কার্নেস হিল কমিউনিটি সেন্টার থেকে লা মন্তাজঃ কিছু কর্ম, কিছু প্রশ্ন
রিয়াজ হক
সিডনিতে বাঙালি কমিউনিটির বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্যে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা, মেলা-মেশা, গল্প-গুজবের বড় একটা জায়গা হচ্ছে বিয়ের অনুষ্ঠান । নব্বুইয়ের দশকের শুরুতে যারা এদেশে এসেছেন তাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে বাস্তবিক অর্থেই বিয়ের বয়সী । চারদিকে তাই গত এক দশক ধরে সিডনির বাঙালি পরিবারে চলছে বিয়ের উৎসব !
বিয়ে হচ্ছে ক্লাবে, কমিউনিটি সেন্টারে, নানা হলে । এমনি দুটো বিয়ে পরবর্তী সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল গত ২৮শে ও ২৯শে অক্টোবর, এই সিডনিতে ।
২৮শে অক্টোবর উপস্থিত ছিলাম সিডনির দক্ষিণে ‘কার্নেস হিল কমিউনিটি সেন্টার’ এ । লিভারপুল সিটি কাউন্সিলের অন্তর্ভুক্ত এই সেন্টারটি কুরাজং রোডে অবস্থিত । কমিউনিটি হল, লাইব্রেরি, রিক্রিয়েশন সেন্টার, চিলড্রেন প্লে গ্রাউন্ড, স্কেট পার্ক ও পিকনিক জোন সহ আধুনিক সুযোগ সুবিধা নিয়ে তৈরি এই দৃষ্টি নন্দন Precinct টি সবার প্রশংসা অর্জন করেছে । গত বছরের আগস্ট থেকে এটি সর্ব সাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
এটি ছিল একজন নিকট আত্মীয়ের ছেলের বিবাহ উত্তর সম্বর্ধনার অনুষ্ঠান । অনুষ্ঠানের হলটি সাজানো হয়েছিল খুবই সাদামাটা ভাবেই, তবে তাতে রুচি ও স্নিগ্ধতার পরিচয় ছিল । পুরুষ ও মহিলাদের আলাদা টেবিলে বাফে (buffet) খাবারের ব্যবস্থা ছিল । তবে দু’শ লোক যাতে বসে খেতে পারে সেজন্য চেয়ার টেবিলের সুন্দর আয়োজন ছিল । আমরা প্রত্যেকেই যদি নিজ নিজ দায়িত্বের প্রতি যত্নবান হতাম তাহলে এমন আয়োজনে খুব সুন্দর ভাবেই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়ার কথা । কিন্তু প্রশ্ন হল এখানেই, তা কি হচ্ছে ? আমরা আদৌ কি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছি ? অস্ট্রেলিয়ার মত একটি উন্নত দেশে এখানের পরিস্থিতি, সামাজিক পরিবেশ ও পদ্ধতির সাথে তাল মিলিয়ে আমরা কি চলতে পারছি ?
রাত ন’টায় খাবার পরিবেশনের পর দশটা নাগাদ খাবার শেষ হলে পুরো হল ঘরের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল যেন প্রবল ঝড়ো বাতাসে লন্ড ভন্ড এক প্রাঙ্গণ । অনেক টেবিলেই পড়ে আছে অর্ধেক খাবার শুদ্ধ disposable plate, তলানিতে আটকে থাকা কোমল পানীয় সহ disposable glass, টেবিলে মাংসের ঝোল, মেঝেতে ভাতের ছড়াছড়ি । এমনকি বাইরের বেলকনিতেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল প্লেট, গ্লাস, ন্যাপকিন ও পানীয়ের বোতল । যদিও খাবার শেষে যার যার ব্যক্তিগত দায়িত্বেই হলে রাখা বিন ব্যাগেই এগুলোর জায়গা হওয়ার কথা ছিল ।
রাত ১২টা পর্যন্ত আমি ঐ হলে ছিলাম । প্রায় ১০-১২ জন লোকের দু’ঘণ্টা ধরে বিরতিহীন পরিশ্রমের পরও হলটি সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে চেয়ার টেবিল গুছিয়ে সব ঠিক ঠাক করা কষ্ট সাধ্য হয়ে উঠছিল । আমরা সবাই মিলে একটু সচেতন ও দায়িত্ববান হলেই এ কাজের জন্য দেওয়া শ্রম ও সময় প্রায় অর্ধেক কমিয়ে ফেলা যেত ! গুরুতর প্রশ্ন হল, আমরা কি তা হব ?
দ্বিতীয় বিবাহোত্তর সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানটি ছিল সিডনির উত্তরে লিলিফিল্ডে, Iron Cove Bay র পানির ধার ঘেঁষে অবস্থিত খুবই সুন্দর একটি জায়গায় ‘La Montage’ এ । ‘La Montage’ venue টি তার নিজস্ব পরিপাটি চেহারায়, উল্টোদিকে মন উদাস করা পানির বিস্তীর্ণ প্রবাহ, তাতে মৃদু তরঙ্গে দুলতে থাকা সাদা বোটগুলো, বিকেলের সোনার রোদ, সন্ধ্যার অস্তচলে আবীরের রঙ্গে এক মোহনীয় পরিবেশ রচনা করে রেখেছিল ।
ভেতরে প্রায় চারশো লোকের বসার ও খাবারের আয়োজন । রকমারি ফুলের বর্ণচ্ছটা, বাহারি আলোর খেলা ও নানা সুস্বাদু খাবারের আয়োজনে অতিথিদের বরন করে নিতে দরাজ দিলের চিহ্ন ছিল সর্বত্র ।
এই Formal বিয়ের অনুষ্ঠানের একটি বিশেষ অংশ হচ্ছে বর-কনে উভয়ের ঘনিষ্ঠজন (ভাই, বোন, বন্ধু ) ও অভিভাবকদের (পিতা-মাতা) বক্তৃতা ।
সাধারণ বুদ্ধি বলে, যারা এতটা মেধা ও শ্রম দিয়ে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন ও আমাদের নিমন্ত্রণ করে সম্মানিত করেছেন, আমাদের দায়িত্ব হল সেই সম্মানটুকু তাদের ফিরিয়ে দেওয়া । কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যের খাতিরে প্রশ্ন করতে হয়, “আমরা কি তা করছি” ? কনের বোনের হৃদয় স্পর্শ করা ভাষণের ভেতরই তার সামনে লাইন করে আমরা ছবি তোলায় মহা মশগুল ! অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছিল, বসে, কথাগুলো শোনা বা উপভোগ নয়, ছবি তোলাই আমাদের জন্য মুখ্য যা আমরা পরেও যে কোন সময় করতে পারতাম ।
অন্যদিকে কনের পিতার বক্তৃতার সময় একাধিক টেবিলে উচ্চস্বরে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় মুখর ছিলেন কয়েকজন । এ যে ভয়ানক দৃষ্টিকটু ও পাশের টেবিলের শ্রোতাদের জন্য মহা বিরক্তিকর এই সাধারণ বোধটুকু আমরা ভুলে যাই কি ভাবে ?
আমরা কি অনুষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ এই সময়গুলোতে এর বিষয়াবলীকে প্রাধান্য না দিয়ে ও সে অনুযায়ী যথাযথ প্রার্থিত আচরণ না করে অনুষ্ঠানটির আয়োজক ও এতে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি নিদারুণ অবিচার করছি না !
রিয়াজ হক, সিডনি
|