ফেসবুকে ‘আমি, সে ও সখা’ রিয়াজ হক
গোড়াতেই ফেসবুক সম্পর্কে গুটিকয় সাধারণ তথ্য দিয়ে চলে যাচ্ছি ফেসবুকের মূল ব্যবহারকারীদের কাছে। এরা কারা? কিভাবে আপনি এদের দেখেন। এরাই বা ফেসবুককে কি কাজে ব্যবহার করছেন।
সাধারণ তথ্য সবাই জানেন, তবুও বলছি (কারণ বাঙালি বাড়তি কথা না বললে শান্তি পায় না, তাই):
• ফেসবুক একটি সামাজিক সম্পর্ক রক্ষার মাধ্যম (social networking service )।
• এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জন্মগ্রহণকারী, তৎকালীন হার্ভার্ডের ছাত্র, বর্তমানে বত্রিশ বছর বয়স্ক মার্ক জুকারবার্গ। তার সঙ্গে আরও ছিলেন তারই ইউনিভার্সিটি রুমমেট এডওয়ার্ডও সেভারিন।
• এটিকে প্রথম অবমুক্ত করা হয় ২০০৪ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি।
• প্রথমে এটি কেবল যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে হার্ভার্ডের ছাত্রদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়।
• পরে এটিকে হার্ভার্ডের বোস্টন এরিয়ার অন্যান্য কলেজের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়।
• আরও পরে এটাকে কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশীরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্পোরেশনের সঙ্গে সংযুক্ত করে এর পরিধি বাড়ান হয়।
• ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে এই ফেসবুকে, বয়স তের বা তদূর্ধ্ব ব্যক্তিদের, যাদেরই ই-মেল রয়েছে তাদেরকে এর সদস্যপদ নিতে উন্মুক্ত আহ্বান জানান হয়।
আমার পর্যবেক্ষণে, ফেসবুকে আপনি নিম্ন বর্ণিত ব্যক্তিদের উপস্থিতি লক্ষ্য করবেন। এটা অনেকটা সিম্পটম দেখে ব্যবহারকারীদের শ্রেণীবিন্যাস। বলা বাহুল্য, এর বাইরে যারা ভারসাম্যমূলক বৈচিত্র্যময় পোস্টিং দিচ্ছেন, তাদেরকে এ শ্রেণীবিন্যাসের বাইরে রাখছি। ইচ্ছে করলে আপনি এতে আরও সংযোগ ঘটাতে পারেন।
এক. আপনাতে আপনি বিভোর
• "আমি এখন বসুন্ধরার অনিন্দ্য পারকিং লটে..............." • "আমি এখন জামদানী হাউসের আমদানি শাড়িতে........." • "আমি রোদেলা দুপুরে, মধ্য পুকুরে....................." • "আমি আমার পতি, পুত্র, কন্যা সহ গাউছিয়ার পুষ্প-কুঞ্জে............"
এদের এসব পোস্টিং থেকে অনায়াসে বলতে পারেন, ‘আমি’ ‘আমি’ আর ‘আমি’ হল এদের বিশেষত্ব। নিজের প্রেমে এরা নিজেই মশগুল। এদের চারপাশে অন্য কোন মানুষ, বৃক্ষ বা বিহঙ্গ কেউ নেই!
দুই. খাই-দাই-গান গাই, তাইরে নাইরে না
• "এখন সকালের ব্রেকফাস্টে আছি ‘চাও চেন চিউ’ তে.................." • "গতরাতে হাবিসহ মধুমিতায় দেখেছি ‘গনগনে প্রেমের আগুন’..............." • " ‘হাসি’, ‘খুশী’, ‘শশী’ সহ সোহরাওয়ারদি উদ্যানের গাছ-গাছালির ফাঁকে ফাঁকে লুকোচুরি খেলায় ....................." • "কাল যাচ্ছি সিঙ্গাপুরে/ জীবন সাথী সঙ্গে করে/ যে আমার হৃদয় জুড়ে........."
এদের দেখলে মনে হয় ; জীবনে কোন সমস্যা নেই। রাজনীতি নেই। গুম, হত্যা, খুন নেই। বেদনা নেই। এদের জীবন অনেক মধুর ও আনন্দময়!
তিন. জন্ম থেকে জ্বলছি
• "ভিডিওটি শেয়ার করুন, দেখুন কিভাবে পুলিশ প্যান্ট খুলে নিচ্ছে সাধারণ জনতার............" • "দেখুন, মর্মান্তিক আত্মঘাতী বোমা হামলায় ইস্তাম্বুলের কামাল আতাতুর্ক বিমান বন্দরে মানুষের ছিন্ন ভিন্ন দেহ....................." • "দেখুন, কেমন করে পাইথন চেপে ধরে শ্বাস রোধ করছে কুমিরের ............"
এরা জন্ম থেকেই বিদ্রোহী। এদের জীবন সাদামাটা, বিষাদময়। এরা সবসময় জীবনে খোঁজে বিপুল উত্তেজনা। এরা আবার কখনো কখনো মরবিডও বটে। জীবনের সব ঋণাত্মক ঘটনা এদেরকে চুম্বকের মত একদিক থেকে প্রবল বেগে টেনে নিয়ে যায়।
চার. বোবার কোন শত্রু নেই
কালে-ভদ্রে এরা পোস্টিং দেয়। কখনো ছ’মাসে বা বছরে -
• "মনে হয় যাচ্ছি চলে ভিনদেশে/ নতুন বেশে".................. • "ইচ্ছে করে শূন্যে মেলি পাখা"........................... • "ক’পা এগুলে আবার দেখা পাব তোমার / জীবনের সর্বত্র মেনেছি তোমার কাছে হার".................. • "............আর আছে লজ্জা, ভয় ও নিরাশার সমাজ/তাকে পাহারা দেয়, দুর্বিনীত রাষ্ট্রের একচক্ষু তীরন্দাজ"
এরা সব কিছুতে রহস্য ছড়াতে ভালবাসে। আসলে এরা হচ্ছে গভীর জলের মাছ। বলতে পারেন বিগ ব্রাদার। উপর থেকে চোখের লেন্সকে নানান এঙ্গেলে প্রক্ষেপণ করে এরা আপনাকে, আমাকে, সবাইকে দেখছে আর মজা লুটছে। এরা সবার বাহির-অন্দর জানতে চায়। কিন্তু নিজেকে উন্মুক্ত করতে চায়না। এজন্য এরা থাকে সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে।
পাঁচ. যত দোষ, নন্দ ঘোষ
• "ঘুম আসে না, যদিও রাত নিঝুম/ আমার জীবনে কষ্ট, অথচ তোমার জীবনে সুখের ধুম" • "কেন বার বার জাগাও মিছে আশা/কে বলে এ প্রেম? এ যে প্রতারক ভালবাসা!" • "এ জীবনের মনে হয় সব অপচয় / এ কেমন কষ্ট, এ কি পরাজয়" • "স্বপ্ন কেন এত কাঁদায় / কে আমাকে এখন বাঁচায়’।
জীবনের সব কিছুতেই এদের পরাজয়ের মূল কারণ অন্যরা। অন্যরা সবসময় এদের সুখের প্রতিবন্ধক। এরা সবসময় ছায়া শত্রুর সাথে লড়াই করে করে ক্লান্ত। এদের জীবনে ছিটে ফোটা ভালবাসার কোন খোঁজ বা আয়োজন নেই। এরা নিজেরাই নিজেকে দুঃখী সাজিয়ে আনন্দ পায়।
ছয়. কপিইং এন্ড পেস্টিং মাস্টার
যে কোন বিষয়েই এরা বিশেষজ্ঞ। জন্ম-অজন্ম, প্রেম-অপ্রেম, ধর্ম-অধর্ম, জ্ঞান-অজ্ঞান সব বিষয়েই এরা লাগাতার পোস্টিং দিয়ে যাচ্ছে। হাতের কাছের ইন্টারনেট ব্যবহার করে, অসংখ্য ওয়েব সাইট পরিভ্রমণ করে, লেখা ও ছবি কপি ও পেস্ট করে এরা ফেসবুকের পাতার সমৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। এরকম একটা ধনাত্মক চেষ্টায় এদের শ্রম ও মেধা ব্যয়ের জন্য এরা ধন্যবাদ পেতেই পারেন। এদের জন্য তাই ‘মারহাবা, মারহাবা’ বলাটা অযৌক্তিক নয়। ন্যূনতম এই সূত্রে তাদের বহু ভাল কথা ও গল্প জানা হচ্ছে। তবে আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, এরা নিজেরা এগুলো পুরো পড়ে দেখে তো!
রিয়াজ হক, সিডনী - ৩০ শে জুন, ২০১৬
|