bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













দুঃস্বপ্নের খণ্ডচিত্র - (১)
অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুর রাযযাক



পরের পর্ব


৮ই এপ্রিল, ১৯৭১, বৃহস্পতিবার। ছাব্বিশে মার্চ দুপুর বেলা নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে সোনারগাঁ এসে আস্তানা গাড়ার প্রায় দু’সপ্তাহ পর ঢাকা যাবার জন্য এটা আমার দ্বিতীয় প্রচেষ্টা। গত সোমবার, মাত্র চারদিন আগে নেয়া আমার প্রথমবারের প্রচেষ্টা সাহসের অভাবে সফল হয়নি। শীতলক্ষ্যা নদীর নবীগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত এসেও ফিরে গিয়েছিলাম; নদী পারাপারের খেয়ানৌকায় পাকিস্তানী সৈন্যের গুলিতে প্রাণ হারানো নিরীহ বৃদ্ধ মাঝির আকাশের দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকা লাশ আমাকে প্রচণ্ড ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। হঠাৎ করেই মৃত্যুভয় আমাকে তাড়া করেছিল। আজ সেই ভয় কেটে গেছে তা নয়, তবে আজ খেয়া পারাপার চলছে এবং মানুষ এপার থেকে ওপার যাচ্ছে। সাহস করে আমিও যাচ্ছি। নবীগঞ্জ ঘাট থেকে ছেড়ে আসা খেয়া নৌকা নদীর অপর পার একরামপুর ঘাটে এসে ভিড়লো। নাহ, এ পারে কোন লাশ নেই, তবে কেমন যেন একটা লাশ-পচা গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। খেয়াঘাটের পয়সা জমা নেয়ার গুমটি ঘরে জ্বলতে থাকা তীব্র গন্ধের আগরবাতিও সে গন্ধ ঠিকমত দূর করতে পারে নি। তাড়াতাড়ি ঘাট থেকে রাস্তায় উঠে এলাম। সকাল সাতটায় সোনারগাঁ থেকে রওয়ানা হয়ে এ পর্যন্ত আসতেই প্রায় দেড় ঘণ্টার মত সময় লেগে গেলো। এখান থেকে আমাকে আরো মাইল দেড়েক দূরের নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশন আর লঞ্চঘাটের পাশে অবস্থিত বাস-স্ট্যান্ডে যেতে হবে ঢাকাগামী বাস ধরার জন্য। কিন্তু খেয়া ঘাটে কোন রিকশা নেই। অন্যান্য আরো যাত্রীদের মত হেঁটেই রওয়ানা হলাম। একটু এগিয়ে যেতেই কেল্লার পুল আর তার ঠিক পাশে অবস্থিত নারায়ণগঞ্জ ইলেকট্রিক সাপ্লাই সদর দফতর পাহারায় নিয়োজিত পাকিস্তানী সৈন্যদের দেখা পাওয়া গেল। তারা অবশ্য পথচারীদের দিকে অগ্নিদৃষ্টি হানা ছাড়া আর কিছুই করলো না। আরো কিছুক্ষণ হাঁটার পর বরফকল আর এস ডি ওর বাংলোর কাছাকাছি আসার পর আবার ক’জন সৈন্যের দেখা মিললো। তারা পথচারীদের লুঙ্গি খুলে মুসলমানিত্ব পরীক্ষা করে দেখছিল। তখন আমি আমি মোটামুটি ভালো উর্দু জানতাম, সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম ‘পাতলুন খুলনা পড়েগা ক্যায়া’? সাধারণ বাঙ্গালীদের তুলনায় আমি একটু লম্বা এবং আমার গায়ের রং আমার মায়ের ভাষায় ‘উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ’। অল্প-বয়সী সৈন্যটি কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সম্ভবতঃ নিশ্চিত হলো যে আমি বাঙ্গালী নই। ‘জরুরাত নেহি, আপ যাইয়ে’ বলে সে হাত দেখিয়ে আমাকে চলে যাবার ইংগিত করলো। আরো একটু আগাতেই চোখে পড়লো কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্টের ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া দেয়াল আর জ্বালিয়ে দেয়া গুদাম। প্রায় জনশূন্য পথে এই ভাঙ্গা দেয়াল আর পোড়া গুদামের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে কেমন যেন একটা অজানা ভীতি মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। বারবার ভাবছিলাম এই কি আমার সেই পরিচিত শহর যার প্রতিটি ইটের সাথে আমার গভীর পরিচয়? হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে একে একে খানপুর, মেট্রো-সিনেমা, চারার-গোপ, কালির বাজার পার হয়ে বাস-স্ট্যান্ডে এসে ভয়টা একটু কমলো। বাসে আমরা জনা পনেরো যাত্রী। এদের মধ্যে আবার জনা পাঁচেক অবাঙ্গালী। বেলা দশটার দিকে বাস ছাড়তেই তারা বেশ খোশমেজাজে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠলো। কথার মাঝে মাঝেই তারা বাঙ্গালী ‘গাদ্দার’ আর ‘হিন্দুস্তানি হারামজাদোকো’ ‘সহিহ সবক’ শেখানোর জন্য ‘সদরে রিয়াসাত ইয়াহিয়া খান’ আর পাকিস্তানের ‘জিন্দা দিল সিপাহিদের’ প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিল। আমাদের EPRTC এর বাসের অবাঙ্গালী ড্রাইভার এবং কন্ডাক্টটার বেশ সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে বাঙ্গালী যাত্রীদের দিকে তাকাচ্ছিল। আমরা কেউ অবশ্য কোন কথা বলছিলাম না; বাসের ভেতরের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য বেশীরভাগই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম।

সোনারগাঁ থাকতেই শুনেছিলাম যে ২৮ মার্চ সকাল দশটার দিকে পাকিস্তানী সৈন্যদের একটি দল চাষাড়া এবং আরেকটি দল চানমারী দিয়ে নারায়ণগঞ্জ ঢোকার প্রচেষ্টা চালায়। দুপুর বারোটার দিকে তারা চাষাড়া দিয়ে শহরে প্রবেশ করে নিতাইগঞ্জ পুলে এসে অবস্থান নেয়। এগিয়ে চলার পথে তারা দু’পাশের বাড়ি ঘর, দোকানপাট এবং অন্যান্য সব ধরণের স্থাপনা মেশিন গান এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্রের আঘাতে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং কোন কোন জায়গায় আগুন লাগিয়ে দেয়। আমাদের বাস আরো একটু এগিয়ে যেতেই তার চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া গেল; নয়ামাটির অদূরে শহরের অতি পরিচিত রহমতুল্লাহ একাডেমী, আরো একটু দূরে দিগুবাবুর বাজার, তারপর আমলাপাড়া এবং চাষাড়া এলাকার দু’ধারের অনেকগুলো ঘর বাড়ি সে আক্রমণের শিকার। রাস্তার দু’পাশে বেশ কিছু ক্ষত-বিক্ষত এবং পোড়া ঘর বাড়ি দেখা গেল। মাসদাইর, পঞ্চবটি, ফতুল্লা, পাগলা, আলিগঞ্জ দিয়ে যাবার সময় রাস্তার দু’পাশে ২৫শে মার্চের আগে ব্যারিকেড দেবার জন্য ব্যবহৃত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাছের গুঁড়ি দেখতে পেলাম। পুরো রাস্তা মোটামুটি জনশূন্য, তবে মাঝে মাঝে দু’চারটে অস্ত্রসজ্জিত মিলিটারি জীপ চলতে দেখা গেল। পথে প্রাইভেট গাড়ীর সংখ্যা খুবই কম, কিন্তু প্রায় সবগুলো গাড়ীর নাম্বারপ্লেটই উর্দূতে লেখা। ঢাকায় উর্দূতে নাম্বারপ্লেট লেখা গাড়ী আগে কখনো দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। যাত্রাবাড়ীর কাছাকাছি আসতেই একটা ত্রিপল ঢাকা, কিন্তু পেছন দিক খোলা ট্রাকের দেখা মিললো; সে ট্রাকে বেশ কিছু হাত এবং চোখ বাঁধা তরুণ ছেলে। আমার পাশের সিটের ভদ্রলোক অন্য যাত্রীদের কান বাঁচিয়ে আমাকে ফিসফিস করে জানালেন যে গত ক’দিন ধরেই নাকি পাকিস্তানী সৈন্যরা জোয়ান বাঙ্গালী ছেলেদের এইভাবে ধরে নিয়ে খুন করে নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে। খুব ভয় পেলাম, আমার একমাত্র ছোট ভাইটিও তো এদেরই বয়সী – তাকেও এই হার্মাদরা ধরবে না তো?

প্রায় চল্লিশ মিনিটেই বাস ঢাকা গুলিস্তান বাসস্টপে এসে থামলো। এখানেও তেমন কোন ভিড় নেই। কিন্তু গভর্নর হাউসের সামনে বেশ কিছু সৈন্য দেখতে পেলাম। রিকশাও প্রায় নেই বললেই চলে। আমি শাহবাগ-গামী একটা বাসে চড়ে পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে এসে নামলাম। প্রথমেই চোখে পড়লো রমনা রেসকোর্সের উলটো দিকে গোলাগুলির আঘাতে সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত রমনা কালী মন্দির। আমাদের দীর্ঘদিনের পরিচিত ঐতিহ্যবাহী এই মন্দিরটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে মধুর ক্যান্টিন ও নিশ্চয়ই পাকিস্তানী সৈন্যরা ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু না, আমাকে অবাক করে দিয়ে ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউট ভবনের সামনে অবস্থিত “মধুর ক্যান্টিন” বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে আছে! ব্যাপারটা আসলেই অবিশ্বাস্য। পাকিস্তান আমল থেকেই মধুর ক্যান্টিন ছিলো পূর্বপাকিস্তানের বিভিন্ন প্রগতিবাদী ছাত্র আন্দোলনের অলিখিত হেড কোয়ার্টার। ১৯৪৯ এর বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন, ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-র যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী যুদ্ধ, ১৯৫৮-৬০ সালের প্রতিক্রিয়াশীল বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৬-র ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-র গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন - এ সবকিছুর সঙ্গে মধুর ক্যান্টিনের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বহু রাজনৈতিক বৈঠক এই ক্যান্টিনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক জন্ম ইতিহাসের সাথে জড়িত অনেক ঘটনার সাক্ষী এই ক্যান্টিন। পাকিস্তানী সেনাদের রোষানল থেকে এই ঐতিহ্যবাহী জায়গাটার বেঁচে যাওয়াটা অবশ্যই অলৌকিক ব্যাপার।

রেজিস্টার অফিসের সামনের মাঠে যেতেই একটা বোটকা গন্ধ নাকে এসে লাগলো। তাকিয়ে দেখি একটি অত্যন্ত হৃষ্টপুষ্ট কুকুর একটি মানুষের কবজি মুখে নিয়ে মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে দৌড়ে উত্তর-পুব দিকে পালাচ্ছে। রেজিস্টার অফিসের নীচতলায় ন্যাশনাল ব্যাংকের শাখা। আমার মত আরও কয়েকজন শিক্ষক- কর্মচারী টাকা তুলতে এসেছেন, কিন্তু ব্যাংক কর্মচারীদের স্বল্পতার জন্য টাকা তুলতে দেরী হচ্ছে। অপেক্ষা-কালীন সময়ে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নারকীয় হত্যাকাণ্ডের একটা চিত্র পাওয়া গেল।

১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাতে সমগ্র ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করা হয় ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকটি সুসজ্জিত দল ট্যাংক, ভারী মর্টার, রকেট লঞ্চার, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, হালকা মেশিনগান ইত্যাদি নিয়ে ঢাকার রাস্তায় নেমে পড়ে। তাদের কয়েকটি দল পূর্ব, দক্ষিণ এবং উত্তর দিকে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে ফেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জহরুল হক হলের স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলন পরিষদ পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম লক্ষ্য থাকায় তারা এই হলটি প্রথম আক্রমণ করে এবং প্রায় ২০০ জন ছাত্রকে হত্যা করে। রাত বারোটার পর হানাদার বাহিনীর সৈন্যরা জগন্নাথ হলে প্রবেশ করে মর্টার এবং অবিরাম গুলি চালিয়ে নির্বিচারে ছাত্রদের হত্যা করতে থাকে। তারা হলের প্রভোস্টের বাসাও আক্রমণ করে এবং হলের প্রাক্তন প্রভোস্ট উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক, দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক এবং সবার প্রিয় শিক্ষক, জি সি দেব এবং তার দত্তক মুসলিম কন্যার স্বামীকে হত্যা করে। জগন্নাথ হলের তৎকালীন প্রভোস্ট অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা মারাত্মকভাবে আহত হন এবং পরে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। এর পর পাকিস্তানি বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারীদের বাসভবনে আক্রমণ চালায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষককে হত্যা করে। পাকিস্তানী হার্মাদ বাহিনী নাকি মধুর ক্যান্টিন গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল; তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের কোন শিক্ষকের হস্তক্ষেপে মধুদার ক্যান্টিন বেঁচে যায়। কিন্তু ক্যান্টিন বাঁচলেও তার মালিক মধুদা বাঁচতে পারেননি। পাকিস্তানী সৈন্যরা তার বাসায় গিয়ে তাঁর স্ত্রী, পুত্র আর পুত্রবধূকে হত্যা করে আর তাকে তুলে নিয়ে যায় জগন্নাথ হলের মাঠে। সেখানে অধ্যাপক জি.সি. দেব এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের সাথে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে তাকে ব্রাশ-ফায়ার করে হত্যা করা হয় এবং সেখানেই গণকবরে সমাহিত করা হয়।

ব্যাংক থেকে বের হয়ে আসার সময় আমার সিনিয়র সহকর্মী আব্দুল্লাহ ভাইয়ের সাথে দেখা। তিনিও টাকা তুলতে এসেছেন। আমেরিকা থেকে ফেরার পর তার সাথে এই আমার প্রথম দেখা। আমি আজিমপুর আমার ফুপু-শ্বাশুরীর বাসায় যাব শুনে তিনি আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন এবং টাকা তোলার পর আমাকে আজিমপুর পৌঁছে দিলেন। তিনি পরামর্শ দিলেন আমি যেন টাকাটা প্যান্টের কোমরের যে জায়গাটায় আমরা বেল্ট পরি সেই মু্ড়ির ভেতরে সেলাই করে নিই। পাকিস্তানী সৈন্যরা নাকি রাস্তায় মানুষকে সার্চ করে এবং টাকা পয়সা নিয়ে নেয়। তিনি আমাকে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি নারায়ণগঞ্জে ফিরে যেতে বললেন। আব্দুল্লাহ ভাইয়ের গাড়ি চালাচ্ছিলেন তার শালা, তিনি তাকে বললেন সে যেন একঘণ্টা পর এসে আমাকে গুলিস্তান বাসস্টপে নামিয়ে দেয়। আমার চেয়ে বয়সে বেশ বড়। সে সময়কার ঢাকায় বিদ্যমান পরিস্থিতির বিবেচনায় প্রাইভেট গাড়িতে যাওয়াটাই আমার কাছে সমীচীন বলে মনে হল। আমার কাছে তখন বেশ কিছু টাকা। নিরাপত্তার জন্য এটাই সে সময় বুদ্ধিমানের কাজ ছিল।

আমার ছোট ফুপু-শ্বাশুরী আমার প্যান্টের মুড়ি খুলে সেখানে নোটগুলি ঢুকিয়ে আবার সুন্দর করে সেলাই করে দিলেন। প্রায় ঘণ্টা খানেক পরে আব্দুল্লাহ ভাইয়ের শালা এসে আমাকে নিয়ে গুলিস্তান নামিয়ে দিল। বাসে তেমন কোন যাত্রী নেই। রাস্তাও প্রায় ফাঁকা। চাষাড়া তোলারাম কলেজের বাসস্টপে এসে যখন নামলাম, তখন প্রায় তিনটা বাজে। কলেজ এখন মিলিটারি ক্যাম্প, এর আশেপাশে মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে। কিন্তু আমাদের বাড়ি যেতে এটাই সহজ পথ – সাহস করে হাঁটতে শুরু করলাম। কলেজের প্রধান গেট পার হবার সময় একজন সৈনিক জানতে চাইলো কোথা থেকে এসেছি এবং কোথায় যাচ্ছি। ঢাকা থেকে আসছি এবং নিজের বাসায় যাচ্ছি শুনে আর আটকালো না। কিন্তু বাসায় এসে শুনলাম বিকেল পাঁচটা থেকে কারফিউ শুরু হবে এবং তার আগেই আমাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে বের হয়ে সোনারগাঁয়ের পথে রওয়ানা হতে হবে। তা না’হলে আমার স্ত্রী নাসিম, দুই বোন এবং অন্যান্যরা দুশ্চিন্তা করবে। বেশীক্ষণ বসা গেলো না। বাবা-মাকে কিছু টাকা দিয়ে আমি আবার পথে নামলাম। কদম রসুল দরগাহ বাড়ির একজন প্রধান ‘খাদিম’ হয়েও আমার বাবা সবসময় ক্লিন-সেভড থাকতেন। আমার সেই বাবা এখন দাড়ি রেখেছেন। সন্তান এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মঙ্গল কামনায় তিনি এখন পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ ছাড়াও নফল এবাদত করেন। তিনি আমাকে কালিরবাজার পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে একই রিকশায় বাড়ি ফিরে গেলেন। আমি অল্প একটু হেঁটে চারার গোপ ঘাটে এসে নৌকা করে প্রথমে নবীগঞ্জ ঘাটে পৌঁছলাম। সেখান থেকে কিছু পথ হেঁটে এবং কিছু পথ রিকশায় চড়ে যখন সোনারগাঁ গিয়ে পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যে গড়িয়ে গেছে। আমার নানার বাসায় সবাই খুব চিন্তিত; পাড়ার আর যে সব লোক আমার সাথে সকালে ঢাকা গিয়েছি্লেন, তারা সবাই অনেক আগেই ফিরে এসেছেন, অথচ আমার কোন খবর নেই। চিন্তা হওয়াটাই তো অস্বাভাবিক। যাই হোক, আমি ফিরে আসায় অন্ততঃ সেদিনকার মতো সকলের মনে স্বস্তি ফিরে এলো। আমার এক বছর বয়সী অসুস্থ মেয়ে সোনিয়া আমি ফেরার পর সেই যে কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে বসে আছে তো আছেই; সে কিছুতেই কোল থেকে নামবে না। ছেড়ে দিলেই যদি বাবা আবার হারিয়ে যায়! (চলবে)



পরের পর্ব



মোহাম্মদ আবদুর রাযযাক, সিডনি





Share on Facebook               Home Page             Published on: 24-Nov-2021

Coming Events:





A day full of activities, games and fun.







Blacktown Lakemba Mascot