কেন “বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র”! (শেষ পর্ব) রিয়াজ হক
আগেই বলেছি যে এডুকেশন এক্সটেনশন সেন্টার, দূর-শিক্ষণ কলেজ ও ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে আমরা কেন্দ্রের পাঠচক্রের ক্লাস করেছি। এও বলেছি যে এর সবই সম্ভব হয়েছে স্যারের নিরলস ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায়। এইসব প্রতিষ্ঠানের ক্লাসরুম হয়ে কেন্দ্র এক পর্যায়ে ইন্দিরা রোডের একটি ভাড়া করা বাড়িতে স্থানান্তর করা হয়। এ মুহূর্তে এই বাড়ীটির পোস্টাল এড্রেস বা নম্বর ঠিক মনে নেই। তবে এটুকু বলতে পারি যে বাড়ীটি ছিল এরশাদ সরকারের এক সময়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব এ আর এস দোহার বাড়ীর ঠিক উল্টো দিকেই।
এখানেই তখন প্রকৃত অর্থে কেন্দ্র বা কেন্দ্রের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ লাইব্রেরী গড়ার সূচনা বললে ভুল হবে না। তখন বই, শেলফ সব আসতে থাকে ও এর আকার বড় হতে থাকে। এর জন্য তখন প্রয়োজনীয় নিয়ম কানুনও চালু করা হয়। কেন্দ্রের জন্য স্যার দরকারি লোকবলও নিয়োগ করেন। এর বেশ পরে কেন্দ্র তার নিজস্ব ভবন বর্তমানের বাংলা মোটরে স্থানান্তরিত হয়।
এসব ক্ষেত্রে কথা বলার, আড্ডা দেওয়ার ও খাওয়ার জন্য সবসময়ই একটি ক্যান্টিনের ব্যবস্থা ছিল। মুখ্যত এ ছিল ইচ্ছামত আড্ডা দেওয়ার এক মুক্ত জায়গা। প্রকৃত অর্থে স্যারের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা মাফিকই এ গড়ে উঠে। বলা বাহুল্য এ ক্যান্টিনগুলোর ভেতর বাইরের সাজসজ্জা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে বরাবরই থাকত আমাদেরেই কেন্দ্রের সভ্য সুশীল কুমার সূত্রধর। এ ব্যাপারে ওর উৎসাহ ছিল প্রায় স্যারের সমান সমান। স্যারও এই ব্যাপারটিতে ওর উপর নির্ভর করতে পছন্দ করতেন। এবং এটি নিঃসন্দেহে খুবই কার্যকরী হয়ে উঠেছিল বলা যায়। অনেকেই কেন্দ্রের সভ্য না হয়েও শুধুমাত্র আড্ডা দেওয়ার জন্য এখানে আসতেন। চা-সিঙ্গারা, পায়েস-মুড়ি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে চলত নানা বিষয় নিয়ে কথা ও অফুরন্ত আড্ডা। তার মধ্যে একজনের কথা এ মূহুর্তে খুব মনে পড়ছে সে হল অকাল প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ। তাকে বহুদিন এমন আড্ডার শিরোমণি হয়ে উঠতে দেখেছি।
কেন্দ্রে শুধু যে আমরা বই পড়েছি তা নয়। আমার এখনও মনে পড়ে কেন্দ্রের শুরুতে আমরা একটি নাটক মঞ্চস্থ করেছিলাম তখনকার ধানমন্ডি দুই নম্বর রোডে অবস্থিত জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। নাটকটি ছিল সায়ীদ স্যারের লেখা একটি দীর্ঘ কবিতা “শৃঙ্খলিত প্রমিথিউস” এর সরাসরি নাট্যরূপ।
এ প্রসঙ্গে গ্রীক পুরাণের এ কাহিনীর নায়ক প্রমিথিউস সম্পর্কে সাধারণ পাঠক-শ্রোতাদের একটু ধারনা দেই। প্রমিথিউস শব্দের অর্থ অনেকটা ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার মত। যে ভবিষ্যতে কি হতে পারে বা ঘটতে পারে যেনে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয় বা কাজ করে। গ্রীক মিথলজি অনুযায়ী স্বর্গের অধিকার নেওয়ার জন্য অলিম্পিয়ান দেবতাদের সর্বোচ্চ ও শ্রেষ্ঠ দেবতা জিউস এর নেতৃত্বাধীন দলের সাথে টাইটানদের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধ চলে প্রায় দশ বছর। এই যুদ্ধে প্রমিথিউস এর কথা শুনে কৌশল গ্রহণ না করায় টাইটানরা পরাজিত হয়। ফলে প্রমিথিউস দল ত্যাগ করে বিজয়ী জিউস এর দলে চলে যায়। আর এই সেই প্রমিথিউস যে পরবর্তীতে দেবতাদের গৃহ থেকে আগুন চুরি করে মানুষকে দিয়ে দেয় যা মানুষের জীবন ও সভ্যতাকে ক্রমাগত সামনে এগিয়ে দেয়। জিউস এতে ভীষণ ক্রুদ্ধ ও ক্ষিপ্ত হয়ে তার জন্য এক মর্মান্তিক শাস্তির ব্যবস্থা করে। সে শাস্তি হল, পাহাড়ের চুড়ার একটি পাথর খণ্ডে তার সম্পূর্ণ দেহ আষ্টেপৃষ্ঠে শিকলে বাঁধা থাকবে। প্রতিদিন একটি ঈগল এসে ঠুকরে ঠুকরে তার দেহ ছিন্ন করে হৃৎপিণ্ড খেয়ে চলে যাবে। রাতে এটি আবার পূর্ণ হবে। পরদিন আবার ঈগল এসে ঐ একই কাজ করবে। এবং এ ভাবেই চলতে থাকবে অনন্ত কাল। স্যারের কবিতায় বর্ণিত এ গল্পটিরই সম্প্রসারিত রূপের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন খ্যাতনামা নাট্যকার আতাউর রহমান। এতে অভিনয় করেছিল কেন্দ্রের সদস্যরাই। দিক নির্দেশনা ও অভিনয় মিলিয়ে এটি ছিল কেন্দ্রের এক সফল প্রযোজনা।
পরবর্তীতে কেন্দ্রের সভ্যদের নিয়ে পিকনিক সহ ইতিহাস সমৃদ্ধ নানা জায়গা ভ্রমণের কার্যক্রমও হাতে নেওয়া হয়েছিল। মনে আছে কেন্দ্রের সবাই মিলে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যায় এক আনন্দদায়ক নৌ ভ্রমণের কথা। কেন্দ্রের প্রতিটি অনুষ্ঠান সবসময়ই অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কারণ স্যারের মত একজন দক্ষ ও কুশলী সংগঠক খুব কম আছেন বলেই আমার ধারনা। প্রতিটি কাজের পরিকল্পনা থেকে তা অনুষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত স্যার ভীষণ ভাবে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। খুঁটিনাটি নিজে থেকে দেখতেন ও সমাধা না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি পেতেন না। ফলে প্রতিটা কাজ খুব সুচারু রূপেই সমাধা হত।
মনে পড়ে, যথেষ্ট ঘটা করে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক বার্ষিকী উদযাপন করা হয় তখনকার ইন্দিরা রোডের ভবনে। এখানে সমাজের জ্ঞানী গুণী জন সহ দেশের উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক নেতারাও তাতে অংশ নিয়েছিলেন। এ অনুষ্ঠানের একটি বিষয় তখন সবার খুব মনোযোগ কেড়েছিল। তা হল সবাইকে আমন্ত্রণ জানানোর যে কথাটি কেন্দ্র প্রচার করেছিল। অনেকটা এরকম, “প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে কেন্দ্র খোলা থাকবে সকাল ন’টা থেকে রাত দশটা। আপনারা সবাই আমন্ত্রিত। যখন খুশি আসেন, যতবার খুশি আসেন।” এখন যখন বাংলাদেশের সব পত্রিকা ও টিভি সেন্টারের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে হুবহু এই কথাটা দেখি তখন ভাবতে ভাল লাগে যে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে স্যারের উদ্ভাবিত এ আমন্ত্রণ পত্রটিই পরবর্তীতে সবাই সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছেন।
কেন্দ্র তার পাঠ্যসূচি ও নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সন্তর্পণে যে কাজটি করেছে তা হল সবার ভেতরে এক ধরনের রুচি-বোধ তৈরি করে দেওয়া। যা সুন্দর, ভারসাম্যপূর্ণ ও যৌক্তিক। কেন্দ্রের ভেতর দিয়ে বেড়িয়ে যাওয়া প্রতিটি মানুষ তাই তাদের পরবর্তী জীবনে নানান জায়গায় রেখেছেন তাদের রুচি ও প্রতিভার স্বাক্ষর।
যারা কেন্দ্রের শুরুতে বা বলা যায় কেন্দ্রের শুরুর দু-তিন মাসের মধ্যে এসেছেন এমন অনেকের সঙ্গেই পরবর্তীতে দেখা ও কথা হয়েছে। এখনও যোগাযোগ আছে প্রথম দিনের সেইসব কিছু মানুষের সাথে। সবাই তাদের সেসব দিনের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায় খুবই নস্টালজিক হয়ে উঠেন। নানা অভিমতের পাশাপাশি তারা সবাই কেন্দ্রের কাছে এইটুকু আশা করেন বা করছেন যা আমার মতে মোটেও বেশী কিছু নয় তা হল কেন্দ্রের একেবারে শুরুতে যারা ছিলেন যাদেরও শ্রম-ঘাম মিশে আছে কেন্দ্রের সাথে তাদের নাম সহ কেন্দ্রের একটি কর্নারের নামকরণ করা হোক। বলা যায় এটি হতে পারে অনেকটা একটি অনার বোর্ডের মত যাতে লেখা থাকবে এ কেন্দ্রের শুরুর মানুষগুলোর নাম।
মনে রাখতে হবে যে কেন্দ্রের চিন্তা-পরিকল্পনা-বাস্তবায়নের উৎস এককভাবে সায়ীদ স্যারের এতে কখনই কোন দ্বিমত নেই। কেন্দ্র তারই মেধা-শ্রম-ঘামের ফসল। দিনের পর দিন যে ভাবে স্যার কেন্দ্রের গড়ে ওঠার অর্থের সংস্থানে নেশাগ্রস্থ হয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন তা আমরা যারা স্যারকে কাছ থেকে তখন দেখেছি তা এক কথায় অভূতপূর্ব। অমানুষিক ছিল তার সেই পরিশ্রম। তবে তার পাশাপাশি এটাও ভাবতে হবে যে একেবারে শুরুতে যাদের অবারিত আগ্রহ, অসম্ভব ধৈর্য ও পড়ার তীব্র নেশার ফলে তারা অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে প্রতি সপ্তাহের ছুটির দিনে ছুটে এসেছেন কেন্দ্রে ও একে প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরিয়ে তুলেছেন ও পরবর্তীতে স্যারের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সহায়তা করেছেন কেন্দ্রের অনার বোর্ডের ঐটুকু সম্মান তাদের প্রাপ্যও বটে। সবাইকে অজস্র ধন্যবাদ। (শেষ)
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া, Jsfn21@gmail.com
|