কেন “বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র”! (১ম পর্ব) রিয়াজ হক
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ | বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের শুরুর, ভেতরের বা পেছনের কথা বলার আগে একটি ন্যায্য প্রশ্ন কিন্তু করা চাইঃ কেন সাহিত্য? আর কেনই বা বিশ্বের সাহিত্য তথা বিশ্ব সাহিত্য?
আমরা যখন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সঙ্গে কেন্দ্র শুরু করি, তখন আমাদের বাবা-মা ও অভিভাবকরা ভাবতেন কি পাচ্ছি আমরা এসব করে? আখেরে ফায়দা কি? এসব করে উচ্ছন্নে যাচ্ছি না তো? চারিদিকে ছিল নানা জনের নানা রকম প্রশ্ন। প্রশ্নগুলো যে খুব একটা প্রীতিকর ও সস্থিদায়ক ছিল এমন বলা যাবে না।
আজ প্রায় বিয়াল্লিশ বছর পর এসব প্রশ্নের বিবেচনা যোগ্য জবাব দিতে গিয়ে আসুন বাঙলা সাহিত্যের এক অনন্য প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শরনাপন্ন হই। “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু”
-নিজের ঘরের বাইরে দরজার ওপারের দূরের ধানের শিষের উপর না হোক দরজার সামনেই সবুজ ঘাসের মাথার উপরের শিশির বিন্দুর সৌন্দর্য, বিস্ময় ও রহস্যের কিনারা করতে যেমন একটি অনুসন্ধিৎসু ভাবুক মন চাই তেমনি নিজের পৃথিবীকে চেনা ও নিজের পৃথিবীর বাইরে, বাইরের পৃথিবীর মানুষ, তাদের চিন্তা, দর্শন, সভ্যতাকে জানা ও উপলব্ধির জন্যও চাই বিশ্ব সাহিত্য বা বিশ্বের সাহিত্যের। আর এটিকে আয়ত্তে আনার জন্যই প্রয়োজন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের।
-নিজের ভেতরের বোধ ও চেতনাকে পরিশীলিত, মার্জিত ও উন্নত করার জন্য বিশ্ব সাহিত্যের মাধ্যমে ঐসব সৃষ্টিশীল লেখকদের সান্নিধ্যে আসার জন্য প্রয়োজন বিশ্ব সাহিত্যের।
-সাহিত্যের নানা ঘটনা ও চরিত্রের মধ্য দিয়ে নিজের চিন্তা ও কল্পনাকে প্রসারিত করার জন্যও প্রয়োজন বিশ্ব সাহিত্যের।
-অতীতের সংস্পর্শে এসে নিজের ও অন্যের সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে অনুধাবনের জন্য বিশ্ব সাহিত্যের প্রয়োজন।
-অপরের ধর্ম-সংস্কৃতি-আচার আচরনকে বুঝে ভিন্নতাকে হৃদয় দিয়ে ধারন করার জন্যও বিশ্ব সাহিত্যের প্রয়োজন।
-নিজেকে আলোড়িত করে মানবিক মূল্যবোধের জাগরন ঘটানোর জন্যও প্রয়োজন বিশ্ব সাহিত্যের।
এতো গেল জীবনের বড় দিক ও তার সম্ভাবনার কথা। এর পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য আরেকটি দিক হলঃ সাহিত্য কি? কিভাবে তাকে চিনব? বিশেষ করে আমরা যারা সাহিত্যের ছাত্র নই কিন্তু সাহিত্যকে ভালোবাসি তাদের জিজ্ঞাসা; সব লেখাই কি সাহিত্য? গল্প কি? কবিতা ও উপন্যাসকে বুঝব কি ভাবে? সাহিত্যের নিরিখে কি ভাবে নির্ধারন করব গল্প, কবিতা ও উপন্যাসের অবস্থান ও মান।
স্যারের কথা ছিল, এসব বোঝার জন্য সাহিত্য ও বিশেষ করে বিশ্ব সাহিত্যের ভাল ও ধ্রুপদী অর্থাৎ যাকে আমরা বলি ‘ক্লাসিক’ সে লেখাগুলো পড়তে হবে। এ যেমন ব্যক্তি হয়ে নিজের দেশ ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন নিজের দেশের সাহিত্য-সম্পদকে মূল্যায়ন করার জন্যও।
১৯৭৪-৭৫ এ আমাদের ঢাকা কলেজের সময়কাল থেকেই প্রথাগত শিক্ষা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে যারা শিল্প সাহিত্য নিয়ে ভাবেন, চর্চা করেন বা একে আরো গভীরে থেকে জানতে চান তাদের জন্য কিছু করা যায় কি না এসব নিয়ে স্যারের সঙ্গে অনেক দিন ধরেই আমাদের কথা হচ্ছিল। এর ফল স্বরূপই সাহিত্যের একটি পাঠচক্র হিসেবেই ১৯৭৮ এ বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের অনানুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ।
শুরুতে এটিকে সাহিত্যের স্বাদ অন্বেষণের একটি মিলন কেন্দ্র হিসেবেই দেখা হয়েছিল। শুরুতে যারা এখানে এসেছিলেন তারা খুব কমই ছিলেন সাহিত্যের ছাত্র। বরং উল্টোটা। প্রকৌশল, চিকিৎসা ও সমাজ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার ছেলে মেয়েরাই এখানে এসেছিলেন বেশী। যেমন আমি, কায়েস, সউদ, ইফতেখার ভাই, লোদী এরা কেউই সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম না। কিন্তু সাহিত্যের প্রতি আমাদের ভালো লাগার একটা তীব্র ঝোঁক ছিল। ছিল এক ধরনের নেশা।
আমি পুর-প্রকৌশলের ছাত্র। কায়েস (পুরো নামঃ মিজারুল কায়েস) তখন ঢকা মেডিকেল কলেজে পড়ত। পরবর্তীতে সে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র সচিব হয়েছিল। কায়েস সম্পর্কে একটু বলতে হয়। সে আজ আমদের মধ্যে নেই। তার মত এত মেধাবী, এত প্রতিভাবান ছেলে আমি আমার জীবনে খুব কম দেখেছি। যে কোন বিষয়ে তা কি সাহিত্য, কি চিত্রকলা, কি সঙ্গীত তার পড়াশুনা ও জ্ঞান ছিল অপরিসীম। একবার চিন্তা করে যদি দেখি, সেই বয়সে, তার বয়স তখন ১৯ বা ২০ সে পুরো সেক্সপিয়ার পড়ে শেষ করে ফেলেছে। আপনি সেক্সপিয়রের যে কোন রচনা নিয়েই কায়েসের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। এ ছিল অবিশ্বাস্য কিন্তু বাস্তব। এত অল্প বয়সে তার চলে যাওয়াটা আমদের পুরো দেশের জন্যই এক বিরাট ক্ষতি বৈ আর কিছু নয়।
সউদ (পুরো নামঃ মুজতবা সুউদ) চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিল। সাহিত্যের ভেতরের রস কে খুঁজে বের করতে ওর জুড়ি মেলা ভার ছিল। এখনও সে চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার সাথেই আছে। চলচ্চিত্রের একটি শাখায় সে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছে।
ইফতেখার ভাই (পুরো নামঃ ইফতেখারুল ইসলাম) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসীর ছাত্র ছিলেন। শিল্প সাহিত্যের আরেক সমঝদার। পড়াশুনা ছিল প্রচুর। কথা বলতেন চোখে মুখে। বর্তমানে দেশে একটি নামকরা ফার্মাসিউটিক্যালস এর প্রধান কর্তা ব্যক্তি।
লোদী (পুরো নামঃ সফিউজ্জামান খান লোদী) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশনের ছাত্র। চ্যানেল আই এর ‘আমার ছবি’র কল্যানে ওকে চিনবে না এমন মানুষের সংখ্যা কম। তখন সাহিত্যের চেয়ে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন নিয়ে ও মেতে ছিল বেশী। কিন্তু সাহিত্যে ওর আকর্ষণের জায়গা ছিল ঘটনার নাটকীয়তা। ফলে সাহিত্যের ক্লাসে ঘটনা বিশ্লেষণে সে ছিল অতুলনীয়।
স্যারের পরিচিত, বন্ধু ও অত্যন্ত কাছের মানুষ বাংলাদেশ বেতারের এক সময়ের মহাপরিচালক জনাব আশরাফুজ্জামানের দেয়া পঁয়ত্রিশ টাকা দিয়ে কেনা কৃষণ চন্দরের গাদ্দার দিয়ে শুরু আমাদের কেন্দ্রের প্রথম ক্লাস বা মুক্ত আলোচনা। এ প্রসঙ্গে জনাব আশরাফুজ্জামান সম্পর্কে একটু বলতে হয়। ইনি হচ্ছেন সেই আশরাফুজ্জামান যিনি ১৯৭০-৭১ এর উত্তাল গন আন্দোলনের সময় তৎকালীন রেডিওর মহাপরিচালক ছিলেন। যিনি সেই সময়ের পাকিস্তানী সামরিক জান্তার চোখ রাঙ্গানীকে উপেক্ষা করে বঙ্গন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ তার পরদিন প্রচার করেন। কারন ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারনে সে বক্তৃতা ৭ই মার্চের দিন সরাসরি সম্প্রচার করা সম্ভব হয়নি। অবশ্যই এ কাজে তিনি সে সময় বেতার কেন্দ্রের প্রায় সমস্ত বেতার কর্মীদের সহায়তা পেয়েছিলেন।
যে কথা বলছিলাম, গাদ্দার বইটি এক্ সপ্তাহ আগেই আমাদের দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমরা তা পড়ে পরবর্তী সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মিলিত হয়েছিলাম ঢাকার তৎকালীন এডুকেশন এক্সটেনশন সেন্টারে – যা ছিল গভঃ ল্যাবরেটরি স্কুলের পাশে। এ বই নিয়ে সেদিন আমরা মেতে উঠেছিলাম তর্কে বিতর্কে।
মানুষের জীবন, এর সৃষ্টি-ধ্বংস, জয়-পরাজয়, ক্রোধ-হিংসা-বিদ্বেষ ও সেই সাথে প্রেম ভালোবাসা সহ মানবিক মূল্য বোধের এক অমূল্য দলিল এই গাদ্দার উপন্যাসটি। ৪৭ এর ভারত উপমহাদেশ ভাগের উপর এটি লেখা।
সেদিনের সেই আলোচনা আমাদের এতটাই মুগ্ধ-বিস্মিত ও আবেগ আপ্লূত করেছিল যে আমরা পরবর্তী সপ্তাহে আবার আরেকটি বইয়ের উপর আলোচনার জন্য সত্যি অর্থেই উন্মুখ হয়ে উঠেছিলাম। (চলবে...)
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া, Jsfn21@gmail.com
|