আমাদের আত্মা যখন মরে যায়! রিয়াজ হক
‘শান্তি নিকেতন’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের একটি ছোট্ট অসাধারণ প্রবন্ধের নাম ‘আত্মার দৃষ্টি’। তাতে তিনি বলছেন, “বাল্যকালে আমার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু আমি তা জানতুম না। আমি ভাবতুম দেখা বুঝি এই রকমই--সকলে বুঝি এই পরিমাণেই দেখে। একদিন দৈবাৎ লীলাচ্ছলে আমার কোনো সঙ্গীর চশমা নিয়ে চোখে পরেই দেখি, সব জিনিস স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তখন মনে হল আমি যেন হঠাৎ সকলের কাছে এসে পড়েছি, সমস্তকে এই যে স্পষ্ট দেখা ও কাছে পাওয়ার আনন্দ, এর দ্বারা বিশ্ব ভুবনকে যেন হঠাৎ দ্বিগুণ করে লাভ করলাম--অথচ এতদিন যে আমি এত লোকসান বহন করে বেড়াচ্ছি তা জানতুমই না।“
এই দেখার-জানার-বোঝার ব্যাপারটা আমরা আমাদের নিজ জীবনেও প্রতি মূহুর্তে দেখে চলেছি, নয় কি! ছাত্র জীবনের কথাই যদি ধরি, প্রাইমারি স্কুলের সেই কবিতাটির কথা মনে করুন,
“একদা স্নানের আগারে পশিয়া/হেরিনু মাটির ঢেলা, শুকিয়ে তারে দেখিনু /রয়েছে সুবাস মেলা, কহিনু কস্তুরি তুমি/তুমি কি আতরদান, তোমার গায়েতে সুবাসে ভরা/তুমি কি গুলিস্তান, কহিল ওসব কিছু নহি/আমি অতি নীচ মাটি, ফুলের সঙ্গে থাকিয়া তাহার/সুবাসে হইনু খাটি।“ - শেখ সা'দী।
এই কবিতার অর্থ কি আমরা সেই সময়ে সবাই একই ভাবে বুঝেছিলাম? না বুঝিনি। যেমন সবাই একই ভাবে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, ল্যাপ্লাস ট্রান্সফরমেশন বা মহাকাশের গঠন ও ক্রিয়া বুঝিনি। বুঝিনি ‘প্লেটোর রিপাবলিক’ বা ‘এরিষ্টটলের পলিটিকস’ এর সব কথা। তাই সত্য হল, আমি যা বুঝি বা আমি যা জানি তার বাইরেও বোঝার ও জানার অনেক কিছু অবশিষ্ট থেকে যায়। থেকে যায় বলেই তাকে আমলে নিয়ে আমার চেয়ে যিনি বেশি বোঝেন বা জানেন তার কাছে আমরা মাথা নত করি। আর এজন্যই অনাদি কাল থেকে সমাজ ভালো ছাত্র-শিক্ষক-জ্ঞানী গুণীদের সম্মান জানিয়ে আসছে। তাদেরকে সমাজের উঁচু আসনে বসিয়েছে। কারণ এতেই সমাজে হিত নিহিত।
এখন প্রশ্ন হল, ‘আমি যে সব জানিনা বা দেখতে পাইনা’ তা আমি মেনে নিচ্ছি বা স্বীকার করছি কি না! সমস্যা এখানেই। মানুষের ভেতর ‘আমি’ নামের যে ভয়ঙ্কর দানব বাস করে তাকে যদি আপনি নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারেন তাহলে আমার এই ‘স্বৈর-আমিত্ব’ আমাকে শেষ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই ‘আমিত্বের’ অহিতকর দানবের কাছে বন্দী। কারণ মানুষ ‘নিজস্ব -নিজেকে’ পরাজিত দেখতে ভালোবাসে না। যে কোন ভাবেই হোক জয় তার চাইই।
কথা হল, এ থেকে মুক্তির উপায় কি! মুক্তির একমাত্র উপায় হল অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে বের হয়ে নিজেকে আলোর পথে নিয়ে যাওয়া। আমরা কোন ঘর বা পরিবারে জন্ম নিচ্ছি, কিভাবে-কোন নিয়ম নীতিতে বেড়ে উঠছি, কোথায় পড়ছি; স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এসবই নিজেকে ‘আমিত্ব’ থেকে মুক্তি দিতে কাজ করতে পারে। তারপরও যদি আমার-আপনার মুক্তি না ঘটে তবে বুঝতে হবে যে সে ঘাটতি পূরণের জন্য আমাদের অন্য জীবনের অভিজ্ঞতার কথা শুনতে হবে; তাদের লেখা গ্রন্থের কাছে ছুটে যেতে হবে। অর্থাৎ একমাত্র বই পড়া থেকে আমরা আমাদের মনের অন্ধকার, সঙ্কীর্ণতা মোচন করতে পারি।
বই পড়া পরিশ্রমের কাজ। এজন্য ধীশক্তি ও ধৈর্য প্রয়োজন। এই ক্যালকুলেটর, কম্পিউটার, এ-আই এর যুগে আমরা যেন সে শক্তি ক্রমাগত হারিয়ে ফেলছি। আমাদের সর্বনাশ করে দিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত নানা প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় সংবাদ, তত্ত্ব-তথ্যের বিপুল আগ্রাসন। আমাদের ‘ঠিক-বেঠিক’, ‘সত্য-মিথ্যা’ যাচাইয়ের ভদ্রতা নেই, অল্গারিদমে তৈরি ‘আমাদের শুনতে চাওয়া যে কোন কিছু’ পেলেই হয়, আমরা বর্তে যাই; অন্ধের মত ‘পড়ি-মরি’ তার পেছনে ছুটি, তাকে অনুসরণ করি। এসবই আমাদের নির্মোহ বিবেচনা শক্তিকে অসার,পঙ্গু, একমুখী করে আত্মাকে শ্মশানে নিক্ষেপ করছে।
‘ডেড ম্যান ওয়াকিং’ বলে ইংরেজিতে একটা কথা আছে। এর অন্য যে অর্থই থাকুক না কেন, আমার কাছে আত্মার বিনাশ মানে ঐ ‘মৃত ব্যক্তির হেঁটে যাওয়ার’ সামিল। আত্মা বেঁচে থাকে নিঃশর্ত ভাবে প্রকৃতি ও মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে। প্রকৃতি ও মানুষের কষ্টে যদি আপনি কষ্ট না পান, তাদের সংগ্রাম ও আনন্দকে যদি আপনি এপ্রিশিয়েট করতে না পারেন বুঝতে হবে আপনার ভেতরের গলদ আপনাকে জীবন বিমুখ করে ফেলেছে। আপনার রাজনীতি, ধর্ম-গোত্র বিশ্বাস আপনার আমিত্বকে গ্রাস করে ফেলেছে, আপনাকে দানব বানিয়ে ফেলেছে।
ইতিহাসে এরকম অসংখ্য দানবের বাস্তব গল্প-কাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমি তাতে যেতে চাচ্ছি না। আমি যা বলতে চাই তা অত্যন্ত সোজা সাপটা, আমিত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করে সমগ্র প্রকৃতি ও মানুষের দিকে তাকান, দেখেন,নিজের একমুখী বিশ্বাসের আয়নায় না, বহুত্বের বিশ্বাসী আয়নায়! দেখেন কোথায় মানুষ কষ্ট-বেদনায় আছে, কোথায় মানুষের অধিকার নস্যাৎ হচ্ছে, কোথায় প্রকৃতি বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে, কোথায় প্রকৃতিকে অসহনীয় বেদনা উপভোগ করতে হচ্ছে!
এই যে যুদ্ধ, অগণিত মানুষের মৃত্যু, প্রকৃতির ধ্বংস এ আমাদের কোন উপকার সাধন করছে! আমরা কাদের বিবেচনায় আস্থা রেখে, কাদের কথা বিশ্বাস করে এই অভাবনীয় ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে ছুটছি তা নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করুন, নিজের বোধ-বিবেচনা-আত্মার দিকে নিরপেক্ষ ভাবে তাকান!সে কি বলে, কি ইঙ্গিত দেয় তা জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের আত্মা সবসময়ই শুভ ও সুন্দরের পক্ষে জীবনের কথা বলে।
যেমন ঐ একই প্রবন্ধে (আত্মার দৃষ্টি) রবীন্দ্রনাথ বলছেনঃ “আমাদের চেতনা আমাদের আত্মা যখন সর্বত্র প্রসারিত হয় তখন জগতের সমস্ত সত্তাকে আমাদের সত্তার দ্বারাই অনুভব করি, ইন্দ্রিয়ের দ্বারা নয়, বুদ্ধির দ্বারা নয়, বৈজ্ঞানিক যুক্তির দ্বারা নয়। সেই পরিপূর্ণ অনুভূতি একটি আশ্চর্য ব্যাপার।“
“মানুষকেও আমার আত্মা দিয়ে দেখি নে-- ইন্দ্রিয় দিয়ে যুক্তি দিয়ে স্বার্থ দিয়ে সংসার দিয়ে সংস্কার দিয়ে দেখি--তাকে পরিবারের মানুষ, বা প্রয়োজনের মানুষ, বা নিঃসম্পর্ক মানুষ বা কোনো একটা বিশেষ শ্রেণীভুক্ত মানুষ বলেই দেখি--সুতরাং সেই সীমাতেই গিয়ে আমার পরিচয় ঠেকে যায়--সেইখানেই দরজা রুদ্ধ--তার ভিতরে আর প্রবেশ করতে পারি নে--তাকেও আত্মা বলে আমার আত্মা প্রত্যক্ষ ভাবে সম্ভাষণ করতে পারে না। যদি পারত তবে পরস্পর হাত ধরে বলত, তুমি এসেছ!”
যদি আমাদের আত্মা মরে যেয়ে থাকে, আমি তার জাগরণের পক্ষে। আমি তার নির্মোহ উদ্বাহু উন্মোচনের পক্ষে। আমি তার মানবতাবাদী পথচলার আদর্শের পক্ষে। আমার নিজস্ব অন্য বিশ্বাস যাই থাকুক না কেন, আমি সর্বত্র আত্মার উদ্বোধনে বিশ্বাসী। এছাড়া আমাদের মানব জাতির বিজয়ে আর কোন পথ নেই। এর বাইরে সবই একমুখী ও আংশিক। তা থেকে আমরা বিজয়ের নয়, কেবল পরাজয়ের পথেই হেঁটে যাব, এ নিয়ে অন্তত আমার কোন সন্দেহ নেই!
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া Jsfn21@gmail.com
|