কেন “বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র”! (তৃতীয় পর্ব) রিয়াজ হক
কেন্দ্রের পাঠচক্র থেকে আমরা শিখেছে কবিতা কি? ছন্দের মিলে বা অমিলে কিছু লিখলেই কি কবিতা হয়! ভালো ও শিল্পোত্তীর্ন কবিতা কোনটা? স্যার বললেন, ছন্দের বাইরেও কবিতাকে কবিতা হয়ে উঠতে হলে তাকে কমপক্ষে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে।
এক) কবিতায় একটি কন্টেন্ট বা বিষয়বস্তু থাকতে হবে। প্রেম-বিরহ, সংগ্রাম-যুদ্ধ, প্রকৃতি ইত্যাদি ইত্যাদি।
দুই) কবিতায় কল্পনা-শক্তির (Imagination) প্রকাশ ঘটতে হবে। যেমন জীবনানন্দ দাশ যখন বলেন, “হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে......”। হাজার বছর ধরে হাঁটার অর্থ দীর্ঘ সময়, অন্তহীন কাল, পর্যবেক্ষণ, চেষ্টা, ক্লান্তি সব।
তিন) কবিতায় রূপকল্প থাকতে হবে। যেমন কবি জসীমুদ্দিন তার “সোজন বাদিয়ার ঘাট” কাব্য গ্রন্থে এর নায়িকা সাজুর হাতের বর্ণনা দিতে যেয়ে বলছেন, “সোনার হাতে সোনার কাঁকন কে কার অলঙ্কার”।
এর আলোকেই আমরা পড়েছি কবি জসীমুদ্দিনের “সোজন বাদিয়ার ঘাট”। আমরা পড়েছি চর্যাপদ ও মধ্যযুগের বাংলা কবিতা। আমরা পড়েছি রবীন্দ্র-নজরুল। পড়েছি বাংলা ভাষার ও বিশেষ করে বাংলাদেশের আধুনিক কালের কবিদের বাছাইকৃত সব শ্রেষ্ঠ কবিতা। পড়েছি শেক্সপিয়ার-কিটস-ওয়ার্ডসওয়ার্থ সহ অনেক কবির কবিতা।
আর উপন্যাস! জগত-সংসার, মানুষে মানুষে সম্পর্ক সংগ্রাম সাফল্য বিপর্যয় সবই এর উপাদান। তবে সার্থক উপন্যাস হতে হলেঃ
এক) শুরুতেই একটি বা দুটি বাক্যে এমন কিছুর আভাস দিতে হবে যা পাঠকের মনোযোগকে গেঁথে ফেলবে নাছোড়বান্দার মত।
দুই) ঘটনার নিপুণ বুনন দরকার। জটিল রহস্যময় গভীর এ জীবনের উন্মোচনে খুঁটিনাটি পারিপার্শ্বিকতার মোহনীয় বর্ণনা দরকার।
তিন) চরিত্র চিত্রণ তা কেন্দ্রীয় বা পার্শ্বীয় যাই হোক না কেন সবই সমান মমতা ও গভীরতা নিয়ে চিত্রিত করতে হবে।
চার) থাকতে হবে কার্যকরী কথোপকথন। ঘটনাকে যা সামনে এগিয়ে নিবে। যা প্রতিদিনের দেখা ও প্রার্থিত জীবনের ভেতর থেকে উঠে আসবে।
পাঁচ) হতে হবে ঘটনা বা গল্পের যৌক্তিক পরিণতি।
ছয়) বর্ণনা, চরিত্র অঙ্কন ও পরিবেশনা হতে হবে মৌলিক।
সাত) পড়া শেষে পাঠকের বোধ ও রুচি নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে। পাঠকের চিন্তার জগতকে করবে আলোড়িত। এর আলোকেই কেন্দ্রের পাঠ চক্রের সদস্যদের পড়ার জন্য ঠিক করা হয়েছিল নানা উপন্যাস। যেমন কৃষন চন্দরের “গাদ্দার”। বঙ্কিম চন্দ্রের “কপালকুণ্ডলা”। তারাশঙ্করের “কবি”। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “দিবারাত্রির কাব্য” ও “পুতুল নাচের ইতিকথা”। রবীন্দ্রনাথের,”চতুরঙ্গ”, “গোরা”, “শেষের কবিতা”, অস্কার ওয়াইল্ডের “রিজোরেকশন” বা “পুনর্জন্ম”, সফোক্লিসের ঈডিপাস, ম্যাক্সিম গোর্কির “মা”, ফ্লবেয়ারের “মাদাম বোভারি”, টলস্টয়ের “ওয়ার এন্ড পিস, হোমারের মহাকাব্য “ইলিয়াড” প্রভৃতি। প্রতি সপ্তাহে একটি করে নতুন বই পড়ে ও তার আলোচনায় তুমুল মেতে উঠার মধ্য দিয়ে কেটেছে আমাদের কেন্দ্রের জীবন।
বইয়ের বাইরে আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল “অতিথি বক্তৃতা”। প্রতি সপ্তাহের প্রতি ক্লাসের প্রথম অর্ধে বই নিয়ে আলোচনা, মাঝখানে খাবার বিরতি দিয়ে দ্বিতীয় অর্ধে ছিল এই অতিথি বক্তৃতা। এতে আমরা নানা পেশার নানা জ্ঞানী গুণী জনকে পেয়েছিলাম।
“প্রেমাংশুর রক্ত চাই” এর কবি নির্মলেন্দু গুন, “জন্মান্ধ কবিতা গুচ্ছ” ও “সত্যের মত বদমাশ” গল্পের লেখক-কবি- প্রাবন্ধিক আব্দুল মান্নান সৈয়দ, “তবক দেয়া পান” এর কবি আসাদ চৌধুরী, “কালো ইলিশ” উপন্যাসের লেখক ঔপন্যাসিক বশীর আল হেলাল, শিল্পী শফিকুল ইসলাম, লেখক ফরহাদ মযহার, শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, লেখক-শিক্ষক ঢকা বিশ্ববিদ্যালয়ের “নারী” গ্রন্থের প্রখ্যাত লেখক ডক্টর হুমায়ূন আজাদ, বাংলা বিভাগের ডক্টর আহমেদ শরীফ, লেখক চিন্তাবিদ জনাব আবুল কাশেম ফজলুল হক, শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর, কবি কাশীনাথ রায়, শিক্ষা-প্রেমী খালেদা হাবিব, বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, মঞ্জুর-এ-মওলা, সিঙ্গারের জনাব মাহবুব জামিল, নজরুল বিশেষজ্ঞ জনাব কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী, অভিনেতা গোলাম মুস্তাফা, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর হেদায়েতুল ইসলাম ও আইনজ্ঞ জনাব গাজী শামসুর রহমান সহ আরো অনেক কীর্তিমান মানুষ।
অনেক কাছ থেকে এসব গুণীজনদের দেখা, তাদের জীবনের মূল্যবান অভিজ্ঞতা শোনা ও আলোচনায় অংশ নেওয়া আমাদের ঐ সময়ের তরুণ বয়সের ছেলেমেয়েদের জন্য ছিল এক বিশাল প্রাপ্তি।
আমার যতদূর মনে পড়ে কেন্দ্রের শুরুতে স্যার গৌতম বুদ্ধের “নিজেই নিজের প্রদীপ হও” এ বানীটিকে সামনে রেখেছিলেন। পরে এরই সার্থক রূপে আসে স্যারের “আলোকিত মানুষ চাই” নামের কেন্দ্রের স্লোগানটি।
শুরুতে কেন্দ্র আজকের মত বিশাল একটি প্রতিষ্ঠান হবে এমন ধারনা আমরা খুব কমই অনুমান করতে পেরেছিলাম। এ প্রসঙ্গে আমার একদিনের এক আলাপচারিতার কথা মনে পড়ে। এ আলাপের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল তখনকার কেন্দ্রের এক সদস্য ইনামুল হক চৌধুরী। অত্যন্ত মেধাবী ও প্রতিভাবান আমাদের এই বন্ধুটি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশনের ছাত্র ছিল। প্রাসঙ্গিক হবে এটা বললে যে ওর বাবা সে সময়ের বাংলাদেশ টিভির একজন নামকরা নাট্যকার-প্রযোজক, শ্রদ্ধেয় জনাব আতিকুল হক চৌধুরী। যার নাটক “বাবার কলম কোথায়”, “দূরবীন দিয়ে দেখুন” বা “সুখের উপমা” প্রভৃতি আমাদের সমাজ ও মানুষকে তুলে ধরা ও প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে ছিল অভূতপূর্ব যা আজও আমাদের ভাবায়। একদিন সে স্যারকে বলেছিল যে কেন আমরা এ পাঠ চক্রটিকে একটি প্রতিষ্ঠানের রূপ দেই না। স্যার তখন ওর কথায় এই বলে মন্তব্য করেছিলেন যে বড় প্রতিষ্ঠান হলে তাতে বুরোক্রেসি ঢুকে, নিয়ম কানুনের বেড়াজালে তা সবার বা সাধারণের বিকাশের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। পরে অবশ্য স্যার এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে তার সমস্ত মেধা ও শ্রমকে বিনিয়োগ করেন।
কেন্দ্রের বা পাঠ চক্রের শুরুতে লাইব্রেরী গড়ার চিন্তাটা মাথায় আসেনি। সেজন্য প্রতি সপ্তাহের বইগুলো আলোচনা শেষের পর কেন্দ্রের সদস্যদের মধ্যেই অর্ধেক দামে বিক্রি করে দেওয়া হত। এ চলেছিল বেশ কিছু সময়। আমি নিজে সেই সময় বেশ কিছু বই এভাবে অর্থাৎ অর্ধেক দামে কিনে নিয়েছিলাম। আমাদের সাহিত্যের “আলোচনা-আড্ডা” প্রথম শুরু হয় ঢাকার এডুকেশন এক্সটেনশন সেন্টারে, যা গভঃ ল্যাবরেটরি স্কুলের একেবারে পাশেই। সেখান থেকে এক পর্যায়ে ঢাকা কলেজের উত্তর পার্শ্বের দূর-শিক্ষণ কলেজে ও কিছুদিন পর আবার তা নিউ মার্কেটের মিরপুর রোডের পাশের ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে চলে আসে। আসলে তখনও তো আজকের কেন্দ্র গড়ে উঠেনি! মূলত তখন আমরা নিজেরাই স্থানান্তরিত হয়েছি। মানে স্যারের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গেছি আমাদের ক্লাস চলার স্বার্থে। যাতে এ উদ্যোগ কোন ভাবেই স্থানাভাবে বন্ধ হয়ে না যায়। স্যার তাঁর ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমেই তখন এসব জায়গার ব্যবস্থা করেছেন। (চলবে...)
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া, Jsfn21@gmail.com
|