “সে যে শুধু দৃষ্টি এড়ায়/ পালিয়ে বেড়ায় / ডাক দিয়ে যায় ইঙ্গিতে”।
রাহীঃ রাখতো এসব দুষ্টামি।
জামিঃ আচ্ছা রাহী, চল আজকে আমরা অতীতের দিকে তাকিয়ে তার স্মৃতিচারণ করে আমাদের প্রথম ভালোবাসার দিনটি উদযাপন করি। কোন বাড়াবাড়ি নয়, বাষ্প-উষ্ণ চায়নিজ সুপে’র হ্রদয় কাড়া সুবাস নয়, চোখ ঝলসানো উপহারের অহেতুক উপদ্রব নয়, ফেসবুকে লোক দেখানো সেলফি নয়। শুধু গল্প আর গল্প করে পার করে দেই আজকের দিনটি।
রাহীর দিকে সরাসরি তাকিয়ে, “বলতো, ন’বছর আগে আমাদের আজকের সময়টা কেমন ছিল”?
রাহীঃ সময় ছিল ভয়ানক অস্থির। টালমাটাল। উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তায় ভরা। প্রবল প্লাবনের উচ্ছ্বসিত জলের মতই আমাদের চিন্তা, বোধ ও বিশ্বাস কে তছনছ করছিল শিক্ষা – পরিবার – ধর্ম ও রাজনীতির গোলক ধাঁধাঁ। আমার খালি মনে হত অথৈ পানিতে তলিয়ে যাচ্ছি। কোন শক্ত জমিন ও জোড় করে ধরে থাকবার মতন কোন অবলম্বন পাচ্ছিলাম না। জামিঃ আসলেই তাই। আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের ক্রাইসিসটাই ওই। আমরা উপরে, অনেক উপরে উঠতে চাই। অর্থ চাই। বিত্ত চাই। সাথে সাথে প্রবল উন্মাদনায় আঁকড়ে ধরতে চাই পরিবারের সনাতন মূল্যবোধ। শিক্ষাকে জীবন জীবিকার বাহন করতে চাই। ধর্মানুভুতিকে যাপিত জীবনের অংশ করতে চাই। কোথায় যেন এই চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে এক বিস্তর ব্যবধান।
আমাদের সংস্কৃতি, মানবিক মূল্যবোধ ও ধর্মানুভুতি বলে তুমি সততাকে লালন কর। ন্যায়ের পক্ষে থাক। কিন্তু বাস্তব জীবনাচরণে আমরা তা দেখতে পাই না। উপরে উঠার সিঁড়ির পথে তার সব চোখ রাঙ্গানোকে মাড়িয়ে আমরা লোভের আগ্রাসী প্রলোভনে আত্মাহুতি দেই নিজেদের। কারণ উপরে উঠার বেসামাল মোহের কাছে আমরা তখন নিদারুণ ভাবেই পরাজিত। ফলে, আমরা এক জটিল, মিশ্র ও বিভ্রান্তিকর জীবনের মাঝ দরিয়ায় পড়ে যাই। বলে, থামে জামি।
রাহীঃ আমার ধারনা হয়, সব যুগে চিন্তার ক্ষেত্রে সব তরুণদেরই বোধকরি এরকম হয়। কারণ, সমাজের বিবর্তনে তরুণদের মত করে স্বার্থ-বিহীন সর্বাঙ্গীণ শুভ ও সুন্দরের চিন্তা বোধহয় কেউ করতে পারে না।
জামিঃ আমার কি মনে হয় জান, আমরা জীবনের সব শুভকে আলিঙ্গন করতে চাই কিন্তু তাতে বিশ্বাস ও আস্থা রাখতে পারি না। ধর্মের বাহ্যিক পালনকে বড় করে এর অন্তর্নিহিত মানবিক সৌন্দর্যকেই বিসর্জন দিয়ে দেই। আমাদের জীবনের সমস্ত ব্যর্থতার জন্য দায়ী বিষয় ও ব্যক্তি খুঁজে বেড়াই কিন্তু নিজের ক্ষমাহীন সীমাবদ্ধতার খোঁজ করি না। আমরা অপরকে সমালোচনার নিষ্ঠুর তীরে বিদ্ধ করি কিন্তু আয়নায় নিজের করুন অবয়ব প্রত্যক্ষ করি না। নিজের নিজের ধ্যান ধারনায় বদলে দিতে চাই চারপাশের সব মানুষ এমনকি গোটা বিশ্বকে অথচ আশ্চর্যজনকভাবে নিজেকে বদলাতে চাই না। আমরা বুঝি না যে নানা মত, নানা পথ, নানা বর্ণের নানা বাদ-প্রতিবাদের ভেতরেই বৈচিত্র্যময় এ পৃথিবীর অনাবিল অপার সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে।
এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে প্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে জামি।
রাহীঃ এত সব ভারী ভারী কথা শুনে আমার খুব কষ্ট লাগছে। তা ছাড়া নিজেকে খুব ছোটও মনে হচ্ছে।
জামিঃ এটা একটা ভাল দিক। তার মানে তোমার নিজের মধ্যে ঐ ভালোর দিকে যাওয়ার একটা প্রবল আকাঙ্ক্ষা আছে তাই তুমি কষ্ট পাচ্ছ। দুঃখের বিষয় কি জান বহু মানুষের মধ্যে ঐ বোধটুকু পর্যন্ত নেই।
রাহীঃ তোমার খুব পড়ার বাতিক ছিল, আমারও তাই। তুমি মানুষের কষ্টে খুব কাতর হয়ে পড়তে, আমারও তাই। তুমি কবিতা আবৃত্তি করতে, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। সমাজ-রাজনীতি নিয়ে তুমি খুব ভাবতে। আস্তে আস্তে আমিও তাতে সামিল হয়ে গেলাম।
জামিঃ আসলে এক সাথে থাকতে গেলে অনেক বিষয়েই মিলের দরকার হয়। জীবনের চাহিদা তো কেবল শারীরিক অবস্থানের অস্তিত্ব দিয়ে পূর্ণ হয় না। মানসিক অবস্থানের বিষয়টাও সমান জরুরী। একটি আরেকটির পরিপূরক।
রাহীঃ আমাদের বন্ধুদের কথা খুব মনে পড়ে; দীপ্তি, বর্ষা, তুষার, শাহান কতজন...............।।
জামিঃ সত্যিই তাই। জীবনের কাছে জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার হচ্ছে ঐ বন্ধুত্ব। এটা কেবল যে তোমার সহপাঠী, প্রতিবেশী বা সমবয়স্কদের মধ্যে হবে তা কিন্তু নয়, এটা হতে পারে তোমার মা-বাবা, ভাই–বোন বা প্রিয় যে কোন মানুষের সাথে।
রাহীঃ ছল ছল চোখে, “কেন তুমি এই সময়ে মা-বাবা, ভাই-বোনের কথা বললে! ওদের সবাইকে এ প্রবাসের জীবনে খুব মিস করি”।
একটু থেমে, নিজেকে সামলে নিয়ে, “দীপ্তির সেই বাঁধভাঙা হাসির ঝড়, বর্ষার কৌতুক প্রিয় সরল মুখ, তুষারের মায়াবী সুরের গিটার আর শাহানের উদাত্ত কণ্ঠের সেই আবৃত্তি, গুনের (কবি নির্মলেন্দু গুন) সেই বিখ্যাত কবিতাটি............
জামিঃ “I hate, আমি প্রতিবাদ করি/ I hate, আমি অস্বীকার করি/ I hate, আমি ঘৃণা করি”
আচ্ছা রাহী, তোমার কি কখনো এমন মনে হয় যে আমরা জীবনের কাছে খুব বেশী প্রত্যাশা করি?
রাহীঃ মানে?
জামিঃ ধর, বিখ্যাত একজন মনীষীর কথা ধার করে বলি, “জীবন যা সহজে দিতে পারে তা গ্রহণ করার মত বিনয়” কি আমদের সবার আছে?
রাহীঃ না, নেই। আমরা অল্পতে সন্তুষ্ট হতে পারি না। যেমন, দেশে থাকলে আমাদের চাকুরীর অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তার অভাব ও অসহিস্নু রাজনীতির ডামাডোলের ভেতরও একটা আপাত সুখ ছিল। সবার কাছে ছিলাম, সবাইকে নিয়ে ছিলাম সুখে কিংবা দুঃখে। চাকুরী, নিরাপত্তা ও অর্থ বিত্তের যে মোহে দেশ ছেড়েছি সে মোহের সবই কি বাস্তবে আমাদের পক্ষে কাজ করছে। আমার তো মনে হয় আধা আধি। এখানেও চাকুরীর অনিশ্চয়তা আছে, আছে জীবন – সংস্কৃতি – সন্তান বড় করা নিয়ে নানা মানসিক অস্থিরতা। তারপরও যে পথ আমরা বেছে নিয়েছি তাকে ঐ কবিতার চরণে ফেলে বলতে পার.................................।।
জামিঃ “এ কোন জীবন আমি বেছে নিলাম প্রভু...........................”
রাহীঃ হেসে বলে, “তাই”।
জামিঃ আজকের দিনে তোমাকে উপহার দিব বলে একটি বিষয় ঠিক করেছি।
রাহীঃ প্রচণ্ড কৌতূহল নিয়ে, “কি, কি সে বিষয়”?
জামিঃ তোমাকে সামনে রেখে একটি গান লিখেছি।
রাহীঃ উত্তেজিত হয়ে, “গান? বল কি? তোমার লেখা কবিতা শুনেছি, কিন্তু গান! গান লেখার কথা তো কখনও বলনি। প্লিজ, দেখাও না কি লিখেছ! আর ভাল কথা, গান হলে তো তার সুর, তাল, লয় ঠিক করতে হবে”। ঝিলিক দেওয়া কৌতূহল ও আমুদে চোখে রাহীর প্রশ্ন, “তোমার গানের সুর দিবে কে? বলতো কে হবে তোমার গানের সুরকার”? জামিঃ আমার গানের সুরকার ঐ ‘নৈশব্দ’। নৈশব্দেরও একটা সুর আছে জান! এ আকাশ সীমার দূরবর্তী প্রান্তর থেকে তাল ও লয় তুলে নিয়ে ‘নৈশব্দ’ সমুদ্রের ঢেউয়ের মতই আছড়ে পড়ে মনের গহীন বালুচরে।
রাহীঃ ধুর, কি যে বল না। সব কিছুতে কাব্য আর রহস্য করো না তো। এখন সুরে না হোক কবিতার ছন্দতেই গানের কথাগুলো বল শুনি !
জামিঃ ধীরে ধীরে, একধরনের গুন গুন সুরে...........................
“ভোর রাতে স্বপ্নেরা এলো চুপি চুপি, না বলা শত কথা, সুরে সুরে বাঙময় গানের ঝাঁপি বাউল বাতাসে কাঁপা তোমার ছায়া আনমনা, লতায় পাতায় জড়ানো চন্দ্র মুখ, নাকি কল্পনা।।
গেয়ে গেল সরস মধুর জীবনেরই গান।
কদম ফোঁটার রাতে ঝড় ঝড় বরষায়, ভেজা চোখে চেয়ে থাকা সাহসের ভরসায় নির্ঘুম কেটে যাওয়া শঙ্কার ধোঁয়া, কাছে আসা, পাশে বসা, আঙুলের ছোঁয়া।।
বলে গেল মৃত্যুহীন ভালোবাসা, শোন পেতে কান”। (সমাপ্ত)
আগের পর্ব
রিয়াজ হক, সিডনি
|
Share on Facebook               Home Page             Published on: 29-Aug-2017
| | |