বাড়ী নিয়ে মাথায় বাড়ি রিয়াজ হক
“এ বাড়ী আমি কিনতে চাইনি। তখনই বলেছিলাম রান্না ঘরটা ভেতরের দিকে, লিভিং রুমের সঙ্গে লাগানো, নাই কোন জানালা, নাই কোন ডাক্টেড কিচেন এক্সজস্ট, কিন্তু কে শোনে আমার কথা”। কিচেন থেকে ছড়িয়ে পড়া ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ঘরে কাশতে কাশতে তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলে তাহমিনা।
কিছু কথা শফিকের কানে ঢুকে, কিছু অস্পষ্ট হয়ে বাতাসে খেলতে থাকে। কারণ শফিকের মনোযোগ অন্যত্র। আজ সকাল থেকেই সে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কফি টেবিলের চারটা পায়ের স্ক্রু টাইট দেবার জন্য। দু’বছর আগে স্যালভো থেকে কেনা এই কফি টেবিলটা ইদানীং বুড়ো মানুষের হাতের লাঠির মত ঠক ঠক করে কাঁপতে শুরু করেছে।
২০০৮ সালের কথা, বাংলাদেশ থেকে মাইগ্রেশন নিয়ে আসার আট বছরের মাথায় তাদের এই বাড়ীটি কেনা। যেখানে আজ তারা আছে, যা নিয়ে কমপ্লেইন করছে তাহমিনা। এই বাড়ী কিনতে যেয়ে কম ঝামেলা তাদের পোহাতে হয়নি। কষ্ট ও পেরেশানিও হয়নি কম।
তখন একটি ওল্ড হোমস এর কিচেনে সপ্তাহে দু’দিনের ক্যাজুয়েল কাজ করত তাহমিনা। বাকী তিন দিন তার মাস্টার্সের ক্লাস। শফিক তখন একটি গ্রোসারী চেইন শপে নাইট ফিলারের জব করছিল। শফিকের জবের একটি ভাল দিক ছিল এই যে কাজটি ছিল পার্মানেন্ট। সপ্তাহে চার থেকে পাঁচ দিন। মাঝে মাঝেই ওভারটাইম। কষ্ট করে এক বেড রুমের এপার্টমেন্টে থেকে কিছু পয়সা জমিয়ে তা নিয়েই মাঠে নেমে পড়েছিল বাড়ী কিনতে। চারদিকে ওদের বাড়ী কেনার খবর সিডনীর বাঙ্গালি কমিউনিটির কান থেকে কানে পৌঁছে যেতে সময় লেগেছে প্লাটফর্ম থেকে ট্রেনের দরোজা পর্যন্ত পা ফেলা মাত্র। ব্যস।
তখন আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবেরা যেচে বা না যেচে মোটা দাগে যেসব আদেশ-উপদেশ বা পরামর্শ দিয়েছিল তা ছিল এরকমঃ
(এক) লোনের বিশ পার্সেন্ট পর্যন্ত ডিপোজিট দিতে পারবে, এমন প্রস্তুতি নিয়ে বাড়ী কিনবে।
(দুই) কমন ওয়েলথ ব্যাংক, ওয়েস্ট প্যাক, এ.এন.যেড এসব বড় ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লোন নিবে। এদেশে ঋণ দেবার অসংখ্য প্রতিষ্ঠান আছে, বলবে, আস, লোন নাও; দশ পার্সেন্ট বা পাঁচ পার্সেন্ট ডিপোজিট দিলেই চলবে। ওখানে যাবে না। কখনো প্রতিষ্ঠান বা দেশের অর্থনীতির অবস্থা খারাপ হলে বিপদে পড়বে। (অবশ্য বিপদটা কি হতে পারে এ কথা কেউ কখনো ব্যাখ্যা করেনি )।
(তিন) ভাল সাবার্ব দেখে বাড়ী কিনবে। নর্থ-ওয়েস্টের দিকে হলেই ভাল। বিশেষ করে ঐসব সাবার্বের দিকে যাবে না যেখানে গভঃ হাউসিং আছে ও ড্রাগ এডিক্টদের বাস। (ড্রাগ-এডিক্টদের কিভাবে চেনা যাবে এটাও কেউ বলে দেয় নি)।
(চার)বাড়ি থেকে অল্প দূরত্বের মধ্যে ট্রেন-বাস তথা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট আছে কিনা দেখবে। এটা খুব ইম্পর্টেন্ট। কারণ তোমাকে কাজে-বাজারে বাইরে যেতেই হবে। সবসময় নিজের গাড়ির উপর ভরসা করা ঠিক নয়।
(পাঁচ) ছেলেপেলের স্কুল আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোন স্কুলে তারা যাবে, কাদের সঙ্গে তারা বড় হয়ে উঠবে, কারা ভবিষ্যতে তাদের বন্ধু হবে এ বিষয়টির দিকে লক্ষ্য রেখে বাড়ী কিনতে হবে।
(ছয়) বাড়ী তোমার কাজের জায়গার কাছাকাছি হলেই ভাল। এতে যাতায়াতের খরচ কম হবে। তুমি কিছু পয়সা সেভ করতে পারবে। My dear, here every dollar counts.
এসব ‘অবশ্য বিবেচনার যোগ্য’ বিষয়গুলো মাথায় নিয়ে বাড়ী দেখা শুরু করে তাহমিনা ও শফিক। রোববার দিনটা বাজার-রান্না-কাপড় ধোয়ার জন্য রেখে শনিবার সকাল সকাল নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়ত বাড়ী দেখতে। হাতে নিজেদের তৈরি করা এক্সেল শিটের সাথে সময় ও ঠিকানা মিলিয়ে এ সাবার্ব, সে সাবার্ব, এ বাড়ী, সে বাড়ী করে ক্লান্ত হয়ে দুপুরের পর রুটিন মাফিক বাসায় ফিরত। কখনো সাবার্ব পছন্দ হলেও বাড়ী পছন্দ হয়না, বাড়ী হলেও সাবার্ব হয়না। স্কুল পছন্দ হলেও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ও বাজার পড়ে যায় দূরে। আবার অন্যগুলো কাছাকাছি হলেও স্কুল চলে যায় হাটা দূরত্বের বাইরে। মাত্র নতুন প্রাইমারী স্কুল শুরু করা দুটো সন্তানের শিক্ষা ও জীবন গঠনই যেন তখন প্রধান মুখ্য বিষয় হয়ে উঠে।
এভাবে ছ’মাস কাটার পর বাড়ী কেনার অপারগতায় দু’জনের মধ্যেই নেমে আসে রাজ্যের হতাশা। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এভাবেঃ
(এক) আমাদের আর এই ইহজনমে বাড়ী কেনা হবে না- তাহমিনা
(দুই) এত দিক দেখতে গেলে কি আর বাড়ী কেনা যায় – শফিক
(তিন) ওমুক ভাই, তমুক ভাইরা ঠিকই পারে, কেবল আমরাই পারি না- তাহমিনা
(চার) আমি একা হলে এতদিনে ত্বরিত ডিসিশন নিয়ে ঠিকই কিনে ফেলতাম- শফিক
এই যখন পরিস্থিতি তখন শফিক-তাহমিনার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড় ভাই বললেন, তোমরা নর্থের দিকের এক সাবার্বের জনাব মাহমুদ সাহেবের সঙ্গে দেখা কর। উনার পরামর্শ নাও। উনি শূন্য (!) থেকে শুরু করে সিডনীতে আজ আট-দশটি বাড়ির মালিক। উনার পরামর্শ আমার কাজে লেগেছিল, তোমাদেরও লাগবে বলে আশা করি। সেই মতে এক রবিবারে এপয়ন্টমেন্ট করে শফিক-তাহমিনা জনাব মাহমুদের দ্বারস্থ হলো।
ঘণ্টা দুয়েক ধরে তিনি যা বললেন, সোজাসুজি বিবেচনা করলে তা হলঃ
(এক) সামর্থ্য (অর্থাৎ নিজের জমানো টাকার পরিমাণ), সাবার্ব, বাড়ির ধরন (ইউনিট/টাউন হাউস/ইন্ডিপেন্ডেন্ট হাউস), স্পেস (জায়গার পরিমাণ), বেড রুম-টয়লেট (দুই/তিন/চার)এগুলো ঠিক করে কাগজে লিখে দু’জন (স্বামী-স্ত্রী) এগ্রি করে, মানে সহমত হয়ে তারপর বাড়ি দেখতে বের হবে।
(দুই) বাড়ী দেখার আগেই ব্যাংকের বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে লোন স্যাংশন করাতে হবে।
(তিন) একজন কনভেয়েন্সার বা ল’ইয়ার ঠিক করে রাখতে হবে।
(চার) লিগ্যাল ফিস, ষ্ট্যাম্প ডিউটি চার্জ, লোন এপ্লিকেশন কস্ট, মর্টগেজ ইনডেমনিটি ইনস্যুরেন্স প্রভৃতির কথা মাথায় রাখতে হবে।
(পাঁচ) শুধু ঋণের সুদ পরিশোধ না করে এক্সট্রা টাকা পে করতে হবে যাতে করে প্রিন্সিপ্যাল লোন এমাউন্ট কমে আসে। সাথে রিড্র ফ্যাসিলিটি থাকলে খুবই ভাল।
(ছয়) এবার বাড়ীঃ (১) ফাইব্রো-ব্রিক-টিম্বার-জীপ্রক কোনটা? (২) ইট-ইন-কিচেন অথবা আলাদা ডাইনিং কোনটা? (৩) ওয়াক-ইন-ওয়ারড্রব/অনসুট/প্যান্ট্রি/পারগোলা এনি প্রেফারেন্স? (৪) ফ্লোর কাভারিং- টাইল, কার্পেট? (৫) দরজা-জানালা দিয়ে আলো বাতাসের প্রবাহ কেমন? (৬) প্রতিবেশী কারা-কেমন? (৭) বাড়ির পাশের রাস্তা কোলাহল পূর্ণ না নীরব? (৮) বাড়ির বয়স কত? কোন রেনোভেশন দরকার? (৯) ঐ একই সাবার্বে ঐ একই ধরনের প্রপার্টির দাম কত? (১০) বাড়ীর ইতিহাস (বিক্রি/মেরামত/অপরাধ সংক্রান্ত)
এসব শুনে, মগজে ঢুকাতে ঢুকাতে বেশ খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে শফিক ও তাহমিনা। তাই গুনে গুনে ঠিক তেরো দিনের মাথায় অনেকটা ডেস্পারেট হয়েই একটি বাড়ী কিনে ফেলে ওয়ালী পার্কে।
তাহমিনা কিছুটা নিমরাজি থাকলেও শফিকের চাপাচাপিতে ও বাস্তবতা বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত একটা বাড়ী কেনা হচ্ছে এই লুকানো খুশীতে একরকম চুপ করে থাকে। ভাবটা এমন, “তোমার যা খুশী কর। ভাল হলে ভাল, না হলে তখন ধরব”।
২০০৮ এ এই বাড়ীতে উঠে গেলে শুরুতে মোটামুটি ভালই চলছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনের বসবাসে, অন্যদের বাড়ী-ঘরের সাথে তুলনায় এখন তাহমিনা যা ভাবছে বা যা তার কথায় উঠে আসছে তা হলঃ
(এক) তিন বেড রুমের এই বাড়ীতে একটা কোন গেস্ট রুম নেই যে আত্মীয় স্বজন কেউ এলে থাকতে দিতে পারি। হায় কপাল !
(দুই) চার জনের মানুষের জন্য একটি মাত্র টয়লেট। এ কল্পনার অতীত। অসহ্য।
(তিন) দুটি বেড রুমের সাইজ এত ছোট যে খাট ফেললে পড়ার টেবিল নিয়ে কসরত করতে হয়।
(চার) শীতের সময় এত ঠাণ্ডা যে বরফে জমে যাওয়ার সামিল। সাইবেরিয়ার বাড়িও বোধ হয় এর চেয়ে গরম। আর গরম কালে হাবিয়া দোজখ!
(পাঁচ) এমন আজগুবি প্ল্যান আর দেখি নাই যে রান্নাঘর বাড়ীর ভেতরে, নাই কোন জানালা-যা আগেই উল্লেখ করেছি।
কাজেই সব কথার শেষ কথা এ বাড়ী বদলাতে হবে। অর্থাৎ এ বাড়ী বিক্রি করে আরেকটি নতুন বাড়ী কিনতে হবে !!!!!!!!!!
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া, Jsfn21@gmail.com
|