গল্প
মিজান সাহেবের স্বদেশ যাত্রা রিয়াজ হক
(এক)
পেশায় প্রকৌশলী মিজান সাহেবের বয়স এখন প্রায় ষাট। যত ধরনের রোগ এ বয়সে একজন মানুষের ভেতর বাস করে সুখ পায় তার সবই মিজান সাহেবের ভিতর মহানন্দে জায়গা করে নিয়েছে। মিজান সাহেবকে চঞ্চল শিশুর মতই ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে তার প্রধান রোগ ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র। ঘন ঘন বাথরুম ধরা ও যাওয়া, প্রচুর পানির তেষ্টা ও পান, ঘণ্টা দুই পরপর ক্ষুধার্ত হওয়া ও কিছু মুখে দেওয়া, অল্পতেই অবসন্ন ও ক্লান্তির ভারে চেয়ারে গা এলিয়ে দেওয়া তার সারাদিনের নিয়মিত কর্মকাণ্ডেরই একটা বড় অংশ। এর সাথে রয়েছে উচ্চ রক্তচাপ। এটা জন্মেছে সারাক্ষণ ঘরে-বাইরে নেতিবাচক ধ্যান-ধারনার প্রতিপালন, দৈনন্দিন জীবন যাপনে প্রতিটি ঘটনা ও সমস্যার প্রেক্ষিতে জন্ম নেওয়া স্বয়ংক্রিয় ঐ ভয়ঙ্কর চিত্ত-চাঞ্চল্যের সৌজন্যে। এগুলো আমার কথা নয়, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অভিমত।
বিধাতা মিজান সাহেবকে পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত কিঞ্চিৎ মেধা ও বহুমূত্র রোগ ছাড়া এমন কোন পার্থিব সম্পত্তির প্রাপ্তিযোগে ভাগ্যবান প্রতিপন্ন করেননি যে তার ফলশ্রুতিতে তাকে কাজ-কর্ম না করে প্রাচীন যুগের নবাবদের মত শকট চড়ে, হাওয়া খেয়ে ও বুলবুলি উড়িয়ে জীবনাতিপাত করতে পারবেন। মেধা মিজান সাহেবকে তাড়িত করেছে এক নিঃশ্বাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে ‘বি সি এস’ দিয়ে চাকুরীর নিয়োগ পত্র নিয়ে বর্ধিত পরিবারের সেবায় আত্মনিয়োগ করার জন্য। রিটায়ার্ড, বেশী বয়সে সন্তানের পিতা, আজীবন সৎ ও হতোদ্যম সরকারী কর্মকর্তা বাবা, ঘরের হাড়ভাঙা খাটুনীতে ন্যুব্জ-দেহ মা, কলেজ পাশ করা দুটি বিবাহযোগ্যা বোন ও স্কুল পড়ুয়া ছোট দুটি ভাইয়ের সমুদয় দায়িত্ব অতি অল্প বয়সেই নিজের কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল মিজান সাহেবকে। তারপরও যখন হিমসিম অবস্থা, নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তখন সরকারী চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমাতে হয়েছিল সোনার হরিণের আশায়। আসলে রক্তচাপের শুরু হয়েছিল চাকুরী নিয়ে প্রথম দেশ ত্যাগের গোড়াতেই। এয়ারপোর্ট, কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, লাগেজ কোথায়-কাকে-কিভাবে সামাল দিবেন ও কোন পদ্ধতিতে সউদি আরব নামক এক অচেনা অপরিচিত দেশের নিয়োগ কর্তাদের আদরে-আমলে থেকে চাকুরী সামলাবেন এসব ভেবে অস্থিরতা ও এর পুঙ্খানুপুঙ্খ সমাধান খুঁজে বের করতে বিভোর হয়েই রক্তচাপের মাত্রা উত্তরোত্তর বাড়িয়ে চলেছিলেন বলে মনে হয়। মাথাধরা এরই উপসর্গ কিনা জানেন না; তবে এটিও এখন তার জীবন যাপনের অংশ হয়ে গেছে। এ এমন এক মাথা ধরা যা প্রকাশে বাংলা ভাষায় ব্যবহারযোগ্য সব শব্দই প্রায় অপ্রতুল! মাথার দু’পাশে দু’টনের দু’টি এবড়োথেবড়ো পাথর দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে চাঁপা দিলে যে অনুভূতি হবে এটা অনেকটা তাই। চারপাশের আলো ও শব্দেরা তখন আচ্ছন্ন ও এলোমেলো হয়ে যায়। দৃষ্টি জুড়ে তখন ভেসে উঠে কুয়াশার চাদরে ঘেরা শরতের সকাল। মেঘমেদুর। বিষণ্ণ। করুন।
দু’বছর পর সউদি আরব থেকে ছুটিতে এসে ‘বিবাহ’ নামক এক অমৃত-জালের জটিলতায় আঁটকে পড়ে পিং পং বলের মত মা ও নিজের এ দু’সংসারের এপাশ ওপাশ বাড়ি খেতে খেতে সেই যে উচ্চ রক্তচাপের প্রতিষেধক ঔষধের শরণাপন্ন হয়েছিলেন আজ অবধি তা বয়ে চলেছেন।
বুদ্ধিমতী স্ত্রীর পরামর্শ ও আগ্রহের কাছে নিরুপায় আত্মসমর্পণ করেই মিজান সাহেবের অস্ট্রেলিয়ায় আসা। বিদেশ মানেই প্রখ্যাত চিত্রকরদের ছবির মতই চিত্রময় দেশ, সম্পন্ন সজীব মানুষ, রোগ-শোক বালা-মুসিবতহীন এক অনন্য স্বপ্ন-পুরী। যেখানে সবই ছন্দময়। যেখানে সবাই আহ্লাদিত ও আমোদিত। যেখানে সবার হাতেই যাদুর কাঠি। ভালো রোজগার, ভাল বাড়ি-গাড়ি; সুশ্রী-সুন্দর, সুখী সুখী চেহারার আদরের সন্তানেরা। এর কতটা মিথ, কতটা সত্য বা অর্ধ সত্য তা নিয়ে নিজেকে আর প্রশ্ন করতে চান না মিজান সাহেব। তিনি জানেন এর সবই আপেক্ষিক। কে কোন পটভূমি থেকে এসব দেখছে, প্রশ্ন করছে ও উত্তর খুঁজে পাচ্ছে তাই প্রণিধানযোগ্য, অন্য কিছু নয়। এখানের variables গুলো অনেক। একের সঙ্গে অন্যের মেলাই অস্বাভাবিক। না মেলাই স্বাভাবিক। হ্যাঁ, নিজের বর্ধিত পরিবারের কিছু সমস্যার সমাধান হয়ত হয়েছিল তাতে সন্দেহ নাই। বেশ টাকা পয়সা খরচ করে পরপর দু’টি বোনের বিয়ে দিতে পেরেছিলেন। যদিও বিয়ের মাত্র চার বছরের মাথায় বড়টি একমাত্র কন্যা সন্তানসহ স্বামীর কাছ থেকে ডিভোর্স নিয়ে আবার বাবার পরিবারেই ফিরে এসেছিল। অভিযোগ স্বামী ছিল মাদকাসক্ত। চার বছরের খুব কম দিনই বাদ গেছে যে সে তার হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়নি। ছোটটি স্বামী-সন্তান সহ এখন লন্ডনে। অবৈধ ভাবে বাস করছে গত পনের বছর। অড যব করে ভালই আছে। তবে যে কোন মুহূর্তে ফিরে যেতে হতে পারে দেশে। ব্রেক্সিটের পর এ সম্ভাবনা আরও প্রবল হয়েছে বলা যায়। আফসোস, অস্ট্রেলিয়ায় আসার জন্যও ঘাটতি রয়েছে এদের যোগ্যতায়। ছোট দুটি ভাই পড়াশুনা শেষ করে, বিয়ে করে ছেলেমেয়ে সহ আলাদা আলাদা সংসার করছে। প্রাচুর্য না থাকলেও তাদের সংসারে সচ্ছলতা আছে একথা বলা যায়।
নিজের দিকে তাকালে মিশ্র সাফল্যই বলতে হবে। ঠিক যেভাবে ছবির মত চিত্রপট জীবন চেয়েছিলেন সেভাবে হয়নি। বড় ছেলেটির সঙ্গে কখনোই মতের মিল হয়নি মিজান সাহেবের। মেধা কম ছিল না। এইচ এস সি তে শতকরা নিরানব্বুই ভাগ নম্বর নিয়েও ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিসিন কিছুই না পড়ে চলে গেল জার্নালিজম পড়তে। মাঝ পথে তা পরিবর্তন করে চলে গেল সাইকোলজিতে। এসব নিয়ে সবসময় কূটতর্ক ও শীতল যুদ্ধ লেগেই ছিল ছেলেটির সঙ্গে। এক পর্যায়ে সে পরিবার থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। শোনা যায় সে সিটিতে একটি এপার্টমেন্টে থাকে, লিভিং টুগেদার করছে এদেশীয় এক মেয়ের সাথে। মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও পিতা তার কাছে অপাংতেয়। ধর্তব্যের বাইরে। মূল্যহীন।
মেঝ ছেলেটি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে সিডনী ইউনিতে। মেয়েটি ‘ল’ তে নিউ সাউথ ওয়েলস এ। মিজান সাহেব সিডনীর বিত্তশালীদের একটি এলাকায় বাস করেন। প্রচলিত অর্থে ‘ওয়াও’ বলার মতন গাড়ি বাড়ি সবই হয়েছে যা সাধারণের চোখে ঈর্ষার কারণ বলে প্রতিভাত হতে পারে। কিন্তু দিনের শেষে ‘সুখ’ বা ‘সুখী’ বলে যে কথা তা কি তিনি অর্জন করতে পেরেছেন? ‘পারেন নি’, অন্তত নিজের সম্পর্কে মিজান সাহেবের মূল্যায়ন তাই। স্ত্রীকে পরিষ্কার করে বলেন নি তবে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন আর দু’মাসের মাথায় তার ষাট পূর্ণ হলে, ঐচ্ছিক অবসর নিয়ে দেশে ফিরে পিতা-পিতামহের জেলা শহরের প্রান্তে একেবারে গ্রাম ঘেঁষে তৈরি দোচালা টিনের ঘরটিতে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটাবেন।
ছেলে বেলার সেই গ্রাম; সেই গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবাঁধা, হা ডু ডু। সেই নদী; উদ্দাম তরঙ্গ, নৌকা বাওয়া, মাছ ধরা। নিভু নিভু হ্যারিকেনের আলোয়, রাত জেগে সুর করে নিয়াজ কাকার পুঁথি পাঠ শোনায় মগ্ন হওয়া। তিন মাইল হেঁটে পায়ে পথের ধুলো মেখে বাজারে যাওয়া এসব তাকে নিশির বাঁশির মত টানছে সেই জীবনের দিকে।
(দেড়) এ্যাম্বুলেন্সের অবিরত তীব্র সাইরেনে, মিটি মিটি প্রদীপ শিখার মত চেতনা জেগে আবার যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে চায় এমনি অবস্থা মিজান সাহেবের। মিজান সাহেব বুঝতে পারছেন তিনি দ্রুতগামী কোন এ্যাম্বুলেন্সের ভিতর শুয়ে আছেন, নাকে অক্সিজেনের নল লাগানো। পাশে তার অফিস কলিগের আবছায়া মুখ। মনে পড়তে থাকে, সকালে অফিসে এসেই বুকের বাঁ পাশ, কাঁধ সহ হাতে বেশ ব্যথা অনুভব করছিলেন। এক পর্যায়ে হাত অসাড় হয়ে আসছিল। পাশের রুমে তার কলিগ ড্যানিয়েল কে তা বলতে যেয়ে আর শেষ করতে পারেন নি, ঢলে পড়ে যাচ্ছিলেন মেঝেতে।
তারপর সব তমসাচ্ছন্ন। অযুত দিনের শ্রান্তির ঘুম। লোকালয়হীন শূন্য পৃথিবী।
সিডনী , সেপ্টেম্বর ২০১৬
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|