হায়দার সাহেবের জীবনের হিসাব রিয়াজ হক
(প্রথম দিন)
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে আকাশটা দেখে আবারও মনটা খারাপ হয়ে গেল হায়দার সাহেবের। একি বিচ্ছিরি শোকাতুর দিন ! সারা আকাশ যেন বিধবা-বিষণ্ণ করুন চেহারা নিয়ে স্থবির হয়ে আছে। গাছের পাতারাও স্থির ; মনে হয় কি এক অজানা দুঃখ-বোধে কাতর। বাসার সামনের রাস্তাটা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা মৃত প্রাণীর মতই; নিশ্চুপ। নিথর।
জুলাইয়ের শুরুতে সিডনীর হু হু করা শীত অবাধ্য গোঁয়ার বালকের মত ঘাড় তেঁরা করে জেকে বসেছে। নড়ছে না। সপ্তাহ খানেক হল এমন চেহারায় সিডনী। জানালা দিয়ে যতদূর চোখ যায় আকাশে বা মাটিতে কোথাও কোন আশার চিহ্ন দেখতে পান না হায়দার সাহেব। পিঠ ও কোমরের ব্যথাটা যেন জোরে শোরে জানান দিয়ে গেল , ‘তোমার বয়স হয়ে গিয়েছে হায়দার। তুমি সত্তুর অতিক্রম করেছ অনেক আগেই’। “দ্যুর , সত্তুর বা পচাত্তুর একটা বয়স হল ! এদেশে নব্বই এই তো কত তরতাজা প্রাণবন্ত জীবন যাপন করছে মানুষ” মনে মনে নিজের কথাগুলো নিজেকেই শোনাতে থাকেন হায়দার সাহেব। এমন সময় একরাশ নিস্থব্ধতা ভেঙ্গে বেজে উঠে বাসার ফোন।
ধীর পায়ে বেড রুম থেকে লিভিং রুমের দিকে এগিয়ে এসে ফোন ধরেন হায়দার সাহেব। “হ্যালো” বলতেই ও প্রান্ত থেকে আদুরে ভঙ্গিতে দুয়ারীর কণ্ঠ ঃ • হ্যায় আব্বু , স্টিল ইউ আর ইন বেড ? হোয়াট হ্যস হ্যাপেন্ড টু ইউ ? এখন সিডনীতে তো সকাল সাড়ে ন’টা বাজে , ঠিক ? তোমার কি আরও সকালে ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে যাওয়ার কথা না ? কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই দুয়ারী এক নিঃশ্বাসে বলতে থাকে ঃ • এখন থেকে বার ঘন্টা পরেই আমরা রওনা হচ্ছি এয়ারপোর্টে। সে কথা জানাতেই তোমাকে ফোন দিলাম। আর আমাদের আইটেনারি তো আগেই ই-মেইল করে পাঠিয়েছি। ভাল করে দেখে নিও সিডনী এয়ারপোর্টে আমাদের এরাইভেল টাইমটা। তুমি তো আবার আজকাল অনেক কিছু ভুলে যাও। তো ভাল থাক। আমাদের গোছ গাছ এখনও অনেক বাকি। বলে স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে ফোন রেখে দেয় দুয়ারী।
ফোনটা ছেড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে বাথরুমের দিকে পা বাড়ান হায়দার সাহেব। তিনি যে বাথরুমটা ব্যবহার করেন তা বাড়ির একেবারে ভেতরের অংশে। এর ভেতরের ঠাণ্ডাটা যেন সাইবেরিয়ার বরফ শীতল অঞ্চলের ঠাণ্ডাকেও হার মানাবে। যদিও সাইবেরিয়ায় কখনও যাওয়া হয়নি হায়দার সাহেবের তথাপি চলচ্চিত্র ও ছবিতে দেখে-শুনে অনুভব করতে পারেন ঠাণ্ডার মাত্রাটা।
তারপরও বাথরুম হিটার লাইটটা উনি জালালেন না। শুধু শুধু বাড়তি এনার্জি ও বিদ্যুৎ খরচ ! শীতের এই অতিরিক্ত কষ্টটুকু উনি সহ্য করার অভ্যাস তৈরি করেছেন বহু আগে থেকেই। যেমন শীত যতই তীব্র হোক উনি বাসার সেন্ট্রাল হিটিং কখনই চালু করেন না। তেমনি বাসার কোন রুমেই আলাদা কোন ইলেকট্রিক ও গ্যাস হিটারও ব্যবহার করেন না।
আজকের কথা নয় , সেই ১৯৬৭ সাল থেকে উনি দেশের বাইরে। পড়াশুনা , প্রশিক্ষণ ও চাকরীর সূত্রে এশিয়া , আমেরিকা ও মধ্য প্রাচ্যের বেশ ক’টি দেশ ঘুরে শেষে অস্ট্রেলিয়া এসে স্থিত হয়েছেন। সেটা ১৯৭৬ সালের কথা। ১৯৬৬ তে অস্ট্রেলিয়ার হোয়াইট পলিসি রোধ ও ১৯৭৫ এ ডিস্ক্রিমিনেশন অ্যাক্ট পাশের পর অনেক ভেবে চিন্তে ফেডারেল গভরমেন্টের চাকুরী নিয়ে তার অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী জীবন বেছে নেওয়া।
এ জীবনে কত রঙ ঢঙের আবহাওয়ার মোকাবেলা করেছেন তিনি। অনেকটা সেই কৈশোর উত্তীর্ণ টিনেজ তরুণীদের মতই এর রূপ-রস-গন্ধ। কখনও সরব। কখনও নীরব। কখনও ঝাঁঝাল। কখনও হিমশীতল। কখনও হাসতে হাসতে পেটে খিল ; কখনও কাঁদতে কাঁদতে নিথর দিল। এই টিনেজ মেয়েদের যেমন প্রশ্রয় দিতে নেই ; তেমনি দরকার নেই আবহাওয়া নিয়ে এত আদিখ্যেতার। • “ভাই, শীত যা পড়েছে না , জমে যাচ্ছি। দেখেন ক’প্রস্থ পোশাক পড়েছি” বা • “এত গরমে শরীরে কাপড় রাখাই দায়”। ইত্যাদি বলে যারা নিজেদের পোশাক ও ভুমিকাকে অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চান তিনি তাদের দলে নন। আবহাওয়া , আবহাওয়াই। এটা ছিল , আছে , থাকবেই। এটা মানুষের জীবনের মতই , গাছের বেঁচে থাকার মতই নানা রূপে ও চরিত্রে বদলাবে। এ নিয়ে এত ব্যস্ত হবার কি আছে। তার চেয়েও বড় কথা , একে কেন্দ্র করে , বাড়তি আলো ও তাপের প্রবাহ বাড়িয়ে অর্থ অপচয়ের কোন যুক্তি খুঁজে পান না হায়দার সাহেব।
তবে তার এসব ‘কু’যুক্তি কখনই পছন্দ হয়নি ময়ূরীর। সেই পাকিস্তান আমলেই প্রায়-প্রেম করেই ময়ূরীকে বিয়ে করেছিলেন হায়দার সাহেব। ‘প্রায়-প্রেম’ বলছেন এজন্য যে ঢাকার মালিবাগের তাদের পাশের বাড়িরই মেয়ে ছিল ময়ূরী। কাটা চেহারার , শ্যামল ছায়ায় ঢাকা চন্দ্রাকৃতি পাতলা মুখের ময়ূরীকে সে সময় তার ‘মধুবালা’ বলেই মনে হত। ময়ূরীর ব্যক্তিত্বের মধ্যে কি যেন একটা ছিল , সে জন্য সাহস করে কোনদিন তার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারেন নি হায়দার। তবে দু’চারবার চোখা চোখি হওয়াতেই বুঝে নিয়েছিলেন ময়ূরীরও তাকে একবারে অপছন্দ নয়। অথবা বলা যায়, একটা নিরব প্রশ্রয়ের বেখেয়ালি ভাব ছিল তার চাহনিতে। তবে শত চেষ্টাচরিত্র করেও তার গভীরতাটা ঠাহর করে উঠতে পারেন নি হায়দার।
সুবোধ বালক ও ভাল ছাত্র হিসেবে পাড়ায় নাম ছিল হায়দারের। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে পরিবারের তরফে ময়ূরীকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে ও দু’তরফে তা গ্রহণযোগ্য হতে কখনই সমস্যা হয়নি। ময়ূরী তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে। হায়দার সাহেব পড়েছেন অর্থনীতিতে আর ময়ূরীর বিষয় ছিল ইন্টারন্যাশনাল রিলেসন্স।
“আহা, সংসার জীবন শুরুর দিনগুলো ছিল কতই না মধুর। ছোট বেলার সেই ডাংগুলি বা ‘ছি-বুড়ি’ খেলার মতই কত না আনন্দের”।
বড় মেয়ে দুয়ারীর জন্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেই সত্তুর সালের কথা। হায়দার সাহেব তখন পি এইচ ডি র ছাত্র। ময়ূরীরও মাস্টার্স একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কত নিষেধ করেছেন হায়দার , সাধ্যমত যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছেন ময়ূরীকে , “নিজের জীবনের ভিতর আরেকটি জীবনকে পুষে , এত কষ্ট করে ঘর-বাহির সামাল দিয়ে দরকার নেই আর পড়াশুনার”। কিন্তু ভীষণ অদম্য তেজ মেয়েটার। কিছুতেই শুনল না। দুয়ারীর জন্ম ও ময়ূরীর মাস্টার্স তাই এক সূত্রে গেঁথে গেল। দুটোরই শুরু ও শেষ হল একই বর্ষে।
এর তিন বছরের মাথায় দ্বিতীয় মেয়ে কাবেরির জন্ম। তবে ততদিনে, দু’জনের কাজ ও সংসার জীবনের প্রতিদিনের ছোট ছোট মতামত কখন যে মতান্তরে পৌঁছে, সম্পর্কের সহনীয় ফাঁকটাকে বিশাল ফাটলে পরিনত করেছে বুঝতে পারেন নি হায়দার।
প্রতিদিনের জীবনে যেমন হয় আর কি। খাবারে হায়দার সাহেবের বিশেষ পছন্দ ভুনা খিচুড়ি , কষানো খাসীর মাংস ও ইলিশের দু’পেয়াজা। ময়ূরীর পছন্দ ভাপ উঠা গরম সাদা ভাত, ছোট মাছের চচ্চড়ি আর মুগের ডাল।
খাবারের মত পোশাকে অবশ্য অতটা সৌখিন নন হায়দার সাহেব। সকল ঋতুতেই তার পছন্দ চলনসই শার্ট-প্যান্ট। তবে কোন গাঢ় রঙ নয় ; তার পছন্দের রঙ ছাই। অন্যদিকে ময়ূরীর পছন্দ শাড়ি আর সালোয়ার কামিজ। তবে তা নির্ভর করে ঋতুর বিবর্তনের উপর। গাঢ় নীল রঙ ময়ূরীর অসম্ভব প্রিয়। ময়ূরী সাঁজতে ও সব কিছুকে সাজাতে পছন্দ করে।হায়দার সাহেব এর অনেক কিছুকে অপ্রয়োজনীয় ও বাহুল্য মনে করেন।
ময়ূরীর পছন্দ রবীন্দ্রসঙ্গীত। অন্যদিকে হায়দার সাহেব আজ অবধি মনস্থির করতে পারেন নি যে কখনও কখনও সঙ্গীত পছন্দ করলেও তার পছন্দের ক্ষেত্রটা কোথায় বা কোন দিকে। এ বিষয়টির ব্যাখ্যা হতে পারে এভাবে যে জীবনে বহু জিনিসের মতই সঙ্গীতের ব্যাপারেও তিনি পছন্দ-অপছন্দের দ্বিধায় ভুগেন।
তবে যাচাই করে জিনিস কিনতে ও দরদামে না ঠকতে বরাবরই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হায়দার সাহেব। এ নিয়ে দোকানীদের সাথে নানা তর্কবিতর্ক ও বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়তেও কখনও দ্বিধা করেন না হায়দার। এমন অবস্থায় ময়ূরী নীরবে প্রস্থান করে সেখান থেকে। একে ওর মনে হয় রুচি ও সংস্কৃতিতে অশ্রদ্ধাবান একজন মানুষের কাজ।
৭৬ এর শেষ ভাগে অস্ট্রেলিয়ায় এসে তৃতীয় সন্তান সাফাতের জন্মের পর দুজনের ভাব-ভাবনা , চিন্তা-চেতনা , পছন্দ ও সিদ্ধান্তের ফাটল এতোটা গভীর ও ভয়ংকর হয়ে উঠল যে দুজন আলাদা ঘর ও বিছানায় থাকা শুরু করলেন। তারপর একসময় পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। ময়ূরী তার তিন সন্তানকে নিয়ে সিডনী ছেড়ে ডারউইন চলে গেল। হায়দার সাহেব কিছুতেই কিছু করতে পারলেন না। দুএকজন বন্ধু যারা ছিল, বলেছিল আইন আদালতের শরণাপন্ন হতে। হায়দার সাহেব জানেন এতে লাভ হতোনা কিছুই। আইন দিয়ে তো আর ভালোবাসার অতল শূন্যতাকে পূরণ করা যাবে না। সেই থেকে ক্লান্ত ও বিষাদে ভরা এক জীবন যাপন করছেন হায়দার সাহেব। কি ভাবে এ সম্পর্কের নামকরন করবেন আজও জানেন না হায়দার। কাগজে-কলমে তারা বিচ্ছিন্ন হননি ঠিকই তবে গত চল্লিশ বছরে দুজনের কখনোই আর দেখা বা কথা হয়নি।
তিন সন্তান সহ তার বাসা ছেড়ে চলে যাবার আগ মুহূর্তে ময়ূরীর শেষ কথাগুলো, আজ এত বছর পর এখনও মনে পড়ে হায়দার সাহেবের। “জীবনের ছোট ছোট তুচ্ছ বিষয়গুলোতে জয়লাভের গৌরব যে ব্যক্তিকে মোহগ্রস্থ করে রেখেছে সে ব্যক্তির সঙ্গে আর যাই হোক সহজ , সরল , আনন্দের জীবন যাপন করা সম্ভব নয়”। “আমি অনেক চেষ্টা করেছি, আর নয়”।
মাত্র বছর পাঁচেক আগে বড় মেয়েটা তার সঙ্গে যোগাযোগ করে দুজনের সম্পর্কটাকে টেনে-টুনে দাঁড় করিয়েছে। কি কারনে সে এই উদ্যোগ নিয়েছিল বা এখনও জড়িয়ে আছে তার রহস্য আজও উদ্ধার করতে পারেন নি হায়দার সাহেব। বাকী দুসন্তান নাকি তার কথা শুনতেও চায় না। পিতার জন্য নাকি একরাশ ঘৃণাই তাদের উত্তম উপহার।
(দ্বিতীয় দিন)
সকালে ঘুম থেকে খুব তাড়াতাড়ি জেগে গেল মিথুন। সকালের মেঘলা আকাশ দেখে তার মনে পড়ে গেল সেই বিখ্যাত গানটি “এমনও দিনে তারে বলা যায় , এমন ঘন ঘোর বরিষায়...”।
কিন্তু এখন তো বরষা নয়, হাড় কাঁপানো শীত। ঘরের অয়েল হিটারটাও পারছে না প্রতিযোগিতা করে শীতটাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে। তার মধ্যেই বিছানা থেকে উঠে ভাল করে গরম কাপড় জড়িয়ে নিল মিথুন। আজ সে একটি বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত। তাকে পৌঁছাতে হবে ওয়ালি পার্ক থেকে পেনান্ট হিলস স্টেশনে। তার চাচা হায়দার সাহেব তার বাসা ওয়েস্ট পেনান্ট হিলস থেকে কাছাকাছি এ স্টেশনেই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবেন। সেখান থেকে দুজন যাবেন সিডনী এয়ারপোর্টে দুয়ারীকে রিসিভ করতে।
প্রায় চার বছর হল মিথুন সিডনীতে। হায়দার সাহেবের স্পন্সরশীপেই আন্ডার গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট হিসেবে ২০১২ সালে সিডনীতে এসে সে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করেছে। তার বাবা ইসমাত আলী হায়দার সাহেব মানে হায়দার আলীর ছোট ভাই। বয়সে প্রায় পনর বছরের ছোট সে। হায়দার আলীর জন্মের পর একে একে ছ’টি সন্তান জন্ম দিয়ে আঁতুড় ঘরে মারা যাওয়ার পর অষ্টম সন্তান হিসেবে অলৌকিক ভাবে বেঁচে যাওয়া ইসমাত আলীর চার সন্তানের কনিষ্ঠ এই মিথুন। বহু বলে কয়ে , অসংখ্যবার অনুরোধ করে তবে হায়দার আলীর স্পন্সরশীপে তার অস্ট্রেলিয়ায় আসা। এর মর্তবা সে জানে। তাই চাচার উপর মিথুনের আনুগত্য সীমাহীন। কিন্তু প্রায়শই ভাবলেশহীন , মুখ গুমড়ে থাকা , স্বল্প কথার এ লোকটাকে আজও বুঝে উঠতে পারেনি মিথুন। সপ্তাহে বিশ ঘণ্টা রাত জেগে এক বেকারিতে কাজ করে সে। তার বাইরে এক বাংলাদেশীর স্কুল পড়ুয়া চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর দুজন ছাত্রছাত্রীকে টিউশনির সুবাদে তার রোজগার যা হয় তা দিয়ে টিউশন ফি , ঘর ভাড়া , খাবার , পোশাক সব কষ্টে সৃষ্টে হয়ে যায়। এত কিছুর ভেতরে তার একটাই লক্ষ্য গ্রাজুয়েশন শেষ করে অস্ট্রেলিয়ায় পি আর নেওয়া ও পার্মানেন্ট কোন কাজে ঢুকে যাওয়া। প্রতি মুহূর্তে সে স্মরণ করে বিদায় বেলায় ঢাকা এয়ারপোর্ট এ তার মায়ের সেই করুন আদ্র মুখ। যে মুখে একটিই আর্তি “বাবা, তুমি ভাল থেক”। একে কখনোই দৃষ্টি থেকে মুছে দিতে চায় না মিথুন। ওটাই তার সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি।
মিথুনরা চার বন্ধু ওয়ালী পার্কের দু’রুমের একটি ইউনিট ভাড়া নিয়ে অনেকটা ঢাকার মেসের আদলে বাস করছে। বাজার , রান্না , ঘর গোছান সব করতে করতে জীবনের অভিজ্ঞতার পরিধিটাকে একটু একটু করে বাড়িয়ে নিচ্ছে। সম্প্রতি তাদের এক বন্ধু, অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারের সন্তান হাসান একটি একযুগের পুরনো টয়োটা করলা গাড়ি কিনেছে। সে রাজিও ছিল , মিথুন তার চাচাকেও বলেছিল। হাসানের গাড়িটা নিয়ে সরাসরি এয়ারপোর্ট যাওয়ার প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু হায়দার আলী সাহেবের যুক্তি অন্যত্র। কেন সে এয়ারপোর্ট এ গাড়ি নিয়ে গিয়ে অযথা পার্কিং এর পয়সা দিবে , সিডনী এয়ারপোর্ট এর পার্কিং ব্যবসাটাকে একনামে ডাকাতি বলা যায় বলে চাচা মত দিয়েছিলেন। তার চাচার সিদ্ধান্ত হল যে সে ওয়ালি পার্ক থেকে ট্রেনে করে পেনান্ট হিলস স্টেশনে পৌঁছাবে , সেখান থেকে মিথুন সহ তারা এয়ারপোর্ট পৌঁছে মিথুনকে নামিয়ে চাচা এয়ারপোর্ট এর বাইরে চলে যাবে। মিথুন দুয়ারীর ফামিলিকে রিসিভ করে তার চাচাকে ফোন দিলে তবে চাচা এসে গাড়ি নিয়ে মিথুন সহ সবাইকে উঠিয়ে তবে এয়ারপোর্ট ত্যাগ করবে। তাতে করে তাকেও বিশ/পঁচিশ ডলারের এই বাড়তি পার্কিং ফি খরচ করতে হবে না। যেই কথা , সেই কাজ। দুয়ারী যখন তার হাসবেন্ড , দশ/বার বছরের দুই সন্তান ও আট/দশটা সুটকেস নিয়ে সিডনী এসে পৌঁছল তখন হায়দার সাহেবের বড় সড় এস ইউ ভি টাকেও মনে হল অনেক ছোট।
সিটে হায়দার সাহেব সহ পাঁচজনের বসার পর যা জায়গা ছিল তা সব লাগেজ দিয়ে পূর্ণ হয়ে গেল। মিথুনের বসার মত আর কোন জায়গা রইল না। হায়দার সাহেব গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে, যেন এটাই অবধারিত ছিল এমনি নিশ্চিত ভঙ্গি নিয়ে মিথুনকে উদ্দেশ্য করে বললেন , “তুমি ট্রেনে চলে যাও , পরে যোগাযোগ কর”।
মিথুন নিরব , মন্থর পায়ে সিডনী ডোমেস্টিক টার্মিনালের ট্রেনের টিকেট কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াল। বলল , “হিয়ার টু ওয়ালী পার্ক প্লিস। এডাল্ট। সিঙ্গেল”।
উত্তর এল , “এইট্টিন ডলার এন্ড টুয়েন্টি সেন্ট প্লিস”।
ওদিকে এয়ারপোর্ট ছেড়ে এম ফাইভ টানেলে ঢুকতে ঢুকতে হায়দার সাহেবের মুখে কিঞ্চিৎ আনন্দের ঝিলিক খেলে গেল , “ মিথুনটা এসেছিল বলে রক্ষা। বাঁচা গেছে সিডনী এয়ারপোর্টের এই ডাকাতির পার্কিং ফি থেকে” !
রচনা কালঃ জুলাই, ২০১৬
 রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া Jsfn21@gmail.com
|