অবিশ্বাস্য নয়, এমনও তো হয় (ঢাকা ও সিডনির গল্প) রিয়াজ হক
ঢাকা
১৯৯১ এর গ্রীষ্মের এক মনোরম দিনের কথা। শিশুর মুখের মত সরল ও সুন্দর ছিল সকালের আকাশ। ঝকঝকে তাজা রোদে ছিল তারুণ্যের আভাস। মৃদুমন্দ বাতাসে দোল খাচ্ছিল জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া।
সপ্তাহান্তে ছুটির দিনে আমি আমার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে গিয়েছি ঢাকার নিউমার্কেটে। ঘুরে-ফিরে আলস্যে সময় কাটানই মূল লক্ষ্য। একপর্যায়ে স্ত্রী গাউছিয়া মার্কেটের পেডেস্ট্রিয়ান ব্রিজের নিচে গোল হয়ে বসে থাকা দোকানীদের সঙ্গে পছন্দ ও দরদাম করছিল তার পায়ের স্যান্ডেল। আমি একটু সরে একেবারে তার পাশের অন্য দোকানীর কাছে যেয়ে আমার পায়ের মাপের স্যান্ডেল যাচাই করছিলাম। আমার ঠিক বা পাশে আরও দুজন ভদ্রলোক ছিল। দেখে মনে হল তারাও আমার মত মৌসুমি খরিদ্দার। আয়েশ করে, সময় নিয়ে স্যান্ডেল পছন্দ ও দরদামে ব্যস্ত ছিল।
এমন সময় আমার ডান পাশ দিয়ে, শাড়ী পরিহিতা এক সুশ্রী তরুণী নিচু হয়ে হেঁটে এসে আমার শার্টের বুক পকেটে কতকগুলো আমলকী দিয়ে বলল, এগুলো রাখ। আমি বিচলিত হয়ে তারস্বরে জী বলতেই, তরুণী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যরি, স্যরি। লজ্জায় তার সারা মুখমণ্ডল তখন রক্তবর্ণ। আমার মনে হল তার সারা শরীরের রক্ত বোধহয় মুখে এসে জায়গা নিয়েছে।
ওদিকে আমার বা পাঁশ থেকে এক ভদ্রলোক উঠে ঐ মহিলার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। আমার স্ত্রী তার বিস্ফোরিত চোখ নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল। সব দেখে মনে হল, এক মুহূর্তের মধ্যে যেন স্থির হয়ে গেছে নিউমার্কেট। থেমে গেছে এর মানুষ জন। চিত্রপট দাঁড়িয়ে গেছে এর যানবাহন। কান দিয়ে আমার চৈত্র মাসের শুকনো ধুলো উড়ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না আমি আছি কি নেই!
সিডনি প্রতিদিন, মানে সপ্তাহের কাজের পাঁচদিন আমার অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে কাজ শেষে আমার সহধর্মিণীকে ষ্টেশনের সামনে থেকে তুলে আনা। অবশ্য ষ্টেশনের সামনে কথাটা রূপক অর্থে যতটা ঠিক, প্রকৃত অর্থে ততটা নয়। কারণ প্যারামাটা ষ্টেশনের কোনটা যে সামনে, কোনটা পেছনে, কোনটা ডান বা বাম আজ অব্দি আমি তা মালুম করে উঠতে পারিনি। এ বিরাট ষ্টেশনকে ঘিরে আছে বিশাল মাপের শপিং সেন্টার, বাস টার্মিনাল ও অন্যান্য অফিস বিল্ডিং। এর সবকিছুর মাঝে মনে হয় স্থিরচিত্র দানবের মত আটকা পড়ে আছে প্যারামাটা ষ্টেশন। মুহূর্তের বিরতিতে ট্রেন যায় আসে। মানুষ এর পাকস্থলীতে ঢুকে পড়ে ও বেরোয়, এটা বোঝা যায় কিন্তু দিক বা পার্শ্ব বোঝা যায় না।
যাক। যে কথার জন্য এত কথার উৎপাত; আমার স্ত্রী কাজ করে সিডনী সিবিডি তে; ট্রেনই তার যাতায়াতের প্রধান ভরসা। কারণ উপায় নেই গাড়ী নিয়ে যাওয়া-আসার। একে তো ট্র্যাফিক দৌরাত্ম্যে ঘটে সময়ের নিরঙ্কুশ অপচয়। অন্যদিকে সিটিতে গাড়ী পার্কিং ফি এর গনগনে আগুনের তাপে ভস্মীভূত হওয়া থেকে বাঁচার জন্য বিত্তের সন্ধানে মধ্যবিত্তের ভরসা ঐ ট্রেন।
দিনটি ছিল ২০১৬ এর জুনের শেষ সপ্তাহের একদিন।
গত বিশ-ত্রিশ বছরে শীতের এমন সগর্ব উপস্থিতি সিডনীবাসী কমই দেখেছে। শীত যেন হিংস্র বন্য জন্তুর ধারাল দাঁত দিয়ে মাংস ভেদ করে হাড় অব্দি কামড়ে ধরছিল। সেদিন প্রায় সারাদিনই ছিল মেঘলা। কাজেই দিনের আলো কখন যে মুখ লুকিয়েছে টের পাইনি। চারিদিকে আবছায়া ঘন অন্ধকার। সন্ধ্যা একরকম জেঁকে বসেছে। এ পরিস্থিতিতে স্ট্রিট লাইটগুলোর আলোও হয়ে পড়েছে ম্রিয়মাণ।
আমি প্রতিদিন যেমন, তেমনি পার্ক ষ্ট্রীট ক্রস করে ষ্টেশন ষ্ট্রীট দিয়ে সোজা উত্তর-পশ্চিমে এসে বাঁ পাশের সিডনী ওয়াটারের বিশাল ইমারতটার সামনে মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য অপেক্ষমাণ একটি পার্কিং বে তে আমার সাদা টয়োটা কেমরি থামিয়েছি। ঠিক তখনই, ঝট করে গাড়ীর বাঁ পাশের দরজা খুলে ত্রস্থে ঢুকে পড়ল দীর্ঘদেহী ত্রিশোর্ধ প্রাণবন্ত এক ইংরেজ নারী। ঢুকে বসে পড়ে, সামনের দিকে সটান তাকিয়ে বলে উঠল, You are again late today . আমি ভ্যাবাচেকা। প্রশ্নের উত্তর দেব কি; অস্থির করুণ চোখে আমি তার দিকে তাকিয়ে।
কয়েক সেকেন্ড মাত্র। যখন সে বুঝল, কোন জবাব নেই, গাড়ীও সামনে চলছে না, পাশ ফিরে তাকাল। আর তাকিয়েই ভয়ঙ্কর উচ্চ কণ্ঠে Oh my Gosh........ বলে বিদ্যুৎ গতিতে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল।
আর এর অল্প পরেই আমার স্ত্রী মলিন মুখ নিয়ে গাড়ীতে এসে ঢুকতে ঢুকতে বলল, মনে হল একজন সাদা মহিলা নেমে গেল তোমার গাড়ী থেকে!
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|