বিহারী রিয়াজ হক
রংপুর আমার দ্বিতীয় আবাস স্থল। ঢাকা, প্রথম। রংপুর দ্বিতীয় আবাস স্থল হল বিয়ের কল্যাণে। এ যাবৎ রংপুরে যাওয়া হয়েছে অসংখ্যবার। ৯০ এর পর থেকে হিসেব করলে দুহাতের আঙ্গুলে তা কুলাবে বলে মনে হয় না। রংপুর আমাকে টানত মূলত এর নিরিবিলি ভাব ভঙ্গির জন্য। মৃদু মন্থর জীবন, রিকশার টুং টাং শব্দ ও মানুষের আপাত সরলতা। আমার গন্তব্য রংপুর শহরের আলম নগরের রবাটসন্স গঞ্জের ‘মায়া ভিলা’। রংপুর রেল স্টেশনে নেমে রিকশায় চেপে দু’টাকা ভাড়ায় পৌঁছে যাওয়া যায় মায়া ভিলায়। চারপাশের আম-লিচু-কলা-কাঁঠাল-সুপারির ছায়ার-মায়ায় পল্লবিত সবুজের মাঝখানে চল্লিশ বা পঞ্চাশের দশকে বার বিঘার উপর নির্মিত দালান বাড়ি এই মায়া ভিলা। হতে পারে এ আরো পুরনো।
মায়া ভিলার সামনের প্রাচীর ঘিরেই একসময় গড়ে উঠেছিল কিছু ক্ষৌরকর্মের দোকান। এখানেই আমার পরিচয় ও কথা হয় এরফানের সাথে। এটা ৯১ সালের কথা। একদিন সকাল বেলায় আমি শেভ করব বলে গেট থেকে বের হয়ে ডান পাশের সারিবদ্ধ দোকানগুলোর দিকে তাকাতেই একটি সুদর্শন যুবক অম্লান হেসে বলল, “আসেন সাব। ফার্স্ট ক্লাস শেভ।“ ওর স্বাগত জানানোর ভঙ্গী আমাকে আকৃষ্ট করল। এ দোকানের বাইরে এরফানকে দেখলে যে কেউ ভাবতে পারে ও কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা নাটক-সিনেমার প্রতিভাবান একজন অভিনেতা। ওর ঋজু দীর্ঘ শরীর ও মায়াবী চোখ ও চিবুক অনেক তরুণীর হৃদয়েও উথাল-পাতাল আলোড়ন তুলতে পারে এতে আমার অন্তত কোন সন্দেহ নেই।
এরফানের পূর্ব পুরুষ বিহার থেকে আগত। সে অর্থে ওরা বিহারী। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় ওরা পাকিস্তানের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অংশ, বর্তমানের বাংলাদেশের পার্বতীপুরে এসে জায়গা নেয়। কিন্তু এরফানের জন্ম ৭১এ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। সে অর্থে, জন্মসূত্রে ও বাংলাদেশী। এরফান ওর বাবাকে কোনদিনও দেখেনি। জানেনা ওর বাবার মৃত্যু ঘটেছে নাকি নিখোঁজ। অথবা জানলেও আমাকে তা বলতে চায়নি। ও শুধু এইটুকু বলল যে ৭১এর মুক্তিযুদ্ধের সময় ওরা ছিল পার্বতীপুরে। মায়ের মুখ থেকে শুনেছে ওর বাবা রেলের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিল। যুদ্ধ শেষ হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ও ওর বড় দু’বোন ও মা সহ রিফিউজি হিসেবে রংপুর শহরের রবাটসন্স গঞ্জের রেডক্রস ক্যাম্পে এসে আশ্রয় নেয়। ওর মা’র মুখ থেকে শুনেছে, একসময় ওদের সরকারী বাংলো বাড়ি ছিল। মালী-দারোয়ান-ড্রাইভার সহ সাতজন কাজের লোক ছিল। বাড়ির সামনে ছিল হরেক রকম ফুলের বিশাল বাগান। বাড়ির পেছনে আম-জাম-লিচু-কাঁঠালের গাছ। কিন্তু ৭১এর মুক্তিযুদ্ধ ওদের জীবনকে উলট-পালট করে দিয়ে গিয়েছে।
ওর বড় দু’বোন স্থানীয় স্কুলে এইট-নাইন পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে। এরপর ওদের বিয়ে হয়ে গেছে। এপথ-সেপথ করে ওরা এখন পাকিস্তানে। কিন্তু নানা চেষ্টা করেও ওদের আর যাওয়া হয়নি। কারণ এভাবে যাওয়ার খরচ ওদের পক্ষে যোগার করা সম্ভব হয়নি। এমন কি সংসারের হাল ধরতে পঞ্চম শ্রেণীর পর ওর আর পড়াশুনা করা হয়নি। একসময় ও ষ্টেশনে মোট বইত। তারপর ফেরি করে বাদাম বিক্রি করেছে বহু দিন। এরপর স্থির হয়ে জীবন চালাতে বেঁছে নিয়েছে ক্ষৌরকর্ম। সন্ধ্যায় মা’র হাতে আটা আর গুড় দিয়ে বানানো গুল্গুলিয়া পিঠা নিয়ে বসে শহরের ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে। যা আয় হয়, ভালোই চলে যায় দু’জনের। আমি বললাম, সে কি জানে যে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের কিছু সংখ্যক বিহারী স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে মিলে স্বাধীনতাকামী বাঙ্গালীদের উপর নির্বিচার লুটপাট ও নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। আমার কথায় সে চমকে তাকিয়ে বিন্দুবৎ স্থির হয়ে গেল। তার মুখমণ্ডল রক্তিম হয়ে উঠল। কপালে দেখতে পেলাম সূক্ষ্ম ঘামের রেখা। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর নীরবতা ভেঙে শুধু বলল, সে শুনেছে। বলে চোখ নত করে ফেলল। আরো কিছু টুকটাক কথাবার্তার পর আমার শেভিং হয়ে গেলে, চলে আসার আগে আমি জানতে চাইলাম, কেমন আছে ওরা এখন বা কেমন লাগে ওর এই বাংলাদেশের রংপুর। ও তখন আবারও বেশ কতক্ষণ নীরব থেকে উদাস ভঙ্গীতে বাইরে, বিপুল বিস্তৃত আকাশের দিকে তাকিয়ে বললঃ
“কিৎনা খউফ হোতা হ্যায় শাম কি আন্ধেরা মে/ পুছো ও পারিন্দা সে জিনকে ঘর নাহি হোতে”
অর্থাৎ, অন্ধকারে একজন কতটা ভীত হয় তা জানতে একটি পাখি কে জিজ্ঞাসা কর যার নিজের কোন বাড়ি নেই।
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া, Jsfn21@gmail.com
|