আমরা কেন মিথ্যা বলি রিয়াজ হক
মিথ্যা কথা বলে প্রতিনিয়ত বাড়ি-গাড়ি সহ হাজারো পণ্য বিক্রি আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে। ধর্মীয় গুরু থেকে রাজনীতিবিদ, তথাকথিত সাধু থেকে ছাপোষা সাধারণ মানুষ, কে না মিথ্যা বলছে! অর্থাৎ কম-বেশি আমরা সবাই মিথ্যা বলি। প্রশ্ন, কেন বলি বা মিথ্যার উৎপত্তিই বা কোথা থেকে।
২০০৭ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ‘আর্থিক সঙ্কটে’ (financial crisis) পড়ে ও তার ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি সহ অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। তার ফলাফল নিয়ে গবেষণা করে অর্থনীতিবিদরা দেখিয়েছেন যে এতে করে মার্কিন অর্থনীতিতে প্রায় ৯৯৭ বিলিয়ন (আমেরিকান) ডলারের ক্ষতি হয়েছে। এর পুরোটাই ঘটেছে মিথ্যা কথা-রিপোর্ট-মুনাফার ভবিষ্যৎ বানী প্রকাশের মাধ্যমে। অর্থাৎ পুরো মিথ্যাচার ও জালিয়াতি ছিল এসব ব্যবসার কেন্দ্রে। একজন-দু’জন নয়, জেনেশুনে অসংখ্য শিক্ষিতরাই এসব করেছেন।
তাই বলা যায় যে মিথ্যা একটি সম্মিলিত প্রয়াস। একা একা মিথ্যা বলা যায় না বা বললেও তা কোন কাজে আসে না। বা বলা যায় তা কোন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে না। মিথ্যা হচ্ছে সত্য বা সত্য ঘটনা (truth) ও প্রার্থিত ঘটনার (wishful thinking) মধ্যকার যে ফারাক তাকে সীমিত করার; তার ভেতরে ইচ্ছা-সেতু তৈরি করার এক সচেতন প্রয়াস। মিথ্যার মূলে রয়েছে ‘আমরা কি হতে চাই’ বা ‘আমরা কি পেতে চাই’ এ দু’টি প্রশ্নের আকাঙ্ক্ষিত উত্তরে নিজেকে বা নিজেদের সমর্পিত করার আপাত নিরীহ অথচ অদম্য এক প্রচেষ্টা। নিজেকে বড় করে দেখানোর, বড়ত্বের জাহির, বড় কিছু অর্জনের বিপুল তৃষ্ণা মিথ্যা বলার প্রধান অনুষঙ্গ। সেই সাথে বৈধ-অবৈধ সম্পদ-অর্থের প্রাপ্তি, অতি মুনাফা অর্জনের প্রবল লোভও মানুষকে মিথ্যা বলায় বেপরোয়া করে তোলে।
যেদিন থেকে মানুষ যূথবদ্ধ বা সমাজবদ্ধ হয়েছে সেদিন থেকেই মানুষের মিথ্যা বলা শুরু। মিথ্যা বলা আজ আমাদের সমাজ ও সভ্যতার অংশ হয়ে গেছে যদিও আমরা তা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চাই। সমাজ বিজ্ঞানীরা আমাদের জীবন থেকে নেওয়া কতকগুলি বিষয়কে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন যে কিভাবে আমরা মিথ্যার ভেতরে ঢুকে যাই বা ঢুকে আছি!
(এক) শিশুদের অনেক কান্নাই হল আরোপিত, নকল বা ভান।
(দুই) এক বছরেই শিশু শিখে যায় কিভাবে জিনিস লুকাতে হয়।
(তিন) পাঁচ বছরেই শিশু বুঝে যায় মিথ্যা বলার সুবিধা (লাভ)।
(চার) নয় বছরের কিশোর জানে ঘটনাকে কি ভাবে উলটে দিয়ে নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করে শাস্তি পাওয়া থেকে দূরে থাকা যায়।
(পাঁচ) আঠার বছরের তরুণ তার অভিভাবকের বা পিতা-মাতার সাথে প্রতি পাঁচটি সাক্ষাতে অন্তত একটি মিথ্যা বলে।
(ছয়) বাইশ বছরের তরুণ মিথ্যা বোধ-বিশ্বাস, মিথ্যা স্বপ্ন, মিথ্যা সম্পর্ক সহ মিথ্যা জীবনাচরণে উদ্বুদ্ধ ও অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারে যার পরিণতি ভয়াবহ হতে বাধ্য।
মিথ্যা বলার উপর গবেষণা করে আরও যা পাওয়া গেছে তা খুবই চমকপ্রদ! যেমনঃ
(এক) সাধারণ ভাবে একজন অপরিচিত ব্যক্তি তার সাক্ষাতের প্রথম দশ মিনিটেই স্বাভাবিকের চেয়ে তিন গুন মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকেন।
(দুই) বহির্মুখী মানুষ অন্তর্মুখী মানুষের চেয়ে বেশী মিথ্যা বলেন।
(তিন) পরিচিত বা সহকর্মীদের তুলনায় অপরিচিতদের সাথে আমরা বেশী মিথ্যা বলি।
(চার) পুরুষেরা নিজের পড়াশুনা, অবস্থান, ভাবভঙ্গী ও কাজ সম্পর্কে মহিলাদের চেয়ে অন্তত আট গুন বেশী মিথ্যা বলে থাকেন।
(পাঁচ) মহিলারা প্রতিকূলতা ও দুর্বলতা থেকে নিজেদের বাঁচাতে ও প্রিয়জনদের রক্ষা করতে বা সহায়তা দিতে বেশী মিথ্যা বলেন।
(ছয়) অবিবাহিতরা দশটি কথার মধ্যে অন্তত তিনটি মিথ্যা কথা বলে থাকে।
(সাত) বিবাহিতরা পরস্পর প্রতি দশটি কথার মধ্যে অন্তত একটি মিথ্যা বলে থাকেন।
এখন প্রশ্ন কিভাবে বুঝবেন কেউ মিথ্যা বলছে! এ বিষয়েও থেমে নেই গবেষণা। মনো-বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন কেউ মিথ্যা বলছে বুঝবেন যদি খেয়াল করেন যে কেউ এরকম করছেঃ
(এক) প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করে উত্তর এড়াতে বা উত্তর তৈরি করে উত্তর দিতে সময় নেওয়ার প্রবণতা যখন পরিষ্কার লক্ষ্য-যোগ্য।
(দুই) ঘটনার সোজাসাপ্টা বর্ণনা দিতে অপারগ।
(তিন) বেশী কথা বলার বা ঘটনার সাথে সম্পর্কহীন অতিরিক্ত বর্ণনা দিতে উদগ্রীব।
(চার) ঠিক ঠিক তথ্য প্রদানে অসম্মত বা অনীহার প্রকাশ দেখা যাচ্ছে।
(পাঁচ) চোখের মণির সামঞ্জস্যহীন অস্থিরতা।
(ছয়) মলিন কৃত্রিম হাসি।
(সাত) ‘টু দ্য পয়েন্ট’ এ ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে অক্ষম।
(আট) বর্ণনা যখন সচেতন ভাবে আত্মরক্ষামূলক।
(নয়) কণ্ঠস্বর যখন সাধারণের চেয়ে উঁচুতে ও বারবার নিজেকে নির্দোষ বলার অবিরত প্রচেষ্টা দৃশ্যমান।
(দশ) কথা বলা ও দেহের অভিব্যক্তি যখন মোটেও সম্পূরক নয়।
এ তো গেল মিথ্যা বলার কারণ ও মিথ্যা চিহ্নিত করার বিষয়ের কথা। এখন দেখা যাক মিথ্যা থেকে বাঁচার উপায় কি! মিথ্যা থেকে বাঁচতে হলে যা করতে হবেঃ
(এক) মিথ্যা বলার সূচনা কিসে বা কি এমন জিনিষ বা বিষয় যা আমাদের মিথ্যার পথে ঠেলে দেয়। একটু সময় নিয়ে, স্থির হয়ে চিন্তা করতে হবে যে আমি কোথায়, কার সঙ্গে এবং আমার এ মূহুর্তের সঠিক অনুভূতি কি। আমি কি নিজের ভাল অনুভবের জন্য মিথ্যা বলছি নাকি অন্যকে ছোট করে নিজেকে বড় করে দেখানোর জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছি। এসব প্রশ্নের জবাব আমাকে মিথ্যা এড়াতে পূর্ব থেকে নির্দিষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে ঘটনার মোকাবেলার শক্তি দিবে, আমাকে সত্য বলার সাহস যোগাবে।
(দুই) মিথ্যার নানা রূপ আছে। নির্জলা মিথ্যা (complete untruth), বর্ণনার অতিশয়োক্তি (exaggerations), নির্দোষ মিথ্যা (white lies), ভুল করে মিথ্যা (lies by omission), হঠাৎ দুএকটি মিথ্যা (subtle lies)। এর কোনটি আপনার ক্ষেত্রে ঘটছে তা বুঝে তাকে চিহ্নিত করে তাকে বিসর্জন দিতে সচেতন প্রচেষ্টা নিতে হবে। এ জন্য অবচেতন মন ও বিবেকের কাছে নিজেকে দায়বদ্ধ করতে হবে।
(তিন) কথা বলার বা উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজের সীমানা চিহ্নিত করতে হবে ও তাতে স্থির থাকতে হবে। কথা বলা শুরু করলে জানতে হবে কোথায় থামব। মনে রাখতে হবে সেই গানের বানী “বড় দেরীতেই তুমি বুঝলে কেউ নিজেকে ছাড়া ভাবে না”। বেশী ‘আমি’ আমি’ ধারনা ও গল্প মানুষ কে অসহিষ্ণু বা বিরক্ত করে। নিজের মধ্যে বিনীত ভাবে ‘না’ বলার শক্তি অর্জন করতে হবে ও তাকে অভ্যাসের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।
(চার) সত্য বললে সবচেয়ে খারাপ কি ঘটতে পারে তা জেনে-বুঝে সত্যের পথে হাঁটতে প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ সত্য কঠিন কিন্তু ‘সত্য চিরদিনই সর্বোত্তম’। সত্যের শক্তি প্রচণ্ড। সত্য জীবনের পথের আলোর দিশারী। সত্য আনন্দ ও সুখের অবিমিশ্র এক ধারা। বিলম্বে হলেও সত্য সবসময় ন্যায় কে নিশ্চিত করে। সত্য মানুষকে বড় করে তোলে।
(পাঁচ) মিথ্যার সঙ্গে লড়াইয়ে প্রতিটি দিনকেই হিসেবে নিতে হবে। কখনো কখনো পুরো সত্য বললে আশু সমস্যায় পড়ে হাবুডুবু খাওয়ার চেয়ে আংশিক সত্য বলেও সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়া যেতে পারে। তবে সত্যের সঙ্গে কোন ভাবেই মিথ্যাকে মিশ্রিত করা যাবে না।
(ছয়) মিথ্যা, মিথ্যাই। অসততা, অসততাই। কোন ভাবেই তাকে সমর্থন বা অনুমোদন দেওয়া যাবে না, হোক না তা নিজের কোন প্রিয় জনের ব্যাপারেই। বরং সমর্থনের চেয়ে চুপচাপ বা মন্তব্যে বিরত থাকাও এক্ষেত্রে উত্তম।
(সাত) মিথ্যা কারো জন্য কখনোই কোন কল্যাণ বয়ে আনে না। মিথ্যা সমাজকে কলুষিত করে। ন্যায়কে পর্যুদস্ত করে। ভালো বা কল্যাণ কে বিপর্যস্ত করে সমাজে অন্যায়ের বিচরণ ঘটায়। এর ফলে ভোগে সবাই। কারণ তখন সব পথ হয়ে যায় অবিবেচকের ও অন্যায়ের। যে পথ কারোরই কাম্য নয়।
 রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া Jsfn21@gmail.com
|