bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia














দাওয়াতের বিড়ম্বনা
রিয়াজ হক


(ডায়েরীর পাতা থেকে)





সিডনীতে ২০১৬ এর শীত এল দেরীতে। গত বছর এপ্রিলেই হালকা শীতের আগমন ঘটেছিল। এবার মনে হল শীত যেন আত্ম-অভিমানী শিশুর মতই দরজার পাল্লার আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। এপ্রিল ও মের প্রায় শেষ, তেমন শীতের দেখা কই! এমন কি এ দুমাসে বৃষ্টিও হয়েছে অপ্রতুল। বাগানের ঘাস ও ফুল-ফলের গাছগুলোর শুষ্ক মুখের দিকে তাকালে কষ্ট হয়। নানা কাজের ফাঁকে সপ্তাহে দুতিন বার পানি দিয়ে এদের আর কতটা সতেজ ও সবুজ রাখা যায়।

মের শেষ সপ্তাহে, ঘোমটার ফাঁক গলে দৃশ্যমান নতুন বৌয়ের মুখের মতই শীতের উঁকিঝুঁকি। অবশ্য জুনের শুরুতেই ঘরে-বাইরে গরম কাপড়ের বাহারি আয়োজনে বোঝা গেল শীত এসে গেছে। তবে জুনের প্রথম সপ্তাহে সিডনী সহ সারা অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া বার্তা খুবই হৃদয় বিদারক। Week End এ লাগাতার বৃষ্টি, সেই সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া ও স্থানীয় বন্যার পূর্বাভাষ।

জুনের ৪ তারিখ শনিবার, এসে গেল, গত রাত থেকেই ঝিরি ঝিরি টিপ টিপ বৃষ্টি। কখনো হাল্কা, কখনো জোড়াল। এ বৃষ্টির ধারাটা মনে হল, সুর করে গ্রাম্য বৃদ্ধার শোকের কান্নার মত এই যায়, এই আসে। শেষ হলেই আবার শুরুর অপেক্ষা।

জুনের ৫ তারিখ রোববার। রোববার দিনটি আমার বড় প্রিয়। একমাত্র এই একটি দিন মনে হয় আমার নিজের। পাঁচ দিনের চাকুরীর দাসত্বের পর Week End এর শনিবার কাটে ঘরের দাসত্বে। গৃহ-দাহ থেকে বাঁচার জন্য সঁপে দিতে হয় এ দিনের পুরোটা। বাজার, কাপড়, ঘর পরিষ্কার ও সামাজিক সৌজন্য রক্ষার প্রাবল্যে এ দিনের আত্মাহুতি। রোববার কেবল মনে হয় আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। আর এই রোববারেই কিনা দুপুরবেলা আমার স্ত্রী নিমন্ত্রণ করেছে পাঁচ পাঁচটি পরিবারকে!

নিমন্ত্রণ বা জনপ্রিয় অর্থে দাওয়াত হল সিডনীতে অবশ্য পালনীয় বিশেষ বাঙ্গালী কালচার। যে কোন ব্যক্তিগত পর্ব, অনুষ্ঠান বা কেবল মাত্র রাজা-উজির মারার জন্য আপনি আপনার বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী বা পরিচিত জনকে আপনার বাসায়, পার্কে বা রেস্টুরেন্টে দাওয়াত করতে পারেন। এটা ভাইস-ভার্সা। আপনি ডাকবেন তো ডাক পাবেন। কিন্তু আপনি যদি কোন কারণে এ কালচারে অংশীভূত না হন বা আপনার উপস্থিতি জানান দিতে না পারেন তাহলে আপনি এ কমিউনিটি থেকে আউট। শুধু আউটই নন; অলৌকিক প্রতিপক্ষের মনোমুগ্ধকর ঘূর্ণি বল বা ইয়র্কারে একেবারে অসম্মানজনক ভাবে বোল্ড আউট। অবস্থা এমনও হতে পারে যে আপনার অস্তিত্বের মিডল স্ট্যাম্পই নাই হয়ে যেতে পারে। তাই, কে বলেন এমন দুর্বিপাকে পড়তে চায়!

সবকিছু আমলে নিয়েও কোমল অথচ দৃঢ় কণ্ঠে স্ত্রীকে প্রশ্ন করি, ক কে কেন দাওয়াত করেছ?

: ওরা সিডনী ছেড়ে Brisbane এ চলে যাচ্ছে তাই।

খ কে?

: ওদের অনেক দিন ডাকা হয়নি।

গ?

: ওদের বাসায় দেড় মাস আগে ভরপেট খেয়ে এসেছ সে খেয়াল আছে?

ঘ?

: এত কৈফিয়ত তোমাকে দিতে পারবনা। হাত পা গুঁটিয়ে বসে না থেকে সব্জিগুলো একটু কেটে দিলেও তো পার।

মনে মনে বলি, "পারি তো অনেক কিছুই, কিন্তু মন যে চায় না"। প্রকাশ্যে বলি না।

শনিবার রাতে অসুস্থ এক আত্মীয়াকে দেখে বাসায় ফিরতে ফিরতে রবিবার শুরু হয়ে গেল। শনিবার বিকেল ও সন্ধ্যা মিলিয়ে আমার স্ত্রী মাছ, মুরগী, গরুর প্রাথমিক preparation শেষ করে রেখেছে, মশলাপাতিও ready. এখন রোববার কেবল রান্নাটা বাকী।

রবিবার সিডনীর সমস্ত আকাশ যেন সহস্র বিক্ষুব্ধ অভিমানী কিশোরীর দুচোখ ভরা কান্না নিয়ে ভেঙে পড়তে শুরু করল। সেই সঙ্গে বাতাসের ক্রুদ্ধ গর্জন। বৃষ্টি পড়ছিল ধারালো ফলার মতন, হিংস্র বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে চপোটাঘাত করছিল নিরীহ গাছপালার ডাল ও পাতায়।

বিছানা থেকে উঠতে একটু দেরীই হয়ে গেল। সকাল সাড়ে সাতটা। হাত মুখ ধুয়ে, মুখে কিছু দিয়ে আমার স্ত্রী হেঁশেলে ঢুঁকে গেল। ভাঁজতে হবে আলুর চপ, বানাতে হবে টুনার কাবাব। রাঁধতে হবে ইলিশ মাছের দোপেঁয়াজী, মুরগীর কোর্মা, গরুর ঝাল মাংস, চাইনিজ সব্জি ও মটরশুঁটি পোলাও। সময় কম, dessert এর বিষয়টিতে নিমন্ত্রিত অতিথিরাই ভরসা!

যাক, মুরগী দিয়ে শুরু। আমার স্ত্রী উনুন ধরিয়ে, পেঁয়াজ কেটে, মশলা দিয়ে আই-প্যাড খুলে মাত্র কোর্মা রান্নার ভিডিও অন করেছে এর মধ্যেই Bang। সারা ঘর অন্ধকার করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল বিদ্যুতের আলো। সিডনীতে এমন ঘটনা একেবারে কম হলেও অস্বাভাবিক নয়।

"হায়! হায়! এখন কি হবে"? আমার স্ত্রীর আর্তস্বর।

আমি বললাম, "প্রতিবার রান্নার সময় কেন ভিডিও দেখতে হবে? এবার স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা দিয়ে চালিয়ে দাও"। "শোকর কর যে বাসায় রান্নার জন্য বিদ্যুৎ নয়, গ্যাস এর চুলা আছে"।

স্ত্রী বলল, " Please একটু পাশের বাড়িতে যেয়ে জিজ্ঞেস করে এসো তো তাদেরও current চলে গিয়েছে কিনা"?

ঝড়ো বাতাস ও ছাতার এক প্রবল অসম যুদ্ধের মাঝে ভিজতে ভিজতে পাশের বাড়িতে যেয়ে কলিং বেল টিপে দিলাম। ভাবুন, তখন সকাল সাড়ে আঁটটা আর দিনটা হল রোববার।

দুতিনবার টেপার পর আনুমানিক ১২০ কেজি ওজনের দশাসই শরীর, দৈর্ঘ্য-প্রস্থের অনুপাত ৩:১ এর বক-সাদা চেহারার আমার প্রতিবেশী মিস্টার জন দরজা খুলে দিলেন; উসকো খুসকো চুল, এক হাত দিয়ে পাজামা ধরা, পাজামার দুটো ন্যাড়া প্লেট থেকে ঝুলে পড়া লম্বা স্পাগিটির মত মনে হচ্ছিল। অন্য হাত মুখে দিয়ে নিস্তেজ অবসাদের হাই তুলছেন। তীব্র আশংকা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
"Anything wrong Reaz"?
"No, only I wanted to know, have you got electricity"?
"Electricity? I think, no. I tried to put the bed switch on, but..........."
"Ok, Ok, sorry to disturb you early in the morning."
এ কথায় সে এমন একটা Look দিল যে তা পুরস্কার না তিরস্কার বুঝে উঠতে পারলাম না।

এখন সকাল সাড়ে দশটা। এখনও আমরা বিদ্যুৎ বিহীন। আমার স্ত্রী অনেক খুঁজে ফিরে চুলার দুপাশে দুটো শীর্ণকায় মোমবাতি জালিয়ে রান্না করে যাচ্ছে আর আমাকে বলছে, "একটু আল্লাহ্ আল্লাহ্ কর যাতে current টা এখনই চলে আসে"।

বাইরে বাতাস ও বৃষ্টির মিতালি; হাত ধরাধরি করে আদিগন্ত বিস্তৃত চরাচর পার করে যাচ্ছে নিদারুণ ভ্রুক্ষেপ হীন। সময় সকাল সাড়ে এগারটা, এখনও ইলেক্ট্রিসিটি আসার কোন লক্ষণ নেই। এদিকে আমাদের রান্না ঘরটা ভেতর বাড়িতে। এর চারপাশে অন্য ঘর। আলো আসার কোন জানালাও নেই। রান্নারও অনেক বাকী। মোমও ফুরিয়ে যাচ্ছে। আমি উদ্বিগ্ন চিত্তে, বিচলিত হয়ে, বৃষ্টি ঝরঝর নির্বিকার আকাশের দিকে তাকিয়ে কেবল ভাবছি...............।



রিয়াজ হক, সিডনী




Share on Facebook               Home Page             Published on: 5-Sep-2016

Coming Events:





A day full of activities, games and fun.







Blacktown Lakemba Mascot