কেন “বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র”! (২য় পর্ব) রিয়াজ হক
| যতদূর মনে পড়ে, সেদিন অর্থাৎ কেন্দ্রের পাঠচক্র শুরুর প্রথম দিন যারা উপস্থিত ছিলেন এবার তাদের কথা বলি। রুদ্র অর্থাৎ কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (আমাদের সময়কার সবচেয়ে প্রতিভাবান কবি-‘ভালো আছি, ভালো থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখ’ তার লেখা এ গানের কথা আজ কে না জানে), কামাল চৌধুরী (কবি ও বর্তমান সরকারের সিনিয়র সেক্রেটারি) মোমেন (লেখক। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। বিমানের এককালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন), হাশিমা গুল্রুখ, সারোয়ার (অর্থনীতির ছাত্র-ঢাকার আই এফ আই সি ব্যাঙ্কের প্রধান), জুয়েল আইচ (পরিচয় দেবার কিছু নেই, তার নিজের নামই যথেষ্ট), কবি-লেখক মিলু চৌধুরী. কবি মোহন রায়হান, সুশীল কুমার সূত্রধর (সিঙ্গার বাংলাদেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা), বিশিষ্ট নাট্যকার আতাউর রহমান, সে সময়ের দৈনিক ইত্তেফাকের নামকরা সাংবাদিক আবেদ খান ও তার সহধর্মিণী সানজিদা সহ আরো অনেকেই উপস্থিত ছিলেন বলে মনে করছি। তবে স্মৃতি সতত প্রতারক। এ ক্ষেত্রেও হতে পারে। কেউ ছিলেন না তার নাম যেমন আসতে পারে আবার কেউ ছিলেন তিনি নিতান্ত অন্যায় ভাবেই বাদ পড়ে যেতে পারেন।
তখন প্রতি সপ্তাহের উপস্থিতি একটি খাতায় রেকর্ড করা হত। স্যারের নির্দেশ মত আমি তা উপস্থিত ব্যক্তি বর্গের স্বাক্ষর সহ সংরক্ষণ করতাম, ধারনা করছি খাতাটি এখনও ঢাকায় আমার মা’র বাসায় বা অন্য কারো কাছে আছে। খুঁজলে অবশ্যই পাওয়া যাবে। তা উদ্ধার হলে নিশ্চিত ভাবে প্রকৃত কতজন বা কে কে শুরুর দিন উপস্থিত ছিলেন বা এসেছিলেন তা বলতে পারব। পরবর্তীতে অর্থাৎ শুরুর এক-দুই বা দু’তিন মাসের মধ্যে এ কেন্দ্রের সাথে বহুজন সংশ্লিষ্ট হয়েছেন ও তাদের উপস্থিতির স্বাক্ষর রেখেছেন। তাদের মধ্যে লিয়াকত ভাই (নাম করা চিকিৎসক, বর্তমানে একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল), আমির আলী, স্বাপ্নিক মাহমুদ হাসান (চিকিৎসক) সহ আরো অনেকেই ছিলেন।
আমরা যখন সায়ীদ স্যারের সঙ্গে কেন্দ্রের পাঠচক্র শুরু করি তখন অনেক কিছুই ছিল আমাদের অজানা। তাই আজ একটু বিস্তৃত ভাবে বলা প্রয়োজন কিভাবে আমরা একটু একটু করে চিনেছি সাহিত্য। এ বলায় সাধারণ মানুষেরা অন্তত বুঝবেন আমাদের চলার পথের আবিষ্কারের আনন্দ।
প্রথমেই ধরা যাক গল্পের কথা। আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে ছোট গল্পের একটি সর্বজন গ্রাহ্য সংজ্ঞা পেয়েছি।
“ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা ছোট ছোট দুঃখ- কথা নিতান্তই সহজ সরল সহস্র বিস্মৃতি রাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি তারি দু’চারিটি অশ্রু জল নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা নাহি তত্ত্ব, নাহি উপদেশ অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে শেষ হইয়াও হইল না শেষ।।”
এর আলোকেই কেন্দ্রের নির্বাচিত অনেক ছোট গল্পের মধ্যে একটি গল্পের কথা আজ বলব যা রবি ঠাকুর বর্ণিত সব উপাদান কে অনুসরণ করে হয়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের এক অসাধারণ জীবন-গল্প। গল্পের নাম রস। লেখক নরেন্দ্র নাথ মিত্র।
রস গল্পের নায়ক মোতালেফ একজন গাছি। খেজুর গাছ কেটে তা থেকে হাড়ি ভরে ভরে রস নিয়ে আসে বাড়িতে। সে সুঠাম দেহের অতি দক্ষ একজন গাছি। তার এই রসকে জাল দিয়ে অপূর্ব স্বাদের গুড় তৈরি করে তার স্ত্রী মাজু খাতুন। এ গুড় তৈরির দক্ষতায় মাজু খাতুন একক ও অনন্য। শ্রম বিভাজনের ধারায় দুজনের অপরিসীম দক্ষতায় মানুষের জিহ্বায় স্বাদ আসে খেজুরের গুড়ের। এখানে একজন ছাড়া অন্যজন অচল। অর্থাৎ একজনের সাফল্য বেঁচে আছে অন্যজনের নির্ভরতায়। কোন দিক থেকেই একে খাটো করে দেখবার কোন উপায় নেই। এ একধরনের পরিপূরক ভালোবাসা। পরিপূরক কাজ।
এ বিষয়টিকেই সামনে তুলে ধরার জন্য লেখক নিয়ে আসেন পূর্ণ যৌবনা সুন্দরী ফুলবানুকে। যাকে দেখে মোতালেফ কাতর। মাজু খাতুনের বয়স হয়েছে। তাকে আর মোতালেফের মনে ধরে না। সে ঠিক করে ফেলে মাজু খাতুনকে তালাক দিয়ে বিয়ে করবে ফুলবানুকে। যদিও ফুলবানু ইতিমধ্যে আরেক স্বামীর ঘর ঘুরে এসেছে। সে মতে মোতালেফ পয়সা সঞ্চয়ে দ্বিগুণ উৎসাহ ও পরিশ্রম দিয়ে কাজ করে হাড়ি হাড়ি রস আনতে লাগল। মাজু খাতুন তো মোতালেফের গোপন পরিকল্পনা সম্পর্কে অজ্ঞাত। অন্তরের ভালোবাসা দিয়ে বিপুল উৎসাহে রস জাল দিয়ে গুড় তৈরিতে লেগে থাকে সে।
বাড়তি পয়সা হাতে পেয়েই মোতালেফ মাজু খাতুনকে তালাক দিয়ে ফুলবানুকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে আসে। কিন্তু জীবন মানে তো কেবল অসম্ভব স্বপ্ন আর অযাচিত সুখের আনন্দে ভেসে বেড়ানো নয়। জীবন মানে রুক্ষ কর্কশ নির্মম কঠিন বাস্তবতা। মোতালেফ আশা করছে ফুলবানুও মাজু খাতুনের মত তেমনি কুশলী হাতে রস জাল দিয়ে গুড় বানাবে আর সে গুড় আগের মতই মানুষের জিহ্বার স্বাদ মিটাতে হাটে বিক্রি হবে। কিন্তু তা তো হল না। তা হয় না। ফুলবানু বয়সে নবীন, অভিজ্ঞতা কম। মাজু খাতুনের রস জ্বাল দেওয়ার কৌশলও তার অজানা। ফলে গুড় বাজার হারাতে থাকল। মোতালেফ সম্পূর্ণ পথে বসল।
এদিকে মাজু খাতুনের বিয়ে হয়ে গেছে নদীর ওপারের গ্রামের এক মানুষের সাথে। নিঃস্ব রিক্ত মোতালেফ একদিন দুই হাড়ি রস নিয়ে হাজির হল সেই গ্রামে। মাজু খাতুনের নতুন বাড়িতে। মাজু খাতুনের স্বামী সৌজন্যের সাথে তাকে গ্রহণ করল। তামাক খেতে দিল। কিন্তু তার আসার খবর শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল মাজু খাতুন। কোন মুখে সে এই বাড়িতে এসেছে ঝাঁঝালো কণ্ঠে সে প্রশ্নও করল। কারণ তার বুকে তখন অভিমান-হত হৃদয়ের করুন কান্না আছড়ে পড়ছিল।
জীবনের শিক্ষা তো ইতিমধ্যে পেয়েছে মোতালেফ। এক পর্যায়ে সে করুন আর্তি জানায় মাজু খাতুনের কাছে যেন এই দুই হাড়ি রস জ্বাল দিয়ে সে গুড় বানায় আর সেই গুড় নিয়ে হাঁটে যেতে চায় মোতালেফ কারণ গত এক বছরে এক ছটাক গুড়ও সে বিক্রি করতে পারে নাই।
এ গল্প প্রেম-ভালোবাসা সহ জীবনের সুখ-দুঃখের এক মানবিক রচনা। ক্ষণিক মোহ জীবনের নিষ্ঠুরতাকে কিভাবে সামনে নিয়ে আসে তা ঘটনার বর্ণনায় ও চরিত্র চিত্রণে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছেন নরেন্দ্র নাথ মিত্র। এ গল্প রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্পের পুরো সংজ্ঞাকেই জীবন্ত করে তুলে ধরে।
এমনি ধরনের বাংলা ভাষার বাছাইকৃত শ্রেষ্ঠ গল্প আমরা পড়েছি। পড়ে তাকে নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা কথা বলেছি। বের করে এনেছি তার ভেতরের শিল্প ও সৌন্দর্য। তার ভেতরের অভাবিত শক্তি। নির্ণয় করেছি সাহিত্যের মানদণ্ডে তার অবস্থান। শরিক হয়েছি লেখকের চিন্তার শ্রেষ্ঠত্বের সাথে।
আমরা সামগ্রিক ভাবে রবীন্দ্র-নজরুলের শ্রেষ্ঠ গল্প পড়েছি। পড়েছি বনফুলের গল্প। মান্টোর গল্প। খ্যাতনামা রুশ সাহিত্যিক লিও টলস্টয় ও আন্তন চেখভের বাছাই করা গল্প। পড়েছি দেশ ও বিদেশের অসংখ্য নামী লেখকের শ্রেষ্ঠ গল্প। এত গল্প আর এত নাম তাই আর আলাদা করে বললাম না। সেসব বলতে গেলে এ অল্প পরিসরে তা কুলাবেও না। (চলবে...)
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া, Jsfn21@gmail.com
|