‘একদিন আসেন না আমার বাসায়’ (হরেক রকম দাওয়াতের গল্প) রিয়াজ হক
সিডনীর বাংলাদেশি-বাঙালি কালচারের মূল অনুষঙ্গ দাওয়াত। এদেশে গ্রীক, ইটালিয়ান, ব্রিটিশ-আইরিশ, রাশিয়ান সহ বিভিন্ন জাতি-প্রজাতির মূল সামাজিক মিলন ক্ষেত্র হল পাব, ক্লাব বা সংঘ। বাঙালি কালচারে যেহেতু সামাজিক ভাবে পাব, ক্লাব বা সঙ্ঘের প্রচলন নেই তাই আমাদের পরিচয়, মিলন, সান্নিধ্য ও গুজব-গল্পের জন্য আমরা নিজেরাই তৈরি করেছি দাওয়াতের এক অনুপম অবরুদ্ধ সংস্কৃতি।
‘সংস্কৃতি’ শব্দটি মানব জীবনাচরণের মর্মার্থে যতটা উদার ও বিস্তৃত আমাদের দাওয়াতে তার অল্পই প্রতিফলন ঘটে। সেজন্য একে ‘অবরুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করছি। এটা অবরুদ্ধ এজন্য যে মূলত এটা গৃহ-কেন্দ্রিক; গৃহের চার দেয়ালের মাঝেই এর ব্যাপক অবস্থান। এতে বিশেষ ভাবে রসনার তৃপ্তি হয়। অনুপস্থিত ব্যক্তি ও সমষ্টির জীবনযাপনের মর্মান্তিক শারীরিক ব্যবচ্ছেদ হয়। রাজনীতির ইতিহাস ও আমাদের নষ্ট-ভ্রষ্ট রাজনীতিবিদদের প্রপিতামহ সহ চোদ্দ-গুষ্ঠির বিপুল উদ্ধার হয়। কখনও কখনও সাহিত্য ও শিল্পকলার অন্যান্য বিষয়ও যে এখানে কিছুটা হলেও জায়গা করে নেয় না তা নয়, তবে সে খুবই অনুল্লেখ্য। তবে যাই হোক, এ দাওয়াতের আমন্ত্রণ, নিমন্ত্রণ ও আয়োজনেরও নানা প্রক্রিয়া ও ভঙ্গি রয়েছে। খুব ভাল করে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে আপনি নিজেও এর স্বরূপ চিনতে ভুল করবেন না।
এমনি-সেমনি দাওয়াত ধরেন কোন গ্রোসারি সপ বা শপিং মলে কেনাকাটার ব্যস্ততার মাঝে, চাকরি ও কাজের প্রয়োজনে ট্রেন বা বাসের একই প্লাটফর্ম বা কামড়ায় অথবা একই জিপির পেশেন্ট হওয়ার কারণে কোন ব্যক্তির সঙ্গে আপনার বার বার দেখা হয়ে যাচ্ছে। তখন যে দাওয়াতটি আপনি পাবেন তা হল “একদিন চলে আসেন” বা “একদিন চলে আসেন না আমার বাসায়”। যে আপনাকে প্রায়শই এ দাওয়াতটি দিচ্ছেন আপনি কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তার বাসার ঠিকানাটিও জানেন না! ‘একদিন’ কোনদিন তাও আপনার অজানা! এ প্রসঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর মুখ থেকে শোনা একটি গল্প আপনাদের সঙ্গে শেয়ার না করে পারছি না। সত্তুরের দশকের প্রথম ভাগের কথা। আমার এ বন্ধুটির বাসা ছিল ঢাকার পশ্চিম ধানমন্ডির পেছনে রায়েরবাজারে। অন্য অনেকের মাঝে তার আরও দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে সে মাঝে মাঝেই খেলতে যেত ধানমন্ডির আবাহনী মাঠে। প্রায় দিনই সন্ধ্যায় খেলা শেষ করে সে তার অন্য বন্ধুর সঙ্গে ফিরত বাসার দিকে। অন্য বন্ধুটির বাসা ছিল আবাহনী মাঠের প্রায় গা ঘেঁসেই। দু’জন একসঙ্গে কিছুটা হাটার পরই এসে পড়ত তার বাসা। এবং একই ভাবে প্রতিদিন একই রুটিনে সে তার বাসায় ঢুকে গেট লাগাতে লাগাতে বলত “একদিন বাসায় এসে চা খেয়ে যাস”। বলা বাহুল্য ঐ একদিন আর কখনো আসেনি এবং তার চা খাওয়াও কোনদিন আর হয়ে উঠেনি। তাই এরকম দাওয়াতের নাম এমনি-সেমনি দাওয়াত। কেবল বলার জন্য বলা!
চক্ষু-লজ্জার দাওয়াত একই ব্যক্তির সঙ্গে ঘুরে ফিরে বিভিন্ন দাওয়াতে আপনার দেখা হয়ে যাচ্ছে। ঐ ব্যক্তি সম্পর্কের বিভিন্ন সূত্র ধরে প্রকাশ্যে আপনাকে বেশ শ্রদ্ধা ও সমীহও করে থাকেন। ইতিমধ্যে আপনার অনেক পরিচিত অনুজদের তিনি দাওয়াত করে খাইয়েছেন। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে আপনাকে তিনি দাওয়াত করে উঠতে পারেন নি। তাই চতুর্থ বা পঞ্চম বারে সাক্ষাতের সাথে সাথে উনি আপনাকে বলবেন, “ভাই আগামী রোববারে দুপুরে চলে আসেন না আমাদের বাসায়, আপনার পরিচিত অনেকেই সেখানে থাকবেন”। এ হচ্ছে না পেরে, চক্ষুলজ্জার খাতিরে আপনাকে আসতে বলা। এ কতটা মন খুলে, হৃদয়ের ভেতর থেকে দাওয়াত সে প্রশ্ন তাই রয়েই যায়।
পাল্টাপাল্টি দাওয়াত পারস্পরিক পরিচয়ের পর থেকেই আপনি ভাবছেন, আপনার ঐ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বড় ভাই বা আপাকে দাওয়াত করে খাওয়াবেন। এক সময় তা বাস্তবে রূপায়িত হতে হতেই হয়ত কেটে গেছে দু’চার বছর। একদিন সে মহেন্দ্রক্ষণ এলো, দাওয়াত করলেন। সবাই এক হলেন। খাওয়া ও গল্প-গুজবে মধুর সময় কাটালেন। কিন্তু এর রেশ শেষ হতে না হতেই ঐ বড় আপা বা বড় ভাই আপনাকে ফিরতি দাওয়াত করে বসলেন। এটা হল পাল্টাপাল্টি দাওয়াত। এ দাওয়াতের প্রক্রিয়া ও সম্পর্কগুলো এমন যে একটা-দু’টো দাওয়াতেই এর ‘মধুরেন সমাপয়েৎ’।
অনুযোগের দাওয়াত ধরুন, এক ব্যক্তি বছর খানেক আগে আপনাকে দাওয়াত করেছিলেন। বিশেষ কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য তখন আপনি সে দাওয়াত কবুল করে উঠতে পারেন নি। ইতিমধ্যে তাকে আপনি দু’একবার দাওয়াত করে খাইয়েছেন। যে কোন কারণেই হোক উনি আর আপনাকে দ্বিতীয়বার দাওয়াত করে উঠতে পারেন নি। কিন্তু অবশেষে একদিন সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে উনি আপনাকে রিং করে বললেন, “আপনি তো ভাই সবসময় অনেক ব্যস্ত, আপনাকে বার বার (!) দাওয়াত দিয়েও পাওয়া যায় না। এবার নিশ্চয় না করবেন না। এই শনিবারের পরের শনিবার আপনি কিন্তু অবশ্যই আসছেন”। কথা হল সেই শনিবারে আপনি কিন্তু অনেক আগে থেকেই Booked. প্রশ্ন হল, এখন আপনি কি করবেন। না কি আপনার ‘কি’ করারও উপায় নেই!
অনন্যোপায় হয়ে দাওয়াত ‘ক’ একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি। ‘ক’ এর পেশা, সম্পদ, স্ত্রী, সন্তান সবই চোখে পড়ার মত। ‘ক’ কে আপনার পছন্দ। তা ছাড়াও ‘ক’ এর সঙ্গে সম্পর্ককে সমাজ বিশেষ মূল্য দেয়! সে কারণে তার সাথে আপনার বিশেষ সম্পর্ককেও আপনি গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন। তাই তাকে নিয়মিত দাওয়াতে ডাকছেন। ‘ক’ এর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ‘খ’। ‘খ’ ‘ক’ এর প্রায় সমকক্ষ। তবে ‘খ’ খুব চাঁছাছোলা ধরনের মানুষ। মুখের উপর কাউকে সত্য বলতে দ্বিধান্বিত নন। এ জন্য ‘খ’ কে আপনার অপছন্দ। কিন্তু ‘ক’ এর দাওয়াতে ‘খ’ এর সঙ্গে আপনার দেখা হচ্ছে প্রতিনিয়তই। তাই ‘ক’ এর দিকে তাকিয়ে ‘ক’ কে খুশি রাখতেই অনন্যোপায় হয়ে ‘খ’ কে আপনার দাওয়াত করতে হচ্ছে!
উঁচু তলায় পৌঁছানোর দাওয়াত আপনি উপরে, অনেক উপরে উঠতে চান। জীবনে আপনি বৈধ যে কোন উপায়ে বিখ্যাত হওয়ার অনন্ত বাসনায় কাতর! পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে, সংগঠনের অধিকর্তা সেজে, অগণিত ভাই-বন্ধুর সাথে নিবিড় সংযোগ রক্ষা করে, লেখায় নিজের কীর্তি জাহির করে যে কোন ভাবেই হোক আপনি আর দশজনের চোখে পড়তে চান। সীমার ভেতরে থেকে এ চাওয়ার পেছনে হয়ত খুব একটা অন্যায় কিছু নেই। কিন্তু যখন আপনি উঁচুতলায় আপনার অবস্থানের জানান দেওয়ার জন্য, আপনার বিত্ত-বৈভবের পরিবর্তনের সাথে সাথে, আপনার দাওয়াতের লিস্টেও আমূল পরিবর্তন ঘটান তখন তাকে কি বলা যায়!
একসময় যাদের সান্নিধ্য ছাড়া আপনি ছিলেন অচল, একসময় যাদের মুখরিত সময় ছিল আপনার আনন্দকাল আজ তাদের প্রতিস্থাপন করছেন বিত্ত বৈভবে সমকক্ষদের দিয়ে। ঐ সমকক্ষদের সাথে আপনার হৃদয়ের মিলের চেয়ে কিন্তু বিত্তের মিলই বেশী। এসব ক্ষেত্রে হৃদয়ের আর্তির চেয়ে তাই বড় হয়ে উঠে বৈষয়িক জীবনের অপার মোহ ও উঁচুতলায় পৌঁছানোর উদগ্র বাসনা!
এসব দাওয়াতে আপনি কখনও সামিল হলেই বুঝতে পারবেন, কি ভাবে বদলে যাচ্ছে দাওয়াতের রূপ ও চরিত্র। এসব দাওয়াতে জীবনের চেয়ে জৌলুসের মাত্রা বেশী। দেখার চেয়ে দেখানোর আকাঙ্ক্ষা বেশী। সম্পর্কে হৃদয়ের বন্ধনের চেয়ে আচরণের যান্ত্রিকতা বেশী। কারণ চিত্ত নয়, বিত্তই এখানে দাওয়াতের মাপকাঠি। এসব ক্ষেত্রে প্রতি দাওয়াতেই তাই হারিয়ে যাচ্ছে আগের দেখা সজীব মুখগুলো। তার বদলে যায়গা করে নিচ্ছে প্রাণহীন, শুষ্ক, কৃত্রিম কিছু মানুষ। যাদের সঙ্গে ‘হাই’ ‘হ্যালো’ করা যায় কিন্তু প্রাণ খুলে কথা বলা যায় না। যায় না অন্তহীন জীবনের গল্প বলা।
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|