হাঁচি কাশির সাড়ে-তিন প্রতিক্রিয়া রিয়াজ হক
(প্রথম প্রতিক্রিয়া) অল্প দুতিনটে ছিঁচকে হাঁচি দিতে দিতে মির্জা সাহেব যখন অফিসের কাজ শেষে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলেন, স্ত্রী বাসার দরজা খুলে দিতে দিতে অনুযোগের সুরে বললেন, এই, আবারও তুমি কোথা থেকে ফ্লু নিয়ে ঘরে ঢুকছ। ভাবটা এমন যেন ফ্লু আলু-পেয়াজের মতই সহজ-সুলভ কোন পণ্য, চাইলেই স্থানীয় মুদীর দোকানে কিনতে পাওয়া যায়; হাত বাড়ালেই মেলে মুঠি মুঠি।
মির্জা সাহেব কিছুটা সঙ্কুচিত হলেন। আত্মরক্ষার্থে ব্যাখ্যা দিতে প্রবৃত্ত হলেন। গলাটা সকাল থেকে খুস খুস করছিল। মনে হচ্ছিল কি যেন একটা আটকে আছে গলায়। ছোট ছোট কাশির শেষে এখন হাঁচি হচ্ছে, ঠিক বুঝতে পারছি না। বলে কাপড় ছাড়তে সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে বেডরুমের দিকে যেতে থাকলেন।
তবে যাই কর বাবা, একটু সাবধানে থাক। হাতের কাছে রুমাল বা ট্যিসুর বক্স রাখ। চেপে চেপে কাশ, হাঁচি দাও। খোলা হাঁটে একে ছড়িও না। এটা যেন আবার আমাদের না ধরে।
স্ত্রীর সতর্ক বানী ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে পঞ্চাশোর্ধ মির্জা সাহেবকে আরও ম্রিয়মান ও যবুথবু করে দিল।
উপরে উঠে দরজা বন্ধ করে দিলেন মির্জা। লাগোয়া বাথরুমে হাত মুখ ধুয়ে কিছুটা জিরোলেন। স্থিত হতে সময় নিতে থাকলেন। এর মাঝেই হঠাৎ করে বৈশাখী দমকা হাওয়ার মত নাক মুখের ভেতর থেকে হাঁচি বেড়িয়ে সশব্দে তাকে দেহের বাইরে ছুঁড়ে দিতে চাইল!
এ কেমন হাঁচি! প্রথম অর্ধ ঘণ্টার এক চতুর্থাংশে একটি দুটি থেকে দ্বিতীয় চতুর্থাংশে তা ডাবল ট্রিপল হয়ে যেতে থাকল। অনেকটা চক্রবৃদ্ধি সুধের হারের মত। মনে হল, গলার ভেতর কে যেন অমসৃন চিরল পাতা দিয়ে খোঁচাচ্ছে। নিয়ন্ত্রনহীন নিজের নাক-কান-গলা প্রলম্বিত সুড়সুড়ির চাপে-তাপে ফেটে পড়তে চাইছে। তবে প্রতি হাঁচির পরই মির্জা অনুভব করতে লাগলেন এক উত্তেজনাকর ভাললাগা বোধ।
এভাবে কতটা সময় পার করেছেন খেয়াল নেই; এমনি মুহুর্তে দরজায় স্ত্রীর নক নক। এ শব্দটা এমন পরিচিত যে কালের গর্ভ থেকে উঠে আসা লক্ষ লক্ষ নক নকের শব্দের ভেতর থেকেও একে চিনতে কোনদিনও ভুল করবেন না মির্জা।
কি হল, দরজা বন্ধ করে রেখেছ কেন। হাঁচির জীবাণু সব ছড়িয়ে দিচ্ছ ঘরের ভেতর। মহা জ্বালা দেখছি, দরজা খোল।
মির্জা সন্তর্পনে দরজা খুলে দিলেন। খুলে দেওয়া মাত্রই দমকে দমকে উঠা ভাতের বলকের মতই নাক-মুখ ঠেলে সশব্দে ফেটে পড়ল হাঁচি, একেবারে স্ত্রীর মুখের উপর। স্যরি, স্যরি বলেও শেষ রক্ষা করতে পারলেন না মির্জা।
কত করে বলেছি, তোমার ঠাণ্ডা লাগার বাতিক আছে; পায়ে মোজা দাও, গলায় মাফলার, দরকার হলে বিনি। কান দিয়ে ঠাণ্ডা ঢোকে অথচ আমার কোন কথাই তোমার কান দিয়ে ঢোকে না। এখন হাঁচি কাশি দিয়ে সারা বাড়ি সয়লাব করে তুলছ।
ট্যিসু দিয়ে নাক আর চোখ মুঝতে মুঝতে, সব কথা নিরুপায় হজম করতে করতে, সুবোধ বালকের মত বাক্যহীন নিশ্চুপ হয়ে থাকলেন মির্জা।
ডিনার করতে এসো বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে ত্রস্তে বেড়িয়ে গেলেন মিসেস মির্জা। হাত দিয়ে নিজেই নিজের কপালটা স্পর্শ করলেন মির্জা সাহেব। কিছুটা জোড়াল তাপ অনুভব করলেন। কেমন যেন ঘুম ঘুম জ্বর জ্বর লাগছে। হাত-পায়ে ব্যথা ব্যথা অনুভব। মুখটাও তেঁতো হয়ে উঠছে। ভাবা মাত্রই ঘরের আলো নিভিয়ে, কম্বলটা টেনে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন।
বাতাসে ঘুম পাড়ানি গানের সুরে সুরে, ধীরে ধীরে কলার ভেলায় ভাসতে ভাসতে, মিটি মিটি তারা ভরা আকাশ দেখতে দেখতে, মির্জা তলিয়ে যেতে থাকলেন তন্দ্রাছন্ন স্বপ্নাবেশের গভীরে। এই তন্দ্রা-ঘুম-স্বপ্ন ও জাগরণের ডুবসাঁতারের ভেতর হঠাৎ মনে হল কে যেন নাকের ভেতরে পাখির পালক ঢুকিয়ে খুব হালকা চালে সুরসুরি দিচ্ছে। আর তার সাথেই বাঁধ ভাঙা বন্যার পানির মত ভেতর থেকে ঠেলে ভেঙে বেড়িয়ে এলো সর্বনেশে হাঁচি। হাঁচির প্রকোপে জেগে উঠলেন মির্জা সাহেব।
নীচ থেকে সিঁড়ি ভেঙে দরজার কাছে এসে, প্যাসেজের আলো জ্বালিয়ে, তীব্র দৃষ্টিতে স্ত্রী তাকালেন মির্জা সাহেবের দিকে। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কম্বলের নিচে কেন? তোমাকে না বললাম ডিনার করতে আস।
মির্জা কথা বললেন না। কেবল করুন চোখে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। ধীর লয়ে বিছানা থেকে নেমে গায়ে ফুলহাতা গরম জাম্পার চাপালেন। বাড়তি হিসেবে উপরে আরেকটি জ্যাকেট। গলা ও মাথা মাফলার দিয়ে মুড়িয়ে নিলেন। পায়ে পড়লেন গরম মোজা।
ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে দেখলেন তার দুমেয়েই খাবার নিয়ে বসে গেছে। সম্ভবত গরম কাপড়ে দুমড়ানো মোচড়ান মির্জার অবস্থা দেখে দুজনেই অদ্ভুত অপরিচিত দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। মির্জা ভ্রূক্ষেপ না করে, টেবিল থেকে প্লেট নিয়ে মাত্র ভাপ ওঠা গরম ভাতে চামিচ দিয়েছেন ওমনি ব্রহ্মতালু থেকে জলস্রোতের মত প্রবল এক সুরসুরি হাঁচি আকারে ফেটে পড়ল তার প্লেটের চারিপাশে। বাঁ পাশে বসা ইউনিভার্সিটি পড়া বড় মেয়ে ভূত দেখার মত চমকে চেয়ার ঠেলে বিদ্যুৎ গতিতে উঠে দাঁড়াল। ডানপাশে হাইস্কুলে পড়া ছোট মেয়ে চোখ গোল গোল করে আর্তস্বরে বলে উঠল আব্বু----------উউউ।
রাতে তুমি ভালই ঘুমিয়েছ। দুদুটো পেনাডল ও এন্টিহিস্টামিন ভালই কাজ করেছে মনে হয়। তোমার আর অফিসে যাওয়ার দরকার নেই। ই-মেইল বা টেক্সট করে দাও যে তোমার ফ্লু, তুমি আসছ না, বলে স্ত্রী নিজে অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগল।
পাশের বেড সাইড টেবিল ক্লকটার দিকে ভাল করে তাকিয়ে মির্জা বুঝতে পারলেন সকাল হয়েছে বেশ আগেই। সিডনীর আগস্টের এই শীতের সকালে বাইরে সোনালী রোদের উঁকিঝুঁকি। এখন সকাল সাতটা প্রায়।
শার্টের উপর কোর্ট চাপাতে চাপাতে স্ত্রী বলল, আর শোন, বাসায় ভাল করে কাপড়-চোপড় পড়ে থাকবে। ঠাণ্ডা পানি একদম ধরবে না। গরম পানিতে লেবুর রস মিশিয়ে একটু পর পর খাবে। গরম স্যুপ খাবে। তোমার শরীর থেকে প্রচুর ফ্লুয়িড বেড়িয়ে গেছে, কাজেই লিকুইড খাবে বেশী। আর হ্যাঁ, সকালে নাস্তা শেষে আরো দুটো পেনাডল খেয়ে নিবে। সামান্য বিরতি দিয়ে, আমি যাচ্ছি বলে ঘর ছেড়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন মিসেস মির্জা।
হাঁচিটা দম ধরেছে সত্যি, তবে এখনও নাক দিয়ে একটু একটু করে পানি আসছে। এর মধ্যে অফিসে ম্যানেজারকে টেক্সট করলেন Got sick. Flu. Sorry, not to be in today.
সারাদিন কখনো টিভির নিউজ দেখে, কখনো আই-প্যাডে ফেসবুকে বিচরন করে, কখনো অলস শুয়ে বসে ভারী মাথা ও অবসাদগ্রস্থ শরীর নিয়ে ম্যাড়ম্যাড়ে নিদারুণ অর্থহীন একটা দিন কাটল মির্জার। শুধু কাজের কাজ, একটু পর পর নাক মোছার ট্যিসু দিয়ে ভরে গেল রান্নাঘরের গার্বেজ বিন।
(দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া) পেনাডল ও টেলফাস্টে কাজ হয় দারুন। অন্তত মির্জার ক্ষেত্রে এটা বরাবরই ভীষণ সত্যি। ছত্ত্রিশ ঘন্টায় ছছটি পেনাডল মির্জার শরীরকে অসাড় ও নিস্তেজ করে ফেলেছে সন্দেহ নাই। শরীরের জোড়াল তাপ চলে গিয়ে, ঘাম দিয়ে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। জানালার ব্লাইন্ডের ফাঁক গলে সকালের আলো তির্যক রেখার আদলে ঘরে এসে পড়ছে। কিন্তু তারপরও মির্জা পুরোপুরি চোখ খুলতে পারছেন না।
কাছে এসে স্ত্রী বলছে, এই, তুমি কি ঘুম থেকে উঠেছ? তোমাকে বেশ দুর্বল দেখাচ্ছে। তুমি আজও অফিসে যেতে পারবে না। তোমাকে বিশ্রাম নিতে হবে ও বেশী করে এনার্জি ড্রিঙ্কস খেতে হবে।
মির্জা সবই শুনছেন, কিন্তু সাড়া দেবার মত শক্তি সঞ্চয় করে উঠতে পারছেন না। তন্দ্রা ও জাগরনের দ্রবীভূত মিশ্রণের ভেতর ডুবে আছে তার সারা শরীর ও মন।
এভাবে কতটা সময় পার করেছেন খেয়াল নেই। মোবাইলের টিং টিং শব্দে চোখ মেলে তাকালেন মির্জা। বেড-সাইড টেবিল থেকে ফোন তুলে দেখলেন ম্যানেজারের ফোন। হ্যালো বলতেই ম্যানেজার জানতে চাইল মির্জা আজও অসুস্থ কি না, অফিসে আসছে কি না।
ম্যানেজার ভারতীয়। এক গুচ্ছ উপদেশ বানীতে ঝংকৃত করে তুললেন ফোন। মির্জা যে শরীরের প্রতি যথেষ্ট অবহেলা করেন, শীতে প্রয়োজন মত কাপড় পড়েন না, এমন কি প্রচন্ড শীতেও রুমের হিটার অন করতে ভুলে যান ইত্যাদি ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, অহেতুক ফ্লু বাঁধিয়ে কাজে না আসায় যে কোম্পানির বিশেষ ক্ষতি হচ্ছে আকারে ইঙ্গিতে সে কথা বুঝিয়ে দিতেও ভুল করলেন না তিনি।
এখন সকাল এগারটা।
মির্জার মন ও মুখ তেঁতোয় ভরা। এসব পেনাডলের ফল বলে তার মনে হল।
বিছানা ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে টোস্ট আর গরম কফি নিয়ে জানালার ধারে চেয়ারে বসলেন মির্জা। বাইরে ঝকঝকে রোদ। সাদা-নীলে ভরা সামিয়ানা আকাশ। রোদে ভেজা সবুজ গাছগুলো মনোরম। আতসি কাঁচের মত চারদিকের সব পরিষ্কার। নির্মল। প্রকৃতি যে এত শান্ত ও সুন্দর হতে পারে তা আগে কখনও এভাবে চোখে পড়েনি মির্জার।
চোখে পড়বে কি ভাবে? সময়ের এ প্রহরগুলো তো বরাবর কাটে কাজ ও ব্যস্ততার মাঝে।
(তৃতীয় প্রতিক্রিয়া) দুর্বল শরীর নিয়েও মির্জা ধীরে ধীরে প্যান্ট-শার্ট পড়লেন। নীচে গ্যারাজে গেলেন। গাড়ি বের করলেন। বাসার কাছেই জি পির চেম্বারে যেতে হবে। আগামী কাল অফিসে যোগদানের আগেই মেডিকেল সার্টিফিকেট নিতে হবে।
ডাক্তার মধ্যবয়স্কা, শ্রীলঙ্কান। খুবই অমায়িক, কথা বলেন মিষ্টি স্বরে। বললেন, মির্জার Viral respiratory infection এর কারনে জ্বর ও হাঁচি হচ্ছিল। ফ্লুর কারন হিসেবে তিনি তিনটে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস এ, বি ও সি এর কথা বললেন। এ ভাইরাস প্রাণীকুল যেমন হাঁস, মুরগী, শুঁকর, ঘোড়া প্রভৃতিতে পাওয়া যায়। বি ভাইরাস ব্যপকভাবে মানুষের মধ্যে। এটা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ছড়ায়।
এই ভাইরাস বাতাসেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর এটা বাইরের বাতাসের চেয়ে ঘরের বাতাসেই দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকে। কারন ঘরের বাতাসের আদ্রতা কম। আর আমরাও শীতের প্রকোপের কারনে ঘরে বেশী সময় কাটাই বলে এ আমাদের পেয়ে বসে।
এটা এখন প্রচুর লোককে সংক্রমিত করছে। মজা করে বললেন এটা চাইতে হয় না, আকুল করা বসন্ত বাতাসের মত এমনি এসে জড়িয়ে ধরে। অর্থাৎ, এটা seasonal; চিন্তার কোন কারন নেই। তবে এর বিস্তৃতি রোধে বা একে সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ফ্লু আক্রান্ত ব্যক্তিকে মুখ ঢেকে হাঁচি-কাশি দিতে অভ্যাস করা, হাত পরিস্কার রাখা সেই সঙ্গে প্রচুর তরল খাবার ও ঘুমের প্রয়োজন বলে বললেন। আরও বিশ্রাম নেওয়া দরকার বলেও মত প্রকাশ করলেন। তবে মির্জা যদি মনে করেন তার কাজে যাওয়া খুব জরুরী ও শরীরে শক্তি পাচ্ছেন তবে তিনি বাধা দিতে চান না।
(শেষ প্রতিক্রিয়া) দুদিন ছুটি কাটানোর পর ফ্লুর চতুর্থ দিনে অফিসে ঢোকার মুহুর্তে গেটে দেখা হল একাউন্টটেন্টের সাথে। মহিলা চায়নিজ। মির্জাকে দেখেই অপ্রত্যাশিত অশরীরী আত্মা দেখার মতই চমকে উঠল। বলল, তোমার না ফ্লু, তুমি না অসুস্থ। ফ্লুর তো তিনদিনও যায়নি, তুমি কেন এত তাড়াতাড়ি অফিসে এসেছ? বলে, কমছে কম তার থেকে তিন হাত দূরত্ব বজায় রেখে দ্রুত গতিতে অফিসে ঢুকে গেল।
শুরুতে ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে মির্জা গেলেন তার রুমে। ম্যানেজার খুশী হলেন। তাকে ধন্যবাদ জানালেন তাড়াতাড়ি কাজে ফিরে আসার জন্য। প্রশংসা করলেন তার শারীরিক যোগ্যতা ও কাজের প্রতি অদম্য আগ্রহকে। হাত বাড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে করমর্দন করলেন।
মির্জা দুর্বল শরীরেও পাংশু হেসে, কোন কথা না বলে নিজের রুমের দিকে অবিচল নিঃশব্দে হাঁটতে থাকলেন।
রিয়াজ হক, সিডনি
|