bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













দুঃস্বপ্নের খণ্ডচিত্র - (২)
অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুর রাযযাক


আগের পর্ব পরের পর্ব


স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে সোনারগাঁ আসার পর থেকেই প্রতিদিন রাতের খাওয়া সেরে আমরা বিভিন্ন দেশের রেডিও অনুষ্ঠান শোনার চেষ্টা করতাম। পাকিস্তানি বেতারকেন্দ্রগুলো থেকে মিথ্যার ফুলঝুরি ছাড়া আর কিছু প্রচার হত না বলে কেউ সে সব অনুষ্ঠান শুনতো না। আমরা সবাই কলকাতার আকাশবাণী থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠান শোনার জন্য বেশী আগ্রহী ছিলাম। পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন এদেশে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল, তখন এ দেশের মানুষের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন ছিল মনোবল এবং মানসিক শক্তির। সত্যি বলতে কি ২৬ মার্চের সেই কালরাতের পর থেকেই অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্র, আকাশবাণী, সর্বতোভাবে এদেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। সেই ভয়ঙ্কর সময়ে ‘আকাশবাণী কলকাতা, খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়’- অত্যন্ত ভরাট কণ্ঠ এবং দরাজ গলার এই সম্ভাষণ এদেশের মানুষকে আশ্বস্ত করত। ২৬ মার্চের সেই কালরাতে পূর্বপাকিস্তান নামক অগ্নিদগ্ধ এবং মৃত ভূখণ্ডের ছাই থেকে ফিনিক্স (গ্রীক, রক্তলাল) পাখির মত জন্ম নিয়েছে নতুন জনপদ রক্তলাল বাংলাদেশ; কিন্তু রক্তস্নাত সে জনপদ আজ অবরুদ্ধ, সেখানকার শ্বাসরূদ্ধকর পরিবেশে মানুষ ছিল বড় অসহায়, তারা শুনতে চাইতো আশার বাণী, বরাভয়। সেই আশার বাণীই দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় শোনাতেন বাংলাদেশের অসহায় মানুষকে। মুক্তিকামী কোন বাঙালীই সে সময় আকাশবাণীর রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার সংবাদ না শুনে ঘুমোতে যেত না। আমাদের সস্তা দামের ট্রানজিস্টারে বিদেশী রেডিও স্টেশন যেমন BBC কিংবা ভয়েস অব আমেরিকা সব সময় শোনা যেত না। আর কখনো-সখনো শোনা গেলেও বেশ কষ্ট করে শুনতে হোতো। তবু সে সব স্টেশন ধরার জন্য আমি অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যেতাম এবং সারাক্ষণ উৎকর্ণ হয়ে শুনতে চাইতাম তাদের কথা। আমার সে চেষ্টার পুরস্কার হিসেবে একদিন আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতে পেলাম।

সোনারগাঁ আসার দু’দিন পর, আটাশে মার্চ দুপুরে বাজারে এক ওষুধের দোকানে শুনেছিলাম আগের দিন অর্থাৎ সাতাশে মার্চ সন্ধ্যা ৮টার দিকে নাকি অনেকেই রেডিওতে মেজর জিয়াউর রহমানের ভাষণ শুনতে পেয়েছেন। এই ভাষণ চট্টগ্রামের কালুরঘাটে অবস্থিত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়েছে। তার অতি সংক্ষিপ্ত ভাষণে জিয়াউর রহমান নাকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে পূর্ববাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং পূর্ব-বাংলার সকল সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্য এবং দেশের আপামর জনসাধারণকে হানাদার পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের এ দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করার আহ্বান জানিয়েছেন। কথাটা বিশ্বাস করতে খুব ইচ্ছে হলেও কেমন যেন একটু দ্বিধা রয়ে গেল – আমি নিজে কিংবা আমার খুব বিশ্বাসভাজন কেউ তো আর এ ভাষণ শোনেন নি। খুবই মন খারাপ হোল, এমন একটা ঐতিহাসিক ভাষণ শোনা হোলনা। কিন্তু বিদেশী রেডিও শুনতে চাওয়ার আমার অদম্য প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে মাত্র একদিন পর, ২৯শে মার্চ রাতে বাসার অনেকের সাথে আমি নিজের কানে সে ঘোষণাটি শুনতে পেলাম- “On behalf of our great national leader, supreme commander of Bangladesh Sheikh Mujibur Rahman, I do hereby proclaim the independence of Bangladesh…” রেডিও স্টেশনটি অবশ্য চট করে ধরা যায় নি, এবং সে রেডিওর সম্প্রচার শুনতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু সেদিনের পর সবার কাছে এটা কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আছে এবং দেশকে স্বাধীন করার সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। ২৬শে মার্চ, ১৯৭১, সন্ধ্যে৭:৪৫ মিনিটে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে যে ঘোষণাপত্রটি মেজর জিয়াউর রহমান পাঠ করেন, সেটা অবশ্য পরে আমি BBC এর পুনঃ সম্প্রচার থেকেও শুনতে পাই। তবে সে ঘোষণাটি আমার প্রথম শোনা ঘোষণাটির চেয়ে একটু ভিন্ন ছিল। যতদূর মনে পড়ে তাতে বলা হয়েছিল “This is Swadhin Bangla Betar Kendra. I, Major Ziaur Rahman, at the direction of Bangobondhu Mujibur Rahman, hereby declare that Independent People's Republic of Bangladesh has been established.”

মোগরাপাড়া এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ঠিক পাশেই নাসিমদের, মানে আমার শ্বশুর পরিবারের পৈতৃক ভিটা। এই মহাসড়ক তৈরির সময় তাদের মূল বাড়ির প্রায় অর্ধেকটাই তদানীন্তন সরকার রিকুইজিশন করে নয়। বাড়ির উপর দিয়ে চলে যাওয়া এই মহাসড়কে পাক-বাহিনীর নিয়মিত টহল থাকার কারণে আমার কাছে এই বাড়িতে থাকাটা নিরাপদ মনে হয় নি। আর তাই আমরা এই বাড়িতে না উঠে মহাসড়ক থেকে বেশ দূরে ভেতরের দিকে নানার বাড়ি উঠেছি। কিন্তু ঐ বাড়ি থেকে প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ আমাদের খোঁজ খবর নিয়ে যেত। তাদের কাছ থেকে শুনেছি সেই রাস্তা দিয়ে প্রায় প্রতিদিন সৈন্য চলাচল করে এবং তারা অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে থাকেন। কিন্তু ঢাকা থেকে ফিরে এসে রাতে শুনলাম, সেদিন দুপুরে নাকি পাকিস্তানী সৈন্যরা রাস্তায় পথচারীদেরকে লক্ষ্য করে গোলাগুলি করেছে এবং কয়েকজন জোয়ান ছেলেকে ধরে একটা ট্রাকে তুলে নিয়েছে। রাস্তার ধারে যাদের বাড়ি তারা আরো ভেতরের দিকে চলে গেছে। পাড়ার মুরুব্বীদের ধারণা সোনারগাঁ আর নিরাপদ জায়গা নয়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনা সামরিক সামগ্রী, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রসদ এবং অস্ত্র সরবরাহের লাইফ-লাইনই হচ্ছে এই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। দিনে দিনে এই মহাসড়কে সৈন্য চলাচল বাড়তে বাধ্য এবং এই পথ নিরাপদ করতে পাকিস্তানী সৈন্যরা কোন ধরণের নৃশংসতার সাহায্য নিতে দ্বিধা বোধ করবে না। ব্যাপারটা তো আসলে ঠিক এভাবে ভাবা হয় নি; ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে নিরাপদে সোনারগাঁ ফিরে আসতে পেরে বেশ স্বস্তিতে ছিলাম। কিন্তু মনে হোল এ নিরাপত্তা খুবই ঠুনকো এবং যে কোন সময় তা বিঘ্নিত হতে পারে।

ঢাকা ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল ব্যাংকে যখন টাকা তোলার জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন অনেকেই বলাবলি করছিলেন যে দুঃসময়ের সবে তো মাত্র শুরু; সামনে আরো ভয়াবহ খারাপ সময় আসছে। তাদের ধারণা আগামী দিনগুলোতে পাকিস্তানি হার্মাদরা ঢাকার বাইরে মফঃস্বল শহর এবং গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়বে এবং সেখানে অত্যাচার চালাবে। তারা মনে করেন সে সময় রাজধানী শহর ঢাকা তুলনামূলক ভাবে নিরাপদ থাকবে। সারা পৃথিবীর মানুষ যেহেতু এখন পাকিস্তানি মিলিটারি জান্তার গণহত্যার নিন্দায় মুখর সে নিন্দার স্রোত বন্ধ করার জন্য সরকার ঢাকার অবস্থা স্বাভাবিক দেখানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে। আমার ফুপু-শ্বাশুরীর বাসাতেও প্রায় সকলেরই একই ধারণা আর তাই ফুপু-আম্মা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদেরকে ঢাকায় ফিরে আসার পরামর্শ দিলেন। তার ধারণা, যত সময় যাবে, থাকার জন্য সোনারগাঁ ততই অনিরাপদ হয়ে যাবে। নারায়ণগঞ্জে বাবা-মায়ের সাথে দেখা করে আসার সময় এ ব্যাপারে তাদের পরামর্শ চেয়েছিলাম; কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত যে সময়োপযোগী হবে একাত্তরের সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলোতে কারো পক্ষেই বলা সম্ভব ছিল না। তবে বাবা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে নারায়ণগঞ্জের বাসায় ফিরে যেতে নিষেধ করলেন; তার ধারণা সে বাসা সৈন্যদের নজরদারীতে আছে।

বাবার ধারণা মোটেই অমূলক ছিল না। আমার ছোটবোন ফরিদা নারায়ণগঞ্জ মহিলা আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেত্রী; ভগ্নীপতি আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা। পাকিস্তানি সৈন্যরা নারায়ণগঞ্জ শহরে ঢোকার অল্পসময়ের মধ্যেই বাবুরাইল এলাকায় তাদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে এবং তারা বাচ্চা-কাচ্চা সহ সীমান্ত পেরিয়ে আগরতলা চলে গেছে। সৈন্যরা তাদের খুঁজতে আমাদের বাড়িতে এসে প্রচণ্ড হম্বিতম্বি করে গেছে। সম্ভবতঃ বয়স্ক মানুষ বলে তারা বাবা-মাকে প্রাণে মারে নি, তবে বলে গেছে আবার তারা আসবে। তাই বাবা-মা মোটেই চান না যে আমরা নারায়ণগঞ্জের বাসায় ফিরি। সোনারগাঁ ফিরে এসে নাসিমের সাথে আলাপ করছিলাম সে সময়টাতে কি করা আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত হবে, কিন্তু বুঝে উঠতে পারি নি।

এর মধ্যে আর একটি সমস্যা আমাদের দুশ্চিন্তা প্রচণ্ড রকম বাড়িয়ে দিল; আমাদের মেয়ে সোনিয়া মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লো। অসুখের প্রথম দিকে আমরা ভেবেছিলাম এমনিতেই সেরে যাবে; কিন্তু আমাদের ধারণাকে মিথ্যে করে দিয়ে দ্রুত অসুখ বাড়লো। স্থানীয় ডাক্তারের দেয়া ঔষধে কোন কাজ হল না; সোনিয়ার শরীর খুব দ্রুত খারাপ হতে শুরু করলো। সোনারগাঁ নানার বাড়িটা বেশ বড় এবং সুন্দর। এ বাড়িতে দীঘির মতো বড়ো টলটলে পানির পুকুর আছে, বিভিন্ন ফুল-ফলের গাছ আছে, আছে গরুর বড় বাথান আর সারাদিন অজস্র পাড়া-পড়শির আনাগোনা। নাসিমের অজান্তেই এই পড়শিরা আমাদের সদা হাসি-খুশি মেয়েটিকে কোলে-কাঁখে নেয় এবং আদর করে এটা-সেটা খেতে দেয়। ডাক্তারের ধারণা কোন খাবার থেকে তার food poisoning হয়েছে। তিনি আমাদেরকে পরামর্শ দিলেন আমরা যেন ঢাকায় গিয়ে মেয়েকে কোন শিশু বিশেষজ্ঞ দেখাই। ফলে ঢাকা যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকলো না। ঠিক এই সময়টায়, যতটুকু মনে পড়ে ১৫ই এপ্রিল, বাংলা নববর্ষের সকালে আমার চাচা শ্বশুর ওয়াফা উল হক খন্দকার আমাদের নিতে সোনারগাঁ এসে হাজির। ফুপু-আম্মা্র কাছে সোনিয়ার মা নাসিম তার প্রথম সন্তানের মত, বড় মেয়েকে নিয়ে যাবার জন্য ফুপু-আম্মা তার ভাইকে পাঠিয়েছেন। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল; আমরা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি গোছগাছ করে রওয়ানা হলাম। প্রথমে নারায়ণগঞ্জ যাব তারপর সেখান থেকে ঢাকা।

নারায়ণগঞ্জ এসে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা ঢাকা রওয়ানা হলাম। কিন্তু এ সময় বাবা গোঁ ধরে বসলেন- বৌমাকে অবশ্যই বোরকা পরতে হবে – বোরকা ছাড়া বের হওয়া চলবে না! বেচারি নাসিম, সে কেমন করে রাশভারী শ্বশুরের কথা অমান্য করবে? আমি মিন মিন করে তার পক্ষে ওকালতি করতে গিয়ে বাবার ধমক খেলাম – ‘জানো, মানুষের বাড়িঘর থেকে আর্মি সোমত্ত মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে আর তা জেনেও তোমরা সাবধান হবে না?’ এরপর তো আর কথা চলে না। কিন্তু বোরকা পড়তে গিয়ে আরেক বিপত্তি; আমার পাঁচ-ফুট লম্বা মায়ের বোরকা সাড়ে পাঁচ-ফুট লম্বা স্ত্রীর গায়ে অত্যন্ত হাস্যকর লাগছে। কিন্তু কিছু করার নেই, মায়ের সেই হাস্যকর বোরকার আড়ালে গোমড়া-মুখ করা বউকে সংগে নিয়ে আমরা নারায়ণগঞ্জ বাস-স্ট্যান্ড এর দিকে রওয়ানা হলাম।

ঢাকায় ফিরতে তেমন কোন অসুবিধা হয়নি। তবে কেন যেন ভয়টা সংগ ছাড়েনি। ঢাকায় এসে শুনলাম আগের দিন নাকি নবাব বাড়ির খাজা খায়রুদ্দিনকে...

...আহবায়ক করে ‘শান্তি কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটির সব সদস্যদের নাম মনে নেই, তবে গোলাম আযম এবং শাহ আজিজের নাম মনে আছে। নাসিমের ছোট ফুপু তাহেরা জানালো এবার পহেলা বৈশাখের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। হঠাৎ করেই মনে হোল আজ আমার জন্মদিন; মা প্রতি বছর এই দিনটিতে আমাকে ঘন দুধের পায়েস করে খাওয়াতেন। ১৯৬৮ সালের এই দিনটির পর মায়ের হাতের সে পায়েস আর খাওয়া হয়নি। আজ সকালে যদিও মায়ের সাথে দেখা হয়েছে কিন্তু তাকে পায়েস রাঁধার সময় দেয়া হয়নি। নিশ্চয়ই এ কথা মনে করে মা খুব কষ্ট পাবেন।

ঢাকায় এসে আমার প্রথম কাজ হোল একটা বাসা ভাড়া নেয়া। ফুপু-আম্মার বাসার পুরোনো খবরের কাগজ থেকে জেনেছি যে ক্লাস শুরু না হলেও আমাদের কাজে যোগ দিতে হবে। ৭ই মার্চে পূর্ব পাকিস্তানের নতুন গভর্নর হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত বেলুচিস্তানের কসাই নামে খ্যাত টিক্কা খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষকদের ১ জুন কাজে যোগ দেবার হুকুম দিয়েছে; ২রা আগস্ট থেকে নাকি সকল ক্লাস চালু হবে। ফুপু-আম্মা অবশ্য আমার আলাদা বাসা নেবার সিদ্ধান্তে খুব মন খারাপ করলেন। কিন্তু আমার সাথে দুই বোন আছে, তাদের নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে অবস্থান করার প্রশ্নই ওঠে না। বাসা পেতে মোটেই বেগ পেতে হোল না। এলিফেন্ট রোডে, ইউনিভার্সিটির খুব কাছেই ২৮০ টাকা মাসিক ভাড়ায় একটা চার-কামরার বাসা পেয়ে গেলাম। বাড়ীর মালিক তার দো’তলা বাসাটির নীচতলাটি দুই অংশে ভাগ করে দুটো বাসা বানিয়েছেন। আমার বাসাটি বাড়ির সামনের দিকের অংশ। বাড়িওয়ালা জানালেন পেছনের অংশের ভাড়াটের নাম রফিকুল ইসলাম এবং তিনি ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদ পাঠক। ঠিক হোল মে মাসের শেষ দিকেই আমরা সে বাসায় উঠে যাব।

বাসায় সময় কাটতে চায় না, অথচ হাতে অখণ্ড সময়। জামাই মানুষ, শ্বশুর-শ্বাশুরী স্থানীয় মুরুব্বিদের সাথে কি কথা বলবো। আজকাল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান মোটামুটি ধরা যাচ্ছে, তবে তা খুব কম সময়ের জন্য এবং খুব সাবধানে শুনতে হয়। কেন যেন প্রচারের কোন নির্দিষ্ট সময় নেই – সাধারণতঃ সকাল আটটা-সাড়ে আটটা থেকে ন’টা-সাড়ে ন’টা এবং বিকেলে পাঁচটা থেকে সাতটা পর্যন্ত অনুষ্ঠান প্রচার হয়ে থাকে। অনুষ্ঠান শুরু এবং শেষ হয় শাহনাজ রহমতুল্লাহর বিখ্যাত গান ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ দিয়ে। মাঝখানে প্রচারিত হয় ইংরেজি এবং বাংলা খবর, দেশাত্মবোধক গান, ভিনদেশী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশ সংক্রান্ত খবর এবং কথিকা। তবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশী ভালো লাগে ‘চরমপত্র’। প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক এম আর আখতার মুকুলের বিচিত্র ভাষায় রচিত এবং উপস্থাপিত বিদ্রূপাত্মক কথামালায় গ্রন্থিত এই অনুষ্ঠানটি শোনার জন্য বাসার সবাই উন্মুখ হয়ে থাকে। চরমপত্রে ব্যবহৃত কথা যেমন ‘…আগায় খান পাছায় খান, …’, ‘… আয় মেরে জান, পেয়ারে দামান …’ ‘ …কেচকির মাইর…’ সেই দুঃস্বপ্নের দিনে কিছুক্ষণের জন্য হলেও শ্রোতাদেরকে মানসিক বৈকল্য থেকে মুক্তি দিত।

এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী এবং বিবিসি রেডিও থেকেই আমরা জানতে পারি যে ১০ই এপ্রিল তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠন করা হয়েছে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ সরকারে উপরাষ্ট্রপতি হবেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর ঠিক দু’দিন পর, ১২ এপ্রিল, সরকার কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী পিএসসিকে মন্ত্রীর মর্যাদাসহ বাংলাদেশ ফোর্সেসের কমান্ডার-ইন-চীফ হিসেবে নিয়োগ দেন। ১৭ই এপ্রিল বর্তমান মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের এই সরকার আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করে। সে অনুষ্ঠানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত 'আমার সোনার বাংলা' গানটি পরিবেশন করার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর আজ যখন স্মৃতির আয়নায় ভেসে ওঠা এ সব ঘটনার কথা লিখছি, তখন তো এ সব কথাই অতীত ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। কিন্তু যখনই মনে হয় একদিন আমি এবং আমারই মতো আরো অনেকেই যারা এই ঘটনাগুলোর সাক্ষী হিসেবে শিহরিত ছিলাম, ছিলাম স্বাধীন দেশ দেখার স্বপ্নে উন্মুখ, তাদের অনেকেরই স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যাবার সৌভাগ্য হয় নি, তখন মনটা কেমন যেন ব্যথাতুর হয়ে ওঠে।

নাসিমের মন খুব খারাপ, তার বাবা-মা, ভাই-বোন, বড় চাচা-চাচী, চাচাতো বোন, মামা, খালু সব পাকিস্তানের রাজধানী শহর ইসলামাবাদে আটকে আছেন, তাদের কোন খোঁজ-খবর নেই। দিনের বেলায় আত্মীয় স্বজনের মাঝখানে কোনভাবে কেটে গেলেও রাতে তার ভালো ঘুম হয় না। দিনের পর দিন নির্ঘুম রাত শেষ হয়ে ভোরের সূর্য দিগন্তে আলো ছড়ায়, প্রকৃতি হেসে ওঠে, কিন্তু সে আলোতে অবরুদ্ধ পূর্ববাংলার মানুষের চোখে মুখের মালিন্য আর কাটে না। (চলবে)



আগের পর্ব পরের পর্ব


মোহাম্মদ আবদুর রাযযাক, সিডনি




Share on Facebook               Home Page             Published on: 1-Dec-2021

Coming Events:





A day full of activities, games and fun.







Blacktown Lakemba Mascot