|
"মিঠে আর কটু মিলে, মিছে আর সত্যি, ঠোকাঠুকি ক'রে হয় রস-উৎপত্তি। মিষ্ট-কটুর মাঝে কোনটা যে মিথ্যে সে কথাটা চাপা থাক কবির সাহিত্যে" রবীন্দ্রনাথের ‘আধুনিকা’ কবিতাংশের উপরের এই বানীকে সামনে রেখে কথোপকথনের শুরু
আগের পর্ব পরের পর্ব
কথোপকথন – (৬) রিয়াজ হক
• "আচ্ছা বলত সিডনীতে আসার কত বছর হল আমাদের"? রাহী নিপুণ হাতে পাউরুটির টোস্টে মাখন লাগাতে লাগাতে প্রশ্নটা ছুড়ে দেয় জামির দিকে।
• "কত বছর আর? এই ছ-সাত বছর হবে বোধ হয়"। আইপ্যাডে শনিবারের সকালের ‘প্রথম আলো’ য় চোখ বুলাতে বুলাতে অনেকটা দায়সারা উত্তর দেয় জামি।
• "আচ্ছা তোমার কি নিজের জীবনের কোন হিসাব আছে? এই তোমার বয়স কত? তোমার জীবনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি? তোমার গন্তব্য কোথায়? কতদূর যেতে চাও? কে কে তোমার সাথে থাকবে বা আছে, ইত্যাদি?
প্রশ্নগুলো শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় জামি। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে, "এত সাত সকালে এত সিরিয়াস অথচ মৌলিক এসব প্রশ্নগুলোর মানে কি"? ‘প্রথম আলো’ থেকে চোখ সরিয়ে, আইপ্যাড বন্ধ করে তার প্রায় ন’ বছরের বিবাহিত জীবনের সঙ্গী রাহীর দিকে অনেক জিজ্ঞাসা ও কৌতূহল নিয়ে তাকায় জামি।
ঘাড় নাড়িয়ে, থুতনি দিয়ে মাথাটাকে উপরের দিকে ঠেলে তুলে যে শারীরিক অভিব্যক্তি সে ছুঁড়ে দেয় রাহীর দিকে তার একটাই অর্থ দাঁড়ায়, "এতগুলো প্রশ্ন একসাথে কেন রাহী? আমার কি কোন ভুল হয়েছে? কোন কারণে তোমার কি মন খারাপ"?
রাহী বলে, "না, গত কিছুদিন ধরেই কথাগুলো ভিতরে ভিতরে ঘুরপাক খাচ্ছিল, তাই জিজ্ঞাসা করলাম। তুমি তো আসার পর থেকে সেই যে একটা অড জবে ঢুকেছ আর কোন চেষ্টা করছ না একটা ভাল জবে ঢুকতে। কেমন জানি গা এলিয়ে পড়ে আছ। মনে হয় যেন মেনে নিয়েছ নিয়তি নির্দিষ্ট তোমার বর্তমান অবস্থান"। কথা শেষে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে রাহী।
তখন অনেকটা আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে জামি জবাব দেয় -
• "না, না, তা কেন হবে? দু’চারটা প্রফেশনাল চাকুরীর এপ্লাই যে করছি না তাতো নয়, তবে হচ্ছে না। মানে কেউ তো ইন্টার্ভিউয়ে ডাকছে না। গ্রাজুয়েশনটা তো এদেশ থেকে নয় ; এখানে ইমিগ্রেশনের জন্য তোমাকে পড়তে হল বলে আমার আর পড়া হল না। তুমি তাও চেষ্টা করে তোমার পড়া শুনার কাছাকাছি একটা চাকরি পেলে কিন্তু আমি সেই যে একটা অড জবে ঢুকে পড়লাম সেখান থেকে আর বেরুতে পারছি না।এরা তো গ্রাজুয়েশনটার খুব মূল্য দেয়। তাই যখন সি ভি তে দেখে গ্রাজুয়েশন বাংলাদেশের তখন সি ভি টা অবহেলা ভরে একপাশে সরিয়ে রাখে। তাছাড়া ঐ লাইনে তো আমার এক্সপিরিয়েন্সও নাই। এটাও বোধহয় একটা বড় কারণ"।
• "তুমি মাইন্ড করো না। এর সবকিছুর বাইরেও, কেন জানি আমার মনে হয় যতটা উদ্যোগী ও পরিশ্রমী তোমার হওয়া দরকার তুমি তা হচ্ছ না। কোথায় যেন তোমার মোটিভেশনের অভাব"। বলে হতাশার ভঙ্গিতে জামির দিকে তাকায় রাহী।
• "হ্যাঁ, তা বলতে পার। জীবনের আমার সবচেয়ে বড় ভুল হয়ে গিয়েছে আমার পড়ালেখা ও পেশা। আসলে আমি কোনদিনও বি বি এ, এম বি এ পড়তে চাইনি। এক্ষেত্রে আমার ইচ্ছার চেয়ে প্রাধান্য পেয়েছে আমার বাবা-মার ইচ্ছা। ফলে অনেকটা আমার পিতা-মাতার মুখের দিকে তাকিয়ে, কষ্ট করে ডিগ্রী শেষ করেছি ঠিকই কিন্তু কোন আনন্দ পাইনি। তাই যতটা আগ্রহ নিয়ে এ পেশায় আমার নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন ততোটা আগ্রহ আমার ভিতর জন্মাচ্ছে না। এখানেই আমি পিছিয়ে। অন্যদিকে সমাজ, রাজনীতি, মানুষ আমাকে যতটা টানে ততটা ব্যবস্থাপনা, হিসাব বা বাণিজ্য নয়"। বলে রাহীর মুখের দিকে তাকায় জামি।
• "তাই বলে তো এখন হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। পার বা না পার তোমাকে চেষ্টাটা চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের আগামীর দিকে তাকিয়ে হলেও তোমাকে একটা পথ খুঁজে বার করতে হবে" ; বলে দু’কাপ চা বানাতে মানাতে গভীর স্নেহ ও ভালোবাসা নিয়ে জামির দিকে তাকায় রাহী।
• "তা ঠিক। আমিও যে এটা বুঝছি না তা নয়। সময় এগিয়ে যাবে, নতুন পরিস্থিতি সামনে আসবে। সবকিছুর জন্য একটা প্রস্তুতি নিয়ে এগুতে হবে। হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। মনে হয়, অড জবের পাশাপাশি প্রয়োজনে নতুন করে আবার পড়াশুনা শুরু করতে হবে"। বলে, জিজ্ঞাসু নেত্রে রাহীর মুখের দিকে তাকায় জামি।
• "প্রয়োজন হলে করবে" বলে জামির দিকে তাকিয়ে জবাব দেয় রাহী। সাথে আরও জোড় দিয়ে বলে, "যাই কর, সিদ্ধান্ত নিয়ে শুরু করে দিতে হবে। আমারা ইতিমধ্যে অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলেছি। তবে পড়ার পাশাপাশি আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের সাথে আমাদের পরিচিতিটাও বাড়াতে হবে। তুমি নিশ্চয়ই জান যে এদেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে চাকুরীর শতকরা সত্তুর ভাগ হচ্ছে রেফারেন্সের মাধ্যমে। তাই সেটাও আমাদের চিন্তার মধ্যে রাখতে হবে"।
• "তুমি ঠিকই বলেছ, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যতটা মেলামেশা, গল্পগুজব, দাওয়াত-ফিরতি দাওয়াত হচ্ছে সেই পরিমাণে নিজের ক্যারিয়ার তৈরি বা চাকুরীর জন্য আমি সময় দিচ্ছি না। বলতে পার এ নিয়ে আমার নিজেরও একটা গিল্টি ফিলিংস আছে। আসলে আমার নিজেকেই নিজে মোটিভেট করতে হবে। গা ঝাড়া দিয়ে শক্ত পায়ে দাঁড়াতে হবে নয়ত অনেক দেরী হয়ে যাবে ও পরিশেষে পস্তাতে হবে" বলে বিষণ্ণ করুন চোখে জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে জামি।
টোস্ট ও চায়ের স্বাদ এই সাত বছরে এতোটা কটু আর কোনদিনও মনে হয়নি জামির। এমন মুহূর্তে জামির খুব কাছে সরে এসে, ডান হাতটা ধীরে ধীরে জামির বা কাঁধে রাখে রাহী। জামি মুখ তুলে তাকায়। রাহীর চোখে-মুখে আশা আর বিশ্বাসের বর্ণিল আলোর আভাস।
আগের পর্ব পরের পর্ব
রিয়াজ হক, সিডনি
|
Share on Facebook               Home Page             Published on: 25-Apr-2017
| | |