গল্প হলোনা দুলাভাই রিয়াজ হক
এক যুগেরও বেশী হয়ে গেল স্থায়ীভাবে দেশ ছেড়েছি। আমার ছেলে নাঈম সিডনীতে এসে ক্লাস ওয়ান এ (এরা বলে ইয়ার ওয়ান ) ভর্তি হয়েছিল। ও এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ; আত্মীয়রা বলে, নাঈমের শিক্ষাজীবন হল তোমার সিডনী জীবনবাসের মাপকাঠি। এদেশে এসে স্বজনদের আদর, বন্ধুদের ভালোবাসা, পরিচিত পথঘাট সব হারিয়েছি। হারিয়েছি শৈশবের অফুরন্ত প্রাণশক্তি, যৌবনের অনন্ত উচ্ছ্বাস, বাঁধা বন্ধনহীন ‘দিবা রাত্রির কাব্য’। সবচেয়ে বেশী করে হারিয়েছি বন্ধুদের সঙ্গে নির্ভেজাল আড্ডার অবিমিশ্র অতল সুখ। একে ভাষায় বর্ণনা করা যায়না, কোন সেতার সাধকের করুণ রাগিণীও তা প্রকাশে অক্ষম। তাই চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকি, দেশ থেকে যদি কোন প্রিয়জন আসে; ভালোলাগে, গল্পে, আড্ডায়, ভ্রমণে মাতোয়ারা হয়ে ভুলে যেতে চাই পুরনো বন্ধু ও স্বজনহীন এ প্রবাস জীবন।
৬ ই মে সন্ধ্যায় আমি তরুণকে Text করেছিলাম ‘তোমার মা কি সিডনীতে এসে পৌঁছেছে ?’ উত্তর এলো রাত এগারটায় " Abba-ammu has arrived an hour back-will speak to you tomorrow". ‘তরুণ’ আমার খালাতো-মামাতো-চাচাতো-ফুফাতো ভাইবোনদের সবার বড় মঞ্জু আপার তৃতীয় সন্তান। দারুণ মেধাবী, চলতে-বলতে ঝলসে উঠে তরুণের তারুণ্য। ও কাজ করে Westpac Bank এ। থাকে Epping এ। ওর কাছেই থাকবেন মঞ্জু আপা – দুলাভাই।
২০১৪ এর October এ আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম। শুনলাম, তরুণের PR হয়েছে Australia য়। আমি সবচেয়ে বেশী খুশী হয়েছিলাম এ ভেবে যে তাহলে ওর বাবা-মা আসবে, আর গল্পে-আড্ডায় মধুর সময় কাটবে আমাদের। তরুণের বাবা, আমাদের বড় দুলাভাই একজন বিদগ্ধ আড্ডাবাজ। ১৯৬৯ তে মঞ্জু আপার বিয়ের পর থেকেই দেখছি গল্পের আসর মাত করায় ওনার জুরি মেলা ভার।
আমাদের পরিবারে-সমাজে দুধরনের মানুষ আছে; এক ধরনের মানুষের সঙ্গে কথা বলা যায় - যা খুবই মামুলি, সাধারণ মানের, মৌলিকতা হীন। আরেক ধরনের মানুষের সঙ্গে গল্প করা যায়। সে গল্পে পাণ্ডিত্য থাকে, রস থাকে, থাকে জীবন ছুঁয়ে যাওয়া আনন্দ সমীরণ। তরুণের বাবা, আমাদের বড় দুলাভাই হচ্ছেন এমন একজন মানুষ।
ভাবতে অবাক লাগে, দুলাভাইয়ের সঙ্গে চেনাজানা আমার জন্মের মতই পুরনো। সেই ৭০ দশকের শুরু থেকেই দুলাভাইয়ের কথার যাদুতে মুগ্ধ আমরা। হেন কোন বিষয় নেই যা নিয়ে তার আগ্রহ ও উচ্ছ্বাস নেই। খেলা, সে ক্রিকেট বা ফুটবল হোক, হোকনা দাঁড়িয়াবাঁধা; রাজনীতি, দেশ বা বিদেশের, ধর্ম-সংস্কৃতি, চলচিচত্র, সঙ্গীত সব বিষয়েই দুলাভাইয়ের বিপুল আগ্রহ। বলতে পারেন অনায়াসেই, সাবলীল ভাবেই। আমরা ছোটরা হাঁ হয়ে শুনি, আমরা ওনার গুণমুগ্ধ, উনি আমাদের হিরো। আজ থেকে ৪০ বছর আগের কথা, উনার কাছে আমি খলিল জীবরানের ‘The Prophet’ এর কথা শুনি, উনি বলতেন Machiavelli র ‘The Prince’ এর কথা। আমাকে বলতেন সব মৌলিক বিশ্বসাহিত্য সমৃদ্ধ বই পড়ার কথা।
২০১৪ এর October এ আমার মেয়ে ফারাহ সহ ঢাকায় যাই। ফারাহ তখন মাত্র HSC শেষ করেছে, অনেক অবসর। ওর খুব ইচ্ছে, ‘Vibrant Dhaka’ ঘুরে আসা। সেই সময় দুলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা, বললাম, ‘দুলাভাই, তরুণ যে আপনার ও মঞ্জু আপার ছেলে এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। ও সিডনী ঘুরে এলো অথচ আমাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ করলো না’। উনি বললেন, ‘মামা হয়ে তুমিও তো খবর নিতে পারতে’। আমি বললাম, ‘ভালই বলেছেন, আমি আমার নিজের মামার খবর নিব আবার ভাগ্নেরও খবর নিব, আমার খবর নেবার কেও নেই’। উনি বুঝতে পারলেন, বললেন, ‘ওঁকে এরপর নির্দেশ পাঠাবো যে জুয়েল মামার খবর না নিয়ে সিডনী ঢুকতে ও বেরুতে পারবে না, এবার বল কেমন আছ’। তারপর যথারীতি দেশ, সমাজ, রাজনীতি নিয়ে অনেক কথা হল, যা তীব্র অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন ও গভীর। বিভক্ত কোন পরিবার, সমাজ বা দেশই যে মেরুদণ্ড সোজা করে তার পুষ্টি ও সৌন্দর্য নিয়ে বিকশিত হতে পারেনা তা উনার কথায় ফুটে উঠেছিলো। ঢাকা ছাড়ার আগে ওনাকে আমি মহিউদ্দিন আহমেদের ‘জাসদের উত্থান-পতন’ বইটি উপহার দিয়েছিলাম। উনি আমাকে উপহার দিয়াছিলেন ওনার নিজের লেখা আত্মজীবনীমূলক বই ‘The Lengthening Shadow’। নেত্রকোনা-মোহনগঞ্জের অজ পাড়াগাঁ পালগাঁ থেকে উঠে আসা তাঁর জীবনের এক চিত্তাকর্ষক কাহিনী। বইটি নিয়ে আমার একটিই অভিযোগ ছিল যে একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসে রূপান্তরের প্লট, চিত্রনাট্য ও চরিত্র সমষ্টি থাকা সত্ত্বেও এটি ‘শেষ হইয়াও হইলোনা শেষ’ ছোট গল্পের আকারে একরকম হাহাকার নিয়েই শেষ হয়েছে।
দুলাভাই মারাত্মক তাস খেলতে পারতেন। তাসের সর্বরকম খেলায় পারদর্শী এমন আরেকজনের গল্পই আমার জানা আছে; তিনি আমাদের জামান ভাই। জামান ভাই এক সময়ের বুয়েট চ্যাম্পিয়ন। যাক, জীবনে দু-চার বার দুলাভাইয়ের পাটনার হওয়ার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল। আমার আনাড়িপনা ভুলের শাস্তি স্বরূপ তার চাহনির তীব্র দহনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়েছি তা বলাই বাহুল্য।
তাই এবার দুলাভাইয়ের সাথে গল্প হবে অনেক, চর্যাপদ থেকে হুমায়ূন পরবর্তী বাংলা সাহিত্য, পেলে থেকে মেসি, Bradman থেকে মুস্তাফিজুর, গান্ধী থেকে মোদী, মোঃ রফি থেকে অরজিত সিং আর হবে তাস খেলা; আসরে নিমন্ত্রণ জানাবো জামান ভাইকেও। আমার উসখুস মন অপেক্ষা করছে তরুণের ফোনের জন্য।
৭ ই মে শনিবার সারাদিন বাজার, কাপড় ধোয়া, ঘর পরিষ্কার সত্ত্বেও আশা করছি যে কোনও মুহূর্তে তরুণ বলবে, আব্বা আম্মার বিশ্রাম নেওয়া শেষ, চলে আসেন। রাতে দাওয়াত ছিল প্রতিবেশী বাঙ্গালীর বাড়িতে; শেষ হতে হতে মধ্যরাত। তরুণের কোন ফোন পেলাম না, ভাবলাম এখনো মঞ্জু আপা দুলাভাইয়ের jet lag চলছে। আগামী বিকেলেই দেখা করতে যাব।
৮ ই মে রবিবার ঘুম থেকে উঠেই যে Text পেলাম, তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না মোটেও। তরুণের খালাত বোন, আমার ভাগ্নি সুরূপার পাঠানো Text :
"As-salam mama, as you know boro khalu and Monju aunty arrived in Sydney this Friday night. Boro khalu is severely sick now. This morning he has been admitted into Ryde hospital, Deniston St. with severe pneumonia and infected lungs. Please keep him on your prayers".
তখন সকাল ন’টা। কোনমতে মুখে কিছু দিয়ে তাড়াতাড়ি শানুকে নিয়ে ছুটলাম
Ryde hospital এ। Ryde emergency waiting এ পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে, মাথা ধরে বসেছিলেন মঞ্জু আপা। শানুর হাত ধরে বলে উঠলেন, ‘কেন এমন হল শানু’? কত পরিকল্পনা, সিডনীতে আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা করা, গল্প গুজব, বেড়ানো (Canberra, Melbourne), Perth এ লাবণ্যকে দেখে তারপর ঢাকায় ফিরে যাওয়া।
সকাল দশটায় হসপিটাল বলল দুলাভাইয়ের অবস্থা "Critical."
সকাল এগারোটায় "Critical & Unstable".
সকাল বারটা ত্রিশ মিনিটে দুলাভাই আর নেই; দুলাভাই চলে গেছেন এ জগতের সব বন্ধন ছিন্ন করে।
ঘটনার অবিশ্বাস্য দ্রুততায় আমরা সবাই হতভম্ব, বিমর্ষ ও অসহায় হয়ে পড়লাম। কত গল্প ছিল দুলাভাই, সেই গল্পগুলো আপনার ওই ‘Lengthening Shadow’ এর মতোই কেবল দীর্ঘ ছায়া হয়ে রইল।
ভাল থাকেন, আপনার আত্মা শান্তি লাভ করুক।
রিয়াজ হক, সিডনী, পহেলা জুন ২০১৬
|