bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













গল্প
একটি বিবাহের প্রস্তাব
রিয়াজ হক


(অনির্দিষ্ট কাল-সময়-পাত্রপাত্রী যদি কোন নির্দিষ্ট সময় ও চরিত্রের সঙ্গে মিলে যায়,
মিলতেই পারে। তবে তার অর্থ এই নয় যে আমি তাদের নিয়েই লিখেছি!)



(এক)


‘বউ-ঝি’ আর ‘কমলা লেবু’ এই দুটো কথা মনে রাখলেই হবে, বলে আমার দিকে একটি আপোষহীন নিশ্চিত ভঙ্গী নিয়ে তাকায় ফারিন। আমি স্মিত হেসে নীরবে মাথা দোলাই আর নিজেকে নিজে শুনিয়ে অস্ফুট বলতে থাকি ‘বউঝু মাদাম” (“ফারিনের কথায় যা ‘বউ-ঝি’), “কোমো তালেভু” (ফারিনের কথায় যা কমলা লেবু) অর্থাৎ হ্যায় ম্যাডাম, আপনি কেমন আছেন বা আপনি কেমন যাচ্ছেন।

আজকে ফ্রেঞ্চ ভাষা শিক্ষার চতুর্থ ক্লাস।

“এ মূহুর্তে দুনিয়ায় বেঁচে থাকা তাবৎ ভাষার মধ্যে ফ্রেঞ্চ একটি ভীষণ মিষ্টি ভাষা আর ফ্রেঞ্চ ছবির (চলচ্চিত্রের) কথা কি বলব, কেবল মন নয়, দেহও যেখানে প্রেমের অনুষঙ্গ, কেবল দুঃখ নয়, আনন্দও যেখানে জীবন কে ঘিরে রাখে প্রচণ্ড ভাবে এত বাস্তব বাদী এত সহজ তাদের জীবনের চিত্রায়ন”। ব্যাচেলর বন্ধুদের একান্ত আড্ডায় মুস্তাকের এই কথাগুলো এত মনে ধরে যায় যে কোন দিক চিন্তা না করেই আমি ফ্রেঞ্চ শেখার জন্য ধানমন্ডির ‘আলিয়স ফ্রসেজ’ এ ভাষা শিক্ষার প্রারম্ভিক কোর্সে ভর্তি হয়ে যাই। ভাষার বাইরের বাড়তি প্রাপ্তি হল প্রতি মাসে বিনে পয়সায় অন্তত দুটি ফ্রেঞ্চ মুভির দর্শন।

ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রী গোটা বারো জন। অনুমান করি বিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে সবার বয়স। মেয়ের সংখ্যা চার জন। এই চারজনের মধ্যে একজন একেবারে আউটস্ট্যান্ডিং; সেই ফারিন। শুরু থেকেই বাকি এগার জনের সম-দৃষ্টি সীমায় আসন নিয়েছে ফারিন।

সাধারণ শ্যাম বর্ণ বাঙালি রমণীদের চেয়ে একটু উজ্জ্বল সে। তবে কোন ভাবেই যাকে বলে ফর্সা তা সে নয়। কিছুটা মসৃণ তামাটে। নাক খাড়া। চিবুক উন্নত। চোখ কালো, রহস্যময়। ছিপ নৌকার মতই ছিপছিপে শরীর। লম্বায় গড় বাঙালি নারীদের ছাড়িয়ে পাঁচ ফুট ছ-ইঞ্চির কাছাকাছি। সে জন্য পাতলা স্যান্ডেলেই তাকে অনেক লম্বা মনে হয়। আর যেদিন সে সামান্য হিল স্যান্ডেল বা জুতো পড়ে ক্লাসে আসে সেদিন তার পাশে অন্য অনেকের মতই আমার নিজেকে অনেক ছোট মনে হয়। আর তার বয়স! সেটাই এক বিচলিত রহস্য ও মধুর গবেষণার বিষয়। বিশ না ত্রিশ তা কোন ভাবেই ঠাহর করা যায় না!

ফারিনের ব্যক্তিত্ব নীরবতায় যতখানি দৃষ্টি কাড়ে ততখানিই সে যখন সরব হয়; কথা বলে। ফ্রেঞ্চ ভাষার মতই তা মিষ্টি, আবেদনময়, চিত্তাকর্ষক।

ভাষা শিক্ষার ক্লাস শুরু হওয়ার সাথে সাথেই আমাদের বাকীদের অবস্থা দাঁড়াল ঐ ক্লাইভ লয়েডের বাংলা বলার মত। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই ফারিন যখন তা বলে মনে হয় ও যেন ফ্রান্সেরই কোন এক ঝলমলে তরুণী। কি অদ্ভুত ভাবে ওর কণ্ঠ ও উচ্চারণ আমাদের ক্লাসের ম্যডামের সঙ্গে যেন একই সুর ও ধারায় মিলে যায়।

ফলশ্রুতিতে যা হল, সবার মনোযোগের কেন্দ্র বিন্দুতে আটকে গেল ফারিন। আমি জিনিসটায় খুব মজা পেলাম। কেন? তার কারণ দুটি। প্রথমত পরিষ্কার অর্থে আমার এমন কোন যোগ্যতা নেই যা দিয়ে ফারিনের চোখে পড়তে পারি। দ্বিতীয়ত ফারিন কে না দেখে অন্যরা কে কেমন ভাবে ফারিন কে দেখছে তাই দেখতে লেগে গেলাম। ফলে আমার মজা পাওয়ার আর কোন সীমা পরিসীমা রইল না। কেউ সরাসরি, কেউ আড় চোখে, কেউ বা নানা শরীরী ভঙ্গীতে ফারিনের চিন্তা বা মনের ভেতরটা ছুঁয়ে যাবার চেষ্টা করতে লাগল। এ ক্ষেত্রে বয়স-বর্ণ-আকৃতি যেন কোন বাধা হয়ে দাঁড়াল না।

আমি অনেক হিসাব করে দেখলাম যে ফারিনের জন্য যোগ্য একজনই এ ক্লাসে আছে সে মিরাজ হোসেন। নায়ক-রাজ রাজ্জাকের মত চেহারা। দীর্ঘ দেহী, ফর্সা, সুন্দর গঠনের এ ধরনের পুরুষ খুব কম চোখে পড়ে। তার উপর পেশায় তিনি একজন প্রকৌশলী। সদ্য পাশ করে ঢাকার একটি নামকরা কন্সাল্টিং ফার্মে ডিজাইনে কাজ শুরু করেছেন। প্রথম দিন ম্যাডামের অনুরোধে আমাদের সবার পরিচয় প্রদানের সূত্র ধরেই আমি আপনাদের এত সব তথ্য দিতে পারছি।

আমি আসলে মনে মনে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের এক ধরনের খেলা নিয়ে মজে থাকতে খুব পছন্দ করি। নানা পারমুটেশন-কম্বিনেশনের মাধ্যমে এর সঙ্গে ওর সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, মিলন, বিপর্যয় বা বিরোধ সব তৈরি করে নানা সিচুয়েশনের মধ্য দিয়ে তাদের নিয়ে তাদের শক্তি, আবেগ ও বুদ্ধিমত্তাকে পরখ করি। এ খেলায় কোন জয়-পরাজয় নেই, কেবল আছে উৎকণ্ঠা ও উত্তেজনার নিরেট আনন্দ।

সে হিসেবেই আমি ফারিনের সঙ্গে মিরাজের বন্ধুত্বের একটি সম্ভাবনা খুঁজে পাই। যদিও জানিনা এ নিয়ে ফারিন বা মিরাজ আদৌ কিছু ভাবছে কি না!

চতুর্থ ক্লাসে যেয়ে ম্যাডাম দশ মিনিটের জন্য কথোপকথনের মাধ্যমে ফ্রেঞ্চ শেখার জন্য সামনে -পেছনে বসা প্রতি দুজন নিয়ে একটি করে গ্রুপ তৈরি করতে বললেন। আমি তৃতীয় সারিতে মাঝামাঝি বা দিকে বসে ছিলাম। ফারিন সেদিন দেরীতে ক্লাস শুরুর পর এসে আমার ঠিক পেছনে বসেছিল। ফলে যা হল সামনে আমি ও চতুর্থ সারিতে আমার পেছনে সে মিলে আমরা হয়ে গেলাম পরস্পর কথা বলার একটি দল।

আমি পেছন ফিরে তাকাতেই সে বলল, হ্যায়, কি যেন নাম, মিরান, আমার মনে হয় আপনি আমার চেয়ে বয়সে ছোটই হবেন তাই তুমি করে বললে নিশ্চয়ই মাইন্ড করবেন না।

আমি হতচকিত ও বিষণ্ণ হয়ে পড়ি। ম্লান মুখে বলি, ঠিক আছে। কিন্তু মন থেকে এ প্রশ্ন উবে যায় না যে সে কিভাবে বুঝে নিল আমি তার চেয়ে বয়সে ছোট। তাহলে কি তার বয়স ত্রিশ? কিন্তু দেখে তো বিশ বললেও কোন সন্দেহ হওয়ার কথা নয়। নিজেই নিজের সঙ্গে অনুমানের দ্বিধায় জড়িয়ে যাই। তাই তার সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন পথ খুঁজে পাই না।

এর পর শুরু হয় ভাষার চর্চা।
‘কোমো ভুজ আপ্লে ভু” মানে আপনাকে কি নামে ডাকব বা ডাকা হয়ে থাকে?
‘ভুজেৎ ফ্যাটিগে’ মানে আপনি কি পরিশ্রান্ত?
‘জোন সুই পা ফ্যাটিগে’ মানে না, আমি পরিশ্রান্ত নই। ইত্যাদি। চলতে থাকে এভাবেই। সেখানেই সহজ করে মনে রাখতে ফারিনের আবিষ্কার ঐ ‘বউ-ঝি’ আর ‘কমলা লেবু’।

এই দশ মিনিটের ক্লাসটি বেশ জমে যায়। সবাই খুব পছন্দ করে। যদিও বলাই বাহুল্য যে ক্লাসের সামনে যেয়ে প্রতি গ্রুপ কে কিছুটা নাটকের ভঙ্গিতে কথাগুলো বলতে বলায় শব্দের উচ্চারণ ও প্রকাশের আবেগ নিয়ে যথেষ্ট হাস্য-রসের সৃষ্টি হয়। ক্লাস শেষে হতেই একজন আমার কানের কাছে এসে ফিস্ ফিস করে বলে, ভাই আপনার তো ছাপ্পর ফারা ভাগ্য। আমরা চাইয়া পাই না, আপনি না চাইতে পাইয়া গেলেন! আমি শরমে সংকুচিত হয়ে পড়ি।

সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে আমি সাইকেল স্ট্যান্ডে চলে যেতে থাকি। এমন সময় পেছন থেকে ফারিনের কণ্ঠ, তোমার কি চলে যাওয়ার খুব তাড়া? হাতে নষ্ট করার মত কিছু সময় কি হবে?

আমি বিস্মিত হয়ে তাকাতেই সে বলে উঠে, চল গেট থেকে বের হয়ে মিরপুর রোডের উপর ঐ দোকান গুলোর দিকে যাই, আমার একটু ক্ষুধা লেগেছে। আমার হাতে কিছুটা সময় আছে, ড্রাইভার মাত্রই ফোন দিয়ে বলল, ও জ্যামে আটকা পড়েছে, আসতে আধ ঘণ্টা দেরী হবে।

ফারিন এমন ভাবে কথাগুলো বলল, যেন আমার সে অনেক দিনের পরিচিত, আমাকে এসব বলাই যায়। এমন কি নিশ্চিত হয়ে দাবীও রাখা যায়।

আমি সাইকেলে হাত রেখে ইতস্তত করতে থাকি দেখে সে আমাকে আশ্বস্ত করে বলে উঠে, আধ ঘণ্টার জন্য তোমার সাইকেল এখানেই থাক, কিছু হবে না।

আমি যন্ত্রের মত ফারিন কে অনুসরণ করতে থাকি। এর ওর গা বাঁচিয়ে একটু দূরত্ব বজায় রেখে ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকি।

একটি কনফেকশনারীতে ঢুকে সে দুটি প্যাটিস ও দুটি আইসক্রিমের কথা বলে। পেছন ফিরে শুধু বলে, অসুবিধা নেই তো? আমি মাথা নাড়ি অর্থাৎ নেই। কিন্তু আমি ভাল করেই জানি যে ঠাণ্ডা খাবার আমি খেতে পারিনা, বিশেষ করে শীতে। তারপরও এ মূহুর্তে আমার ভেতর থেকে কোন কথা আসছে না। আমি যেন প্লাবনে ভেসে যাওয়া খড়কুটোর মত কেবল ভেসে যাচ্ছি এক মোহাবিষ্ট গতির টানে।


(দুই)

ক্লাস শুরুর মাসের শেষ সপ্তাহে একটি ফ্রেঞ্চ মুভি দেখানো হল। ছবিটির ফ্রেঞ্চ নাম ‘লো থা’ ইংরেজিতে যা হল ‘দ্য ট্রেন’। এটি দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধের উপর নির্মিত একটি ফরাসী ভাষার ছবি। যদিও আমরা জানি যে ঐ একই নামে ১৯৬৪ সালে নির্মিত জন ফ্রাঙ্কেন হাইমারের পরিচালনায় বিখ্যাত অভিনেতা বার্ট ল্যাঙ্কাস্টার অভিনীত একটি নামকরা ইংরেজি ছবি রয়েছে। একই নামের ফরাসী এই ছবিটিতে যুদ্ধ কালীন সময়ে বিপর্যস্ত একটি পরিবারের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ক্রমাগত ছোটাছুটি সহ বিপন্ন জীবনের চিত্র আঁকা হয়েছে।

পরের ক্লাসেই ম্যাডাম ক্লাসের শেষ পর্যায়ে এসে ছবিটি সম্পর্কে কারো কোন বিশেষ মতামত থাকলে জানাতে বললেন।

প্রথমেই সুদর্শন মিরাজ উঠে দাঁড়াল। যুদ্ধের ফলে সার্বিক মানবিক বিপর্যয়ের ভেতরেও মানুষের মৌলিক চাহিদা খাবার-পোশাক-বাস স্থান যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন তার মানসিক ও শারীরিক চাহিদার পূর্ণতা এটাই ছবির মূল বিষয়। তার যেমন মনের প্রাপ্তি প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন দেহের যে জন্য ট্রেনের ভেতরে ঠাসাঠাসি করে ছুটে চলা বিপর্যস্ত মানুষের ভেতরেও নায়িকা খুঁজে ফিরে অন্য মানুষ, অন্য শরীর।

এর প্রতিবাদে দাঁড়িয়ে পরে ফারিন। জীবন বিপর্যয়ের ভেতর পরিচালকের এই দেহ সর্বস্বতার আবেদন দর্শক হিসেবে তাকে ক্ষুব্ধ ও প্রতারিত করেছে বলে সে জানায়। জীবনের মৌল বিষয় ‘বাঁচা’ যেখানে প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে সেখানে কি ভাবে নায়িকা তার দেহের সুখের কথা ভাবতে পারে তার বোধে আসে না বলে সে বিবৃত করে।

বাদ-প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠে সে আলোচনা। শুধু চুপ করে শুনে যায় মিরান। দুজনের বলার ভঙ্গি ও যুক্তি তাকে মুগ্ধ করে। সে ঠিক করতে পারে না কার পক্ষে নিজের রায় দিবে।

ক্লাস শেষ হতেই ফারিন ইশারায় তাকে কাছে আসতে বলে। আমন্ত্রণ জানায় তাকে নিউ-মার্কেটে যাওয়ার। স্কুল পড়ুয়া তার ছোট ভাইয়ের জন্ম দিনে উপহার হিসেবে দেওয়ার জন্য কিছু সে কিনতে চায়। সম্ভবত বই।

অনেক বইয়ের দোকান ঘুরে-ফিরে বই কিনে দুজনে যেয়ে একটি রেস্টুরেন্টে বসে। ফারিনের ইচ্ছা ফুসকা ও চটপটি খাবে।

অর্ডার দিয়েই ফারিন বলতে থাকে। আমাকে খেয়ালি ভাবার কোন কারণ নেই। আমি রীতিমত একজন বুদ্ধি সম্পন্ন সাধারণ জীব। ক্লাসে আমি একজন বন্ধু খুঁজছিলাম। মনে হল তোমার উপর বিশ্বাস রাখা যায়। কি বল, যায় না!

আমি ম্লান হেসে উঠি।

তোমার হাসি সব কথা বলে যায়। ছোটদের আদর, ভালোবাসা দিয়ে নির্ভেজাল বন্ধুত্ব করা যায়। কিন্তু বড়রা? বড়রা ওর বাইরেও বেশি কিছু চায়। আর চায় বলেই বন্ধুত্বের ভিতর তখন আধিপত্য ও লোভ বাসা বাঁধে। এমন বন্ধুত্ব টেকে না। অন্তত আমার টেকে নি। বলে ফারিন আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বাইরের প্রাঙ্গণে চলাচল রত মানুষের দিকে তাকায়।

আমি চুপ করে শুনে যাই।

তুমি অর্থনীতি নিয়ে পড়েছ। কোন এক এন জি ও তে কাজ করছ জেনেছি। বাকি নিজের কথা বল। ক’ভাই-বোন, সংসারে কে কে আছে ইত্যাদি বলে জানতে উৎসুক চোখে আবার আমার দিকে তাকায় ফারিন।

বাবা পক্ষাঘাত গ্রস্থ। বিছানায় শয্যাশায়ী। মা স্কুল শিক্ষিকা। আমি বড়। আমার ছোট আর এক ভাই, এক বোন। সবাই রংপুর শহরে থাকে। আমি কেবল ঢাকায়। চার বন্ধু মিলে এক সঙ্গে এক বাসায় আছি। মৃদু কণ্ঠে কথাগুলো বলি।

ক্লাসে আমার পরিচয় দিতে গিয়ে আমি সব কথা বলিনি। শুধু বলেছি একটি প্রাইভেট ফার্মে কাজ করছি। আসলে ওটা আমার বাবার ফার্ম। একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সাল্টিং ফার্ম। আমার বাবা একজন আর্কিটেক্ট। ওখানে আমি প্রশাসন ও অর্থের বিষয়টা দেখে থাকি। আমি অস্ট্রেলিয়া থেকে গ্রাজুয়েশন ও মাস্টার্স করেছি। ‘ল’ ও কমার্স আমার বিষয়। বছর চারেক হয় আমি ফিরে এসে বাবার সাথে কাজ করছি। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করে ফারিন।

আমি অতি দ্রুত মনে মনে হিসেব করে দেখি ফারিন আমার চেয়ে টেনেটুনে খুব জোর দু’বছরের বড় হতে পারে। হিসাব মিলিয়ে মনকে প্রবোধ দেই এই বলে যে সেক্ষেত্রে ‘তুমি’ সম্বোধন টা একটা ন্যায্যতা পেতেই পারে।

আমার আনমনা ভাব দেখে ফারিন তার হাতে থাকা বল পয়েন্ট দিয়ে টেবিলের উপর আমার হাতের কব্জিতে একটা আলতো টোকা দেয়।

কি? কেন এতদিনেও বিয়ে করিনি এই তো ভাবছ? করেছিলাম। টেকে নি। তাই সময় নিচ্ছি। চুপ আছি। তাতে করে ফ্যামিলির চাপ কিন্তু বন্ধ হয় নি। বন্ধ হয় নি নানা জনের নানা উৎপাত।

ফারিনের কথা শেষ হতে না হতেই এসে পড়ে ফুসকা ও চটপটি। খাওয়ার মাঝে আর কথা হয় না, কথা আগায় না।

এভাবে প্রায় মাস পাঁচেক কেটে যায়। এর মধ্যে বসা হয়েছে ধানমন্ডির লেক ও চন্দ্রিমা উদ্যানে। গিয়েছি ইস্টার্ন প্লাজায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টি এস সি তে। সবই ফারিনের ডাকে। এ এমন এক নিশির ডাক যাকে এড়ানো যায় না। করা যায় না অস্বীকার, অবজ্ঞা বা অবহেলা।

আমি ধরেই নিয়েছি যে বিয়ে না টেকার পরবর্তী আহত ও পীড়িত সময়ের জখম কাটিয়ে উঠতে ফারিন আমাকে বেছে নিয়েছে। আমার উপর ভর করেছে। এতে আমার কোন ক্ষতি নেই, সঙ্গ বোধের কুসুম কুসুম আনন্দ ছাড়া। যদিও বন্ধুরা কেউ কেউ আমার এ ভাগ্যে ঈর্ষান্বিত, কেউ বা আবার এ থেকে উদ্ভূত সমূহ আগাম বিপদেরও সাবধান বানী উচ্চারণে বিলম্ব করে নাই।

সত্যি অর্থে ফারিনের কাছে আমার কোন প্রত্যাশা নেই। আমি নিজে থেকে ওর কাছে কখনো কিছু জানতে চাই নি, চাই না। আমি কেবল শুনে যাই। ধরে নিয়েছি ওটাই আমার একমাত্র কাজ।

আজ ছ’মাসের টার্মের শেষ ক্লাস। ক্লাসের শুরুর আগেই আমি দেখতে পাই ফারিন আমার ক্লাস খাতা নিয়ে তার ভেতরে একটি কাগজ রেখে দেয়। আমি বিস্ময়ে ফারিনের দিকে তাকাই, দেখি সে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। খাতা খুলে দেখি কাগজে লেখা আছে, “ক্লাসের পর জরুরী কথা আছে, থাকবে”।

কি এমন জরুরী কথা যে লিখে জানাতে হবে? এমনি বললেই তো আমি থেকে যাই। মনে মনে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি।

ক্লাস শেষে আমি বিচলিত হয়ে বসে থাকি। ফারিন এসে ঝট করে, এই প্রথম আমার হাত ধরে বলে, চল কোথাও যেয়ে বসি। সবার চোখে প্রশ্ন বোধক চিহ্ন হয়ে আমরা ক্লাস রুমের বাইরে বেড়িয়ে পড়ি। আমরা কোন কথা বলছি না। মিরপুর রোড ধরে নিঃশব্দে হাঁটতে হাঁটতে আমরা দুটি প্রাণী বলাকার দোতলার চাইনিজ রেস্তোরায় ঢুকে যাই।

ফারিন অনেকগুলো খাবারের অর্ডার দিয়ে তবে আমার বিস্মিত মুখের দিকে তাকায়।
মিরাজের বাবা একজন সরকারী বড় আমলা। আমার বাবার বন্ধু। ও আমাদের ফার্মেই কাজ করে। অনেক দিন ধরে লেগে আছে আমার পেছনে। লেগে থাকার পাগলামিতে শেষ পর্যন্ত ফ্রেঞ্চ ক্লাসেও আমার পিছু নিয়েছে। আর ওর এই হ্যাংলামির জন্যই আমি ওকে পছন্দ করি না, না হলে ওর সব গুনই ছিল। যদিও ফ্যামিলি থেকে ওকে বিয়ে করার জন্য এ মূহুর্তে প্রচণ্ড চাপের মুখে আমি। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে যায় ফারিন।

আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি।

আমার কি করা উচিৎ সে নিয়ে আমি খুব অস্থিরতার মধ্যে আছি। তোমার কি মনে হয়? যেন সত্যিই সে আমার কাছে এর সমাধান জানতে চায়। যেন সত্যিই আমার কোন সিদ্ধান্তের মধ্যে নিহিত ওর বাঁচা-মরা এমন করুন ভঙ্গিতে ফারিন আমার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে।

সময় নিয়ে ভাবা দরকার। বলে আমি ওকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি।

চায়নিজের ছায়া-ছায়া আলোর খেলায় আমরা আবছায়া দুজন দুজনকে দেখতে থাকি। বাহ্যিক দেখা ততটা স্পষ্ট না হলেও অন্তরের দেখায় কোথাও যেন মরু ঝড় বয়ে যেতে থাকে।

অনেক ক্ষণ কোন কথা হয় না।

একসময় ওয়েটার এসে প্রারম্ভিক খাবার পরিবেশন করে। ফারিন আমার বাটিতে সুপ তুলে দিতে থাকে।

আমি অনেক সাহস সঞ্চয় করে ওর কনিষ্ঠ আঙ্গুল মৃদু ছুঁয়ে বলি, “Listen to your heart Fareen.”

আমরা নিঃশব্দে অনেকটা সময় নিয়ে খাবার শেষ করি। ফারিন বিল পরিশোধ করে। আমরা চেয়ার থেকে উঠে সিঁড়ি দিয়ে সন্তর্পণে নীচে নেমে যাই।

আমি ওকে একটা সি এন জি ঠিক করে দেই। সি এন জি তে উঠে পড়ে ও অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত ভাবেই ওর কোমল সুন্দর একটি হাত আচমকা আমার দিকে এগিয়ে দেয়। আমি হতচকিত হয়ে তা ধরতে গেলে, আমার ডান হাতটা ও ওর দুহাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে ভীষণ সাবলীল কণ্ঠে ফরাসী ভাষায় বলে উঠে, “ভ্য-তু মেপুসেহ” অর্থাৎ ভালো করে বাংলায় বললে যা দাঁড়াতে পারত তা হল, “তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে পার না মিরান”?





রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া, Jsfn21@gmail.com






Share on Facebook               Home Page             Published on: 15-Jun-2021

Coming Events: