|
"মিঠে আর কটু মিলে, মিছে আর সত্যি, ঠোকাঠুকি ক'রে হয় রস-উৎপত্তি। মিষ্ট-কটুর মাঝে কোনটা যে মিথ্যে সে কথাটা চাপা থাক কবির সাহিত্যে" রবীন্দ্রনাথের ‘আধুনিকা’ কবিতাংশের উপরের এই বানীকে সামনে রেখে কথোপকথনের শুরু
আগের পর্ব পরের পর্ব
কথোপকথন – (৩) রিয়াজ হক
"আচ্ছা, তোমার কি মনে আছে যে আগামী উইক-এন্ড এর শনিবার সন্ধ্যায় আমাদের মনির ভাই-রেশমা ভাবীর হাউস ওয়ারমিং পার্টিতে যেতে হবে" কথাটা বলে আই-প্যাড স্ক্রিন থেকে মুখ সরায় রাহী।
রোববার সকালের বিলম্বিত ও বলা যায় কিছুটা প্রলম্বিত ব্রেকফাস্ট সেরে ঈষদুষ্ণ গরম কফির মগে চুমুক দিচ্ছিল জামি।
• "হাঁ, মনে আছে"।
• "তো জনাব, মনে থাকলেই হবে, না তার জন্য কিছু করতে হবে"; উৎসুক আদুরে হাসিমাখা প্রশ্নচ্ছলের মন্তব্য রাহীর।
• "কিছু করার মানে? ওঃ, আগে থেকে গোগল ম্যাপে সার্চ দিয়ে বাসার রুটটা দেখে নিব, তা ছাড়া ‘জি পি এস’ তো আছেই, যাতে বারবার রাস্তা ভুল করে তোমার ক্ষুব্ধ ও আতঙ্কিত চেহারা দেখতে না হয়।
• "একেই বলে পুরুষ মানুষ। ঘোড়ার আগে গাড়ি। আরে মশায়, যাওয়ার জন্য যে ভাল একটা গিফট কিনতে হবে সে খেয়াল আছে"?
• "ওহ, সে জন্য এত চিন্তা কেন? আচ্ছা, আমাদের গত অ্যানিভারসারিতে তো অনেকে নানা ধরনের গিফট দিয়েছিল, যেগুলোর অনেকগুলোই এখন অতিরিক্ত, কোন কাজেও লাগে না, সেখান থেকে কোন গিফট একটা দিয়ে দিলে কেমন হয়"?
• "কি সাংঘাতিক! তুমি বলছ আমাদেরকে দেয়া অন্যের গিফট আমারা চালান করব তৃতীয় আরেকজনকে! এটা তুমি ভাবলে কি করে"? প্রবল উত্তেজিত হয়ে, সোফায় উবু হয়ে বসা, আই-প্যাডে চোখ রাখা রাহী একদম টান টান সোজা হয়ে গভীর অবিশ্বাসী ভঙ্গি নিয়ে তাকায় জামির দিকে।
• "আরে এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন? এর মধ্যে তুমি খারাপ কি দেখলে"? বলে রাহীকে আশ্বস্ত করতে চায় জামি।
• "খারাপ নয় মানে? তোমার সংস্কৃতি ও রুচি কোন পর্যায়ে পৌঁছালে তুমি এমন ভাবনা ভাবতে পার যে একজনের গিফট আরেকজনকে দেয়া যায়! তোমাকে দেয়া প্রতিটা গিফট এর পিছনে একজনের চিন্তা, সময়, শ্রম ও অর্থের যে বিনিয়োগ তাকে তুমি অশ্রদ্ধা করতে পার না"। যেন মোক্ষম যুক্তি দেয়া গেছে এমন স্বস্তির ভঙ্গিতে কথা শেষ করে রাহী।
• "শোন, আমি অত গভীর ভেবে চিন্তে কথাটা বলিনি। আমি বলেছি, জিনিষ ভাল। পড়ে আছে। অতিরিক্ত। দিয়ে দাও। এটা একধরনের প্রাগম্যাটিক ধারনা বলতে পার"।
• "শোন, তোমার ঐ কুযুক্তি দিয়ে ভুলকে সঠিক প্রমাণের চেষ্টা করোনা, এটা আমি মানতে পারবনা"। স্পষ্ট জবাব রাহীর।
• "আচ্ছা, এরকম কি অনেকেই করছে না"? নিজেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা জামির।
• "অনেকে তো অনেক কিছুই করছে। পাঁচজন লোককে বাড়িতে রেঁধে খাওয়াবে বলে দাওয়াত দিয়ে, বাইরে থেকে অর্ডার দিয়ে খাবার নিয়ে আসছে, দশজন লোককে খাওয়াতেও আনন্দ-চিত্তে কাগজের থালা-বাটি সামনে ঠেলে দিচ্ছে। তোমার মত দ্বিতীয় ব্যক্তির গিফট তৃতীয়কে দিচ্ছে। এমনকি প্লাস্টিকের ব্যাগে করে, ন্যূনতম কার্ড-বিহীন উপহার হাতে গছিয়ে দিচ্ছে। তাই বলে কি এর সবই ঠিক, না সৌন্দর্য ও রুচির পরিচায়ক? তুমি যখন কাউকে দাওয়াত দিচ্ছ তখন তার Comfort ও তার আনন্দকে প্রাধান্য দিবে নাকি তোমার স্বস্তি ও তোমার আনন্দকে? আর যাকে তুমি গিফট দিচ্ছ সেখানে তার প্রয়োজন ও গ্রহণযোগ্যতা প্রাধান্য পাবে নাকি তোমার"? একনাগাড়ে এতগুলো কথা বলতে পেরে চোখে মুখে আনন্দের ইলশেগুঁড়ি ঝিলিক খেলে যায় রাহীর। মনে হয়, জীবনের এক অসম যুদ্ধে যেন জিতে গেল সে।
আর অন্যদিকে, প্রস্তর যুগের আদিম মানুষের নির্বাক চেহারা নিয়ে, পাথরের মত বসে থাকে জামি। মনে হয় যেন অনন্তকালের রহস্যময় মাকড়শার নিপুণ জালে আটকে গেছে তার নির্জীব হাত পা। কি কুক্ষণেই যে গিফট Recycle এর কথাটা মাথায় এসেছিল তার!
আগের পর্ব পরের পর্ব
রিয়াজ হক, সিডনি
|
Share on Facebook               Home Page             Published on: 26-Feb-2017
| | |