আমাদের সন্তানদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রিয়াজ হক
পহেলা জুলাই রাতে ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারির তীব্র বেদনাদায়ক, মর্মান্তিক ঘটনার আজ প্রথম বার্ষিকী। আমি আজ বেশী করে ভাবছি নিরবাস, রোহান, মোবাশ্বের, খায়রুল ও শফিকুলের বাবা-মা’র কথা। তাদের জীবন যে কতটা দুঃসহ বেদনার গভীরে প্রবেশ করেছে ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। কারণ আমি নিজেও একজন পিতা।
আমি কোন মনোবিজ্ঞানী নই। মানুষের মধ্যকার নানারূপ সম্পর্ক নিয়ে যারা পড়াশুনা, চিন্তা বা গবেষণা করেন আমি সে দলের নই। আমি একজন অভিভাবক, ঐ সন্তানের পিতা মাত্র।
অভিভাবক ও সন্তান এই দুই পরিচয়কে দু’জায়গায় রেখে, পরস্পরের স্থান বদল করে, অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে, স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধি দিয়ে আমি দেখতে চাই এ সম্পর্ক কেমন হওয়া প্রয়োজন।
গোড়াতেই আমার প্রশ্ন হল সম্পর্ক টিকে থাকে, মধুর ও প্রাণবন্ত হয় কিসের ভিত্তিতে?
এক. পারস্পরিক আস্থা, অনুমোদন, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসে।
দুই. মতের মিল ও গ্রহণযোগ্য যুক্তিপূর্ণ অমিলে।
তিন. একই বিষয়ের প্রতি পারস্পরিক আগ্রহ ও ভাবনার লেনদেনে।
চার. ঘর ও বাইরের কাজে পারস্পরিক সহযোগী মনোভাব ও সক্রিয় নিযুক্তিতে।
পাঁচ. জীবনের যে কোন বিপর্যয় ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় হতোদ্যম না হয়ে পারস্পরিক শক্তি ও সাহস জোগানোর অক্লান্ত উদ্যমে।
ছয়. পরস্পরের ভুল স্বীকারের অদম্য মানসিকতায়।
সাত. অতীত হতাশা ও পরাজয় নয়, আগামীর আনন্দ ও স্বপ্নের দিকে ফিরে তাকানোয়।
এটা তো ঠিক, আমাদের সন্তানেরা যখন শৈশব বা কৈশোরে তখন তাদের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন তাদের অভিভাবক বা পিতা-মাতার। একটা বয়স পর্যন্ত সে আপনার দিকে প্রসারিত করে দিবে তার ছোট্ট দুটো কোমল হাত। তখন অভিভাবকের দায়িত্ব সে হাতকে পরম উষ্ণতায় ও মমতায় জড়িয়ে ধরা। কারণ এরপর একটা সময় আসবে যখন অভিভাবক তার হাত প্রসারিত করলেও সে তা আঁকড়ে ধরতে চাইবে না। তখন তার নিজস্ব ভুবন ও ব্যক্তিত্ব গঠনের পালা।
শৈশবে ও কৈশোরের অফুরন্ত প্রশ্ন ও গল্প বলাকে দমিয়ে দিয়ে বা না শুনে আমরা কিন্তু নিজের অজান্তেই আমাদের সন্তানদের দূরে ঠেলে দেই। তাদের প্রশ্ন ও গল্প যতই অকিঞ্চিৎকর ও অর্থহীন হোক আপনাকে প্রবল আগ্রহ নিয়েই তা শুনতে হবে এবং আপনার প্রয়োজন ও অংশগ্রহণকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। এ গল্পের মাধ্যমেই কেবল সে আপনাকে তার সাথী বা বন্ধুর মতই ভাবতে ও বিশ্বাস করতে শিখবে। মূলত এখান থেকেই শুরু তার ঘরে-বাইরে বন্ধু নির্বাচন। যে বন্ধুরা হবে তার আগামীর জীবনের অংশীদার।
আমরা যদি তাদের গল্প না শুনি, তাদের প্রশ্নের উত্তর না দেই, দৈনন্দিন জীবনের ছোট খাট নানা সিদ্ধান্ত অনুমোদন না করি তাহলে তারা এসবের জন্য বেশী করে বাইরের দিকে তাকাবে ও ক্রমাগত নিজেকে ঘর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। তার শারীরিক উপস্থিতি হয়ত ঘরেই, কিন্তু তার মানসিক বিচরণ তখন অন্যত্র, বাইরে। আধুনিক ইলেক্ট্রনিকস এ দুনিয়ায় তার বাইরের জগত অন্তহীন, অনন্য। বিপুল ভাবে চিত্তাকর্ষক ও লোভনীয়।
আমরা যদি আমাদের বার/তের বছরের কিশোর ছেলে বা কিশোরী মেয়েটিকে ‘বুদ্ধিমান/বুদ্ধিমতী’ না বলি, ‘ভাল’ বা ‘সুন্দর’ না বলি তাহলে এ কথাগুলো সে তার বাইরের জগতের সতীর্থ, সমবয়স্ক বা বড়দের কারও কাছ থেকে শুনতে চাইবে। এ তার অস্তিত্বের অনুমোদনের জন্য বড়ই প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে এগুলো না বলে আমরা তাদের হাতছাড়া করে ফেলছি। আমরা তাদের ঠেলে দিচ্ছি, আমদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে অন্য এক অচেনা জগতে।
এ বয়সের ছেলে মেয়েরা কাদা মাটির মত। তাদের মন কোমল। অস্থির, চঞ্চল। এ বয়সে মনে যা ছাপ পড়ে তা অনেক ক্ষেত্রেই দীর্ঘস্থায়ী হয়। ফলে তাদের সঙ্গে আমদের বন্ধুত্ব স্থাপন করতেই হবে। কেবল শাসন ও চোখ রাঙ্গানি দিয়ে আমরা তাদের বেঁধে রাখতে পারব না।
কৈশোর যখন ধীরে ধীরে তারুণ্যের বিশাল খোলা প্রান্তরের দিকে এগিয়ে যাবে, এ পথ চলায় আমদেরও তাদের সঙ্গী হতে হবে।
এ বয়সে দেহ ও মনের যে পরিবর্তনগুলো ঘটে, সে গুলোকে স্ব-স্নেহে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে তাদের অনেক জিজ্ঞাসা ও রহস্যের সমাধান দিতে পিতা-মাতাকেই এগিয়ে আসতে হবে। তার নানা ধারনা ও বিশ্বাস, ক্ষোভ ও বিক্ষোভের কথা আপনাকে তার একান্ত সহমর্মী হয়ে কান পেতে শুনতে হবে। এটা কেবল স্কুল ও বন্ধুদের বিষয় বলে ছেড়ে দিয়ে ভুল করা ঠিক হবে না।
এক যুগ ছিল যখন দূরত্ব, ধমক ও ভীতির শাসন দিয়ে আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে বড় করেছি বা বড় হতে দেখেছি। এখন সে যুগ পাল্টে গেছে।
একটা সময় ছিল যখন একান্নবর্তী পরিবার ও পাড়া-মহল্লায় গড়ে ওঠা অলিখিত এক সামাজিক শাসন ছিল। সবাই সবার খেয়াল রাখত। এ অনুশাসনকে অতিক্রম করে যাবার উপায় ছিল না। এখন সে সময়ের বিলুপ্তি ঘটেছে।
এখন মানুষ এক কেন্দ্রিক। ব্যপ্তি ঘটেছে নিজস্বতার। বিজ্ঞান ও ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থা বদলে দিয়েছে অনেক কিছুর। কাছের বা পাশের মানুষের চেয়ে প্রিয় হয়ে উঠেছে কল্প দুনিয়ার মানুষ। মানুষ এখন ব্যস্ত ফোন, আই-প্যাড, কম্পিউটার বা টিভির মোহময় অন্য পৃথিবীতে।
সে জন্যই অভিভাবকদের আজ আরও বেশী করে প্রয়োজন সন্তানের ঘনিষ্ঠ হওয়ার। তাকে সময় দেয়ার। যুক্তি, বুদ্ধি, ভালবাসা দিয়ে তাকে নিজের করে নেয়ার।
অন্যদিকে নিজেদেরও গড়ে তোলা প্রয়োজন রোল-মডেলের আদলে। কারণ, অন্যকে ছোট ও অসম্মান করে, ভোগ-বিলাসিতায় আচ্ছন্ন হয়ে, দুর্নীতিতে নিমজ্জিত থেকে, সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করে যে জীবন আমরা যাপন করে যাচ্ছি তা থেকে বের না হলে কি ভাবে আমরা আমাদের সন্তানদের মানুষের মত মানুষ করব?
রিয়াজ হক, সিডনী
|