bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia














“আমার মাকে আমি কোনদিন” ও
“উদ্ভট উটের পিঠে” /
রিয়াজ হক


আগের অংশ


১৯শে এপ্রিল থেকে ১লা মে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা/১০টা পর্যন্ত আমি পান্থপথের সেই হাসপাতালে কাটিয়েছি। দুপুরে খাবারের জন্য কখনও কলাবাগানের দ্বিতীয় লেনে, বাসায় এসেছি। এখানেই কেটেছে আমার ছোটবেলা। ১৯৬৩ সাল থেকে যার শুরু। কলাবাগানের দ্বিতীয় লেনটি যেখানে মিরপুর রোডের সঙ্গে মিশেছে, তার গা ঘেঁষে যে মসজিদটি, আমাদের ছোট বেলায় এ মসজিদের জায়গায় একটি বড় পচা ডোবা ছিল। আমার ডাক্তার ভাইটি এখানে শখের বশে বঁড়শি ফেলে মাছ ধরে তা আবার ডোবায়ই ফেলে দিত। কারণ আমার আম্মার নিষেধ ছিল, এ পচা ডোবার মাছ বাসায় না আনার। কতদিন সাত চারা খেলতে যেয়ে এ ডোবায় আমাদের টেনিস বলটি পড়ে গেছে। সেই বল উদ্ধার করা ছিল আমাদের সবার জন্য অনেকটা মিশনের মত। আমরা পাড়ার (কলাবাগান/স্টাফ কোয়াটার) সব ছেলেপেলেরা তখন খেলতাম ধানমন্ডির ৮ নম্বর মাঠে। কত বর্ষায় কাঁদা মাটিতে ফুটবল খেলে আমরা গোসল করেছি ধানমন্ডির লেকে। তখন লেকের পানি ছিল স্ফটিকের মত স্বচ্ছ, টলটলে যা এখন কল্পনারও অতীত।

রিকশাওয়ালা ভাইয়েরা আমাকে কলাবাগান, লেক সার্কাসের অলিগলি ঘুরিয়েছে বেশ। উল্টো পথে পান্থপথে ঢুকিয়েছে। আমার মানা শুনেনি। আমার ছেলেবেলা/কৈশোরে/তারুণ্যে (১৯৬৩-৭৫) এ পথগুলো আমি বহু হেঁটেছি। তখন আমাদের নামাজ পড়তে বসিরুদ্দিন রোডের মসজিদে যেতে হত। বসিরুদ্দিন রোডের মসজিদের পিছনে ‘মিতাসঙ্ঘ’ মাঠে কতদিন খেলা দেখতে দৌড়ে ছুটে গেছি। কিন্তু সে সময়ের তুলনায় এখনকার রাস্তাগুলোর করুণ দশা আমাকে ক্ষুব্ধ করেছে। উন্নয়নের এ যুগেও ভাঙ্গা, এবড়ো-থেবড়ো, অসংখ্য Pot Hole এ ভর্তি এসব রাস্তার পাশের বিশাল বিশাল ইমারত আকাশে মাথা উঁচিয়ে যেন বলছে; “বর্ণ, সমতা, সৌন্দর্য ও মুক্ত প্রাঙ্গণের বড় দুর্ভিক্ষের মধ্যে আমরা বাস করছি; শ্বাস নিতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে” ! একদিন হাসপাতালের ছাদে দাঁড়িয়ে কলাবাগান কে আমার মনে হচ্ছিল যেন রুক্ষ কর্কশ কংক্রিটের এক নির্দয় বস্তি।

ঢাকায় থাকতেই ‘প্রথম আলো’ তে পড়লাম, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সনদ চালুর (২০০৮ সালে)গত দশ বছরে ঢাকার চল্লিশ হাজার ভবনের মধ্যে নিয়ম মেনে তৈরি হয়েছে মাত্র ১৬২টি ভবন যা মূল ভবনের ০.৪০৫ শতাংশ মাত্র। কলাবাগানের এমন গলিতেও গেছি যেখানে একটি এ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতেই প্রচুর কসরত করতে হবে। অথচ তার পাশেই গায়ে গায়ে বেড়ে উঠেছে বহুতল এপার্টমেন্ট। এর নাম যদি উন্নয়ন হয় তাহলে বলার কিছু নেই।

আমার স্ত্রীর ভাগ্নে-বৌ মাশা, কিছুদিন আগেও ও সিডনি ছিল, এখন ঢাকায়, আমাকে কিছু বই উপহার দিয়েছে। তার একটি বই, আমার প্রিয় শিক্ষক জনাব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের লেখা ‘সুফলা ধরিত্রী’। তাতে স্যার যা বলেছেন তাই ধার করে বলি, “এই শহরে আজ আকাশ নেই, খোলা জায়গা নেই, হাঁটার সুযোগ নেই, জোছনা-পূর্ণিমা নেই, নিশ্বাস নেবার অবকাশ নেই। রুক্ষ নিষ্ঠুর বেদনাময় এ শহরে কেবল আছে দৈত্যের মত আকাশস্পর্শী ইট আর পাথরের দুর্গ আর গায়ে গায়ে ঠেলাঠেলি করা অন্ধকার আর ঘিনঘিনে দালানের অশুভ উদ্ধত মাথা”।

পান্থপথের রাস্তার ফুটপাথ রাস্তা থেকে প্রায় এক হাত উঁচু। এসব কোন প্রকৌশলীর হাতে ডিজাইন করা খুব জানতে ইচ্ছে করে। রাস্তায় Kerbside বলে কিছু আছে তাও মনে হল না। আর মানুষ ! যত্র তত্র আবর্জনা, পানের পিক, থুতু, সিগারেটের অংশবিশেষ নির্দ্বিধায় ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে ফুটপাথ ও রাস্তায়। কিছু বাস, মিনি বাস দেখলাম যার পেছন দিকে কোন সিগন্যাল লাইট এর Provision ই রাখা হয়নি। কি করে এসব বাস রুট পারমিট পেল তাই ভাবছিলাম। সমস্ত সভ্যতা-ভব্যতা, আইন-রীতি, জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে উঠে এ কোন উন্নয়নের পিছনে আমরা ছুটছি। আমরা বলছি, “আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে”। তাহলে ভারত-চীন কি উন্নয়নের উড়াল সড়কে? আমেরিকা-ইউরোপের উন্নত দেশগুলো কি উন্নয়নের আকাশ সড়কে? ওরা কি তাই বলছে? বাগাড়ম্বর ও বাচালতা আমাদের দুর্বিনীত ও অসহিষ্ণু করে তুলছে এটা কি আমরা বুঝতে পারছি? এসব ভেবেই কি কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ !

হঠাৎ করে আমি আসার দু’দিন আগে আম্মার জ্বর এলো। আম্মার কাশীর সাথে বের হওয়া কফের রঙ হলুদ হওয়ার কারণে আবার শুরু করা হল Meropen নামের একটি এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন। এতদিন যাবত জ্বরের এ উপসর্গটি দূরেই ছিল। এটি হল যখন আম্মার হাতে পায়ে কোন vein পাওয়া যাচ্ছিল না তখন ডক্টর মোহাম্মদের পরামর্শ অনুযায়ী শরীরের ডান দিকে কাঁধের নিচে ও বুকের উপরে Intravenous therapy (IV) এর ব্যবস্থা করা হল তার দু’দিনের মাথায়। জ্বর এখনও আছে। একে কোন ভাবেই থামানো যাচ্ছে না। জানিনা, ভবিষ্যৎ আমাদের কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে !

আমার সব ছোট ভাই আম্মাকে রেখেছে অতন্দ্র প্রহরায়। পৃথিবীতে সব সন্তানের কাছেই তার মা’র মত প্রিয় জিনিস কমই আছে। তারপরও আমার মা যে একটু আলাদা। ১৯৬৩ সালে ঢাকায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় আমার বাবা’র মৃত্যু হয়। এখনকার মত তখন মৃত্যু এত সহজ ছিল না ! তখনকার জনপ্রিয় পত্রিকা ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ এর প্রথম পাতার ডান কলামে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এ খবর ছাপা হয়েছিল। এ খবর পড়ে দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ আমাদের খোঁজ নিতে এসেছিলেন। এমন কি ৩/৪ টি পরিবার দীর্ঘ কয়েক বছর আমাদের খোঁজ খবর রেখেছিলেন। আমার মা’র বয়স তখন চব্বিশ। আমরা চার ভাই। আমার বড় ভাইয়ের বয়স তখন সাত আর ছোটটির মাত্র এক। এর পরের অধ্যায় আমাদের বড় করার জন্য তার অবিরত সংগ্রামের এক অপরাজেয় কাহিনী। তাই আমার ছোট ভাই ও তার স্ত্রী এ মুহূর্তে তাদের জীবন-সংসার বাদ দিয়ে রাত-দিন পড়ে আছে হাসপাতালের কেবিনে। ডাক্তার/নার্স/আয়াদের পিছনে তারা সারাক্ষণ যাতে আম্মার বিন্দুমাত্র কষ্ট না হয় !

আবার ফিরে আসি হাসপাতালের কথায়। একদিন রাউন্ডে এসে প্রফেসর সাহেবের পি এ আমার ডাক্তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলতে শুরু করলেন, “কানাডা আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া থেকে ফোন করে অনেকেই রোগী সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন”। “অমুক আপনার কে, তমুক আপনার কি হয়”। সেই ব্যক্তি কে আমি দেখেছি জুনিয়র ডাক্তার কে ধমকাতে, জুনিয়রের হাত থেকে হ্যাঁচকা টানে ফাইল টেনে নিতে। সে তুলনায় আমি জুনিয়র ডাক্তার, নার্স ও আয়াদের দেখেছি কাজে ও আচরণে অনেক বেশী মানবিক।

আম্মাকে দেখতে, সহানুভূতি ও দোয়া জানাতে হাসপাতালে এসেছেন অনেক মানুষ। আত্মীয়, অনাত্মীয়, পরিচিত-অপরিচিত অনেকের সঙ্গে দেখা ও কথা হল। কোন কোন স্বজনের সঙ্গে দেখা হল কুড়ি/পঁচিশ বছর পর। অনেকে নানা ভাবে, নানা প্রক্রিয়ায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

একদিন, এমনি একজন আত্মীয়, একসময় মেডিসিনের নামকরা একজন প্রবীণ প্রফেসর এলেন। অনেকক্ষণ ধরে আম্মাকে দেখলেন, ফাইলের আদ্যোপান্ত পড়লেন। জিজ্ঞেস করলেন, উনার বয়স ঠিক কত। আমি বললাম, “উনআশি”। উনি কিছু বললেন না। ফিরে যাবার সময় আমি উনাকে লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলাম। উনি আমাকে বললেন,

“আশাপ্রদ হওয়ার মত কিছু দেখছি না”।

কিন্তু আমি তো আশা ছাড়তে চাই না।

যতদূর মনে পড়ে শামসুর রাহমান তাঁর এক কবিতায় বলেছিলেন “আমার মাকে আমি কোনদিন গান গাইতে শুনিনি”। কিন্তু আমি শুনেছি এবং আবারও তা শুনতে চাই।


আগের অংশ



রিয়াজ হক, সিডনি




Share on Facebook               Home Page             Published on: 15-May-2018

Coming Events:
বৃষ্টির সম্ভাবনার কারণে মেলার তারিখ ১ দিন পিছিয়ে ২১ এপ্রিল ২০২৪ (রবিবার) করা হয়েছে......




A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far