|
"মিঠে আর কটু মিলে, মিছে আর সত্যি, ঠোকাঠুকি ক'রে হয় রস-উৎপত্তি। মিষ্ট-কটুর মাঝে কোনটা যে মিথ্যে সে কথাটা চাপা থাক কবির সাহিত্যে" রবীন্দ্রনাথের ‘আধুনিকা’ কবিতাংশের উপরের এই বানীকে সামনে রেখে কথোপকথনের শুরু
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
কথোপকথন – (৭) রিয়াজ হক
“গতকাল দুপুরে আমার মোবাইলে দেশ থেকে একজন ফোন করেছিল”। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে রাহীর দিকে না তাকিয়ে, রাহীর উদ্দেশ্যেই কথাগুলো বলে জামি।
আজ শনিবার। সকাল দশটা। কিসিং পয়েন্ট রোড ধরে ইস্ট উডের দিকে গাড়ি ড্রাইভ করছে জামি। উদ্দেশ্য ইস্ট উডের সব্জি ও ফলের বাজারে যাওয়া। • “দেশ থেকে কে”? প্রশ্ন করে রাহী।
• “অনুমান কর”। বলে মুখে মৃদু হাসি নিয়ে, তাড়াতাড়ি ব্রেক চেপে, রেড সিগন্যালে গাড়ি থামায় জামি।
• “কে, বড় দুলাভাই? জসিম? মেজ’পা?
• “না” বলে আবার সবুজ আলো জ্বলে উঠতেই ধীরে ধীরে ব্রেক ছেড়ে দিয়ে গাড়ি সামনে চালাতে থাকে জামি।
• “তা হলে আর কে? রহস্য করোনা তো। বলে ফেল”। অধৈর্য হয়ে বলে উঠে রাহী।
• “তোমার আব্বার চাচাত ভাইয়ের ছেলে ইসমাইল”।
• “ইসমাইল? ইসমাইল আবার কেন”? বলে ঈষৎ রেগে, ভুরু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করে রাহী। “এই না সেদিন তার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য তোমার কাছ থেকে টাকা নিল”?
• “এবার তার মেয়ের বিয়ে”।
• “কোন মেয়ে? বড় মেয়েরই তো এখনো বিয়ের বয়স হয়নি। ওর বয়স বড় জোর পনের/ষোল হবে”।
• “হয়ত এ মেয়েরই বিয়ে দিবে”। বলল, ভাল একটা চাকুরীজীবী ছেলে পেয়েছে। তাদের একটাই ডিম্যান্ড ‘মোটর সাইকেল’। তার নিজের কৃষিজমি থেকে প্রাপ্ত ফসল দিয়ে এ চাহিদা মেটানো খুব কঠিন। তাই সে সবার সাহায্য চাইছে।
• “মোটর সাইকেল? বল কি? সে তো মেলা টাকা। এত টাকা কি ভাবে সে জোগাড় করবে? আর সবকিছুতে সবাই আমাদের কেন ফোন করে? সবাই কি ভাবে যে আমরা যারা বিদেশে থাকি তাদের কাড়ি কাড়ি টাকা”।
• “দ্যাখো, এ ভাবার জন্য তুমি তাদের দোষ দিতে পার না। দেশ ছেড়ে আমরা যারা বিদেশে মানে আমেরিকা, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছি আসার চার/পাঁচ বছরের মধ্যেই আমরা নিদেন পক্ষে গাড়ির মালিক হয়েছি; হোক না সে পুরনো। এমন কি সাত/আট বছরের মধ্যে আমরা কেউ কেউ বাড়িরও মালিক হয়েছি। এসব খবর যখন দেশে যায়, মানুষ তখন স্বাভাবিক ভাবেই ভাবে এদের অনেক টাকা। যেখানে দেশে এগুলোর মালিক হতে তোমাকে জীবনের উপার্জনের বড় একটা অংশ খরচ করে ফেলতে হয়। ওরা তো জানে না যে এর পেছনে রয়েছে ব্যঙ্ক ঋণের বিরাট পাহাড়। ব্যাংকের ‘মর্টগেজ’ নামক এক উপায়হীন যাচিত দানবকে কাঁধে নিয়ে আমরা প্রবাসে তথাকথিত সুখের ও আনন্দের জীবন যাপন করছি ! এমনকি যে দেশে সরকারী বেসরকারি কোন চাকুরীরই ‘নিরাপদ প্রাপ্তি’ বলে কিছু নেই। সবই স্থিতি-হীন, সবই ‘এই আছে এই নেই’; এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামে জামি।
• “হ্যাঁ, তা ঠিকই বলেছ। তাছাড়া দেশে যেয়ে আমদের কারো কারো খরচের বহরের কথা শুনলে অবাক হতে হয়। একজন শুনলাম দেশে যেয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বন্ধুদের খোলা আমন্ত্রণ জানিয়েছে হোটেল ওয়েস্টিনে”। বলছে ঐখানেই সবার সঙ্গে দেখা, কথা ও খাওয়া-দাওয়া হবে।
• “তুমি কি জান আমার বন্ধু তাউসিফের বড় ভাই দেশে যাওয়ার সময় তার বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় স্বজনের জন্য কি ধরনের গিফট নিয়ে গেছে? কারো জন্য ল্যাপটপ, কারো জন্য আইপ্যাড, আইফোন, ক্যামেরা সহ দামী দামী সব জিনিস। তো এভাবে আমরাই তো সবার এক্সপেকটেশন বাড়িয়ে দিচ্ছি। তাই এক্ষেত্রে দেশের মানুষ যদি সরল ভাবে, ভাবে যে বিদেশের সবারই অনেক টাকা, সেক্ষেত্রে তাদের দোষ দেওয়া যায় না। ওরা তো জানে না যে এখানেও চাকুরীর অবস্থা ও অবস্থান ভেদে দেশের মতই নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের ভেদ রয়েছে। তাই সবার পক্ষেই গুরুতর প্রয়োজন ছাড়া টাকা বিলানো ও টাকা ছড়ানো সম্ভব নয়”।
• “শোন, যারা পারে, মানে যাদের অনেক রোজগার, যেমন ডাক্তার বা প্রকৌশলী যারা প্রফেশনাল জব করছে তারা করলে এগুলো হয়ত মানায়। তারপরও এর প্রতিক্রিয়া হতে পারে সুদূরপ্রসারী। দেশে অবস্থানকারী সব আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবরা হয়ত এতে করে ভুল সিগন্যাল পেয়ে যেতে পারে, ভাবতে পারে সবার অবস্থা হয়ত একই। এ এমন একটা জটিল পরিস্থিতি যে একে সহজে ব্যাখ্যা করে বোঝানও অসম্ভব” বলে একটা বিভ্রান্ত চেহারা নিয়ে জামির দিকে তাকিয়ে থাকে রাহী।
• “দ্যাখো রাহী আমারও ইচ্ছে করে সবার জন্য কিছু করতে। বিশেষ করে স্বজনদের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াতে। কিন্তু নিজেদের তথা নিজের মা, ভাইবোনদের প্রয়োজন মেটাতেই যেখানে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে সেখানে অন্যদের পাশে কিভাবে দাঁড়াব তাই ভাবছি” বলে থামে জামি।
• “ভেবে আর কি হবে। অল্প হলেও কিছু দিয়ে ওদের বলতে হবে, আমাদের সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব দিয়েছি, এর বেশী পারব না। এতে করে ওরা খুশী হলে ভাল, না হলেও করার কিছু নেই। অন্তত ওরা জানল আমাদের সামর্থ্য এতটুকুই, এমনকি আমারা নিজেরাও বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকলাম” বলে সমর্থন নিতে জামির হাতটা আলতো করে ছুঁয়ে দেয় রাহী।
• “তুমি ঠিকই বলেছ” বলে বা দিকে সিগন্যাল দিয়ে ইস্ট উডের সব্জি ও ফলের বাজারের পার্কিং লটে গাড়ি ঢোকাতে মনোযোগ দেয় জামি।
আগের পর্ব        পরের পর্ব 
রিয়াজ হক, সিডনি
|
Share on Facebook               Home Page             Published on: 31-May-2017
| | |