আমার মা – বেগম আক্রাম-উন-নেসার পূন্যস্মৃতির উদ্দেশ্য
মোহাম্মদ আবদুর রাযযাক
“মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে ।। তার মায়ায় ভরা সজল বীথি সেকি কভু হারায় সে যে জড়িয়ে আছে ছড়িয়ে আছে সন্ধ্যা রাতের তারায় সেই যে আমার মা ।। বিশ্ব ভুবন মাঝে তাহার নেই কো তুলনা।”
আজ ৪ঠা আগস্ট, ২০১৯। ঠিক তেরো বছর আগে, ২০০৬ এর এই দিনটিতে আমেরিকার মিশিগান স্টেটের ছোট শহর মিডল্যান্ডে আমাদের মেয়ে সোনিয়ার বাসায় বসে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ আমার মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেলাম। স্থানীয় সময় তখন দুপুর সাড়ে বারোটা। সিডনী থেকে আমার ছোট বোন লিপি টেলিফোনে জানাল আমাদের সর্বংসহা জননী বেগম আকরাম-উন-নেসা (১৯১৮ – ২০০৬) পনেরো মিনিট আগে, বাংলাদেশ সময় রাত সোয়া দশটায় আমাদের মেজবোন চায়নার ধানমন্ডির বাসায় তারই কোলে মাথা রেখে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে গেছেন - চলে গেছেন না ফেরার দেশে (ইন্না লিল্লাহি অয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। আর কোনদিন টেলিফোনে তাঁর নরম অনুচ্চ কণ্ঠে তিনি জানতে চাইবেন না ‘ঢাকায় কবে আসবি বাবা?’ আর তার কণ্ঠে ধ্বনিত হবেনা ‘সাবধানে থাকিস বাবা।’
মৃত্যুকালে আমার মায়ের বয়স হয়েছিল ৮৮ বৎসর। অনেক দিন ধরেই তিনি উচ্চ-রক্তচাপ, বহুমূত্র এবং বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন; তবে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে যাননি। মার্চ মাসের শুরুতেও মা ভাগাভাগি করে নারায়ণগঞ্জে আমাদের পৈত্রিক বাসা এবং আমার বড়বোন ফরিদার বাসাতেই ছিলেন; তিনি হাঁটাচলা করতে পারতেন এবং তার নিজের বেশীর ভাগ কাজ নিজেই করতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু এপ্রিলের শুরু থেকে তাঁর শরীর হঠাৎ করেই খারাপ হতে শুরু করলে তাকে ঢাকায় আমাদের মেজবোন চায়নার বাসায় নিয়ে আসা হয়। মে মাসের শেষদিকে অতিদ্রুত তাঁর অবস্থার অবনতি ঘটায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দশই জুন থেকে চব্বিশে জুন পর্যন্ত আমি মায়ের সাথে ঢাকায় ছিলাম। তখন তিনি স্মৃতিভ্রংশতায় ভুগছিলেন - আমকে চিনতে পারলেও তিনি কথা বলতে চাচ্ছিলেন না। তিনি তখন স্বাভাবিক ভাবে খেতে পারতেন না বলে তাকে টিউব দিয়ে খাওয়াতে হতো। নাকে টিউব নিয়ে কেমন যেন একটা শূন্য, মন উদাস করা চাহনি নিয়ে তিনি জানালা দিয়ে আকাশ দেখতেন। ডাক্তারদের মতে মায়ের জন্য আর কিছু করা ছিল না। জুলাই মাসের শুরুতেই আমার আবার আমেরিকার নিউ জার্সির রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগ দেবার কথা; তাই বাধ্য হয়ে ঢাকা থেকে চলে আসতে হল। আসার সময় নিশ্চিত জানতাম সহসাই একদিন মায়ের মৃত্যু-সংবাদ আসবে। কবিগুরু লিখেছিলেন, “জীবনেরে কে রাখিতে পারে? আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে; তার নিমন্ত্রণ লোকে লোকে - নব নব পূর্বাচলে আলোকে আলোকে।” জানতাম মা’য়ের অনন্ত যাত্রার নিমন্ত্রণ এসে গেছে - আর সে জন্য নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত ও করেছিলাম। সত্যি বলতে কি ঢাকা থেকে মাকে দেখে ফিরে আসার পর প্রতি ওয়াক্তে নামাজে দাঁড়িয়ে আমি আল্লাহতায়ালার কাছে প্রার্থনা করেছি তিনি যেন মাকে তার এই দুঃসহ জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেন। কিন্তু যখন মা মুক্তি পেলেন, সে সংবাদ কিন্তু আমার কাছে জীবনের এক চরমতম দুঃসংবাদ হয়েই এলো। সেই সংবাদকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারার যে বিশ্বাস বা প্রস্তুতি আমার আছে বলে ভাবতাম তার রেশমাত্র আমি আর খুঁজে পেলাম না। অবিরল ধারে ঝরতে থাকা চোখের জলে ঝাপসা হয়ে আসা দৃষ্টিতে আমি আমার মায়ের অন্তিম যাত্রা দেখতে পেলাম। মোটামুটি ভাবে ছোটখাটো আকৃতির মা নামের যে সর্বংসহা মহিলাটি আমার এই ষাট বছরের (২০০৬ এর বয়েস) জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের সাথী এবং মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী ছিলেন, তার বড় সন্তান হয়েও আমি তার শব-বাহী খাটে কাঁধ দিতে পারলাম না! আমার এ দুঃখ আমি কোথায় রাখি। তার মৃত্যুর প্রায় দুই যুগ পরেও যখনই এই না পারার কথা মনে হয়, বলতে কোন দ্বিধা নেই একটা অব্যক্ত বেদনা মনকে কেমন যেন কুরে কুরে খায়। সর্বক্ষণ কেমন যেন একটা অপরাধ বোধ আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। বারবার মনে হয় মা’র কাছ থেকে সারা জীবন কেবল দু’হাত ভরে নিয়েই গিয়েছি, কিন্তু ছেলে হিসেবে মায়ের প্রতি আমার যে কর্তব্য ছিল আমি তা পালন করিনি।
এ কথা সত্যি যে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে আসতে না পারলে আমাদের অভাব অনটনে জর্জরিত রুগ্ন বাবা, মা, তিন ভাই-বোন এবং স্ত্রী-সন্তান সহ সাতজন মানুষের পরিবারটিকে বাঁচানো কোনভাবেই আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। কিন্তু তারপরও তো প্রায় তিন দশক কেটে গেছে - ভাই বোনেরা যে যার মত নিজেদের সংসারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আমার নিজের মেয়ের ও বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলে পড়াশোনা শেষ করে চাকুরীতে যোগ দিয়েছে। মোটামুটিভাবে আর্থিক অনটন দূর হয়েছে - কিন্তু তারপরও তো আমি আমার নিঃসঙ্গ মায়ের কাছে ফিরে যাই নি। তবে ১৯৮৮ সালে আমার একমাত্র ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহিম মারা যাবার পর থেকে মা যখন তাঁর নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে একা থেকেছেন তখন আমি মা’কে আমার দেশে ফিরে যাবার ইচ্ছের কথা জানিয়েছি; কিন্তু তিনি তাতে সায় দেননি; বলেছেন ‘দেশে এসে থাকতে পারবি না বাবা’। আইন শৃঙ্খলা বিহীন, নৈতিকতা বিবর্জিত, দূর্নীতিগ্রস্ত বাংলাদেশে আমি ফিরে যাই, সেটা মা কোনদিন চাননি। কিন্তু সত্যি কি সেটা আমার মায়ের মনের কথা ছিল? মা তো আমার কাছে সিঙ্গাপুরে বেড়াতে এসেছেন এবং আমাদের সাথে পাঁচ-ছয় সপ্তাহ সময় কাটিয়ে গেছেন; তাকে তো সে সময় খুব আনন্দিতই মনে হয়েছে। আমি যদি সত্যি তাঁর কথা না মেনে সে সময় বাংলাদেশে ফিরে যেতাম, তিনি কি খুব অখুশি হতেন? আজকে, মায়ের চতুর্দশ মৃত্যুবার্ষিকীতে, যখন তিনি অনন্তলোকের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছেন, তখন আমি, তার প্রবাসী সন্তান অলস দুপুর বা ঘুমহীন রাতে এই সব বহু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াই।
আমার মা জন্মেছিলেন ১৯১৮ সালে এক অত্যন্ত ধার্মিক কিন্তু অসাম্প্রদায়িক এবং সময়ের তুলনায় এক প্রগতিশীল পরিবারে। একজন ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষাটা পেয়েছিলেন তিনি তাঁর পরিবার থেকেই। সম্ভবতঃ অজ পাড়াগাঁয়ে জন্মাবার কারণে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রাইমারী স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর বেশী আগায়নি, কিন্তু নিজের চেষ্টা এবং ঐকান্তিক আগ্রহে তিনি নিজেকে স্বশিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুলেন। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেওবন্দে পড়াশুনা করা আমার নানাজানের দ্বিতীয় সন্তান আমার মা বাংলা ভাষা ছাড়াও উর্দু এবং ফারসি পড়তে শেখেন। আর মৌলবি সাহেবের মেয়ে হিসেবে আরবি না বুঝলেও খুব সুন্দরভাবে নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করতে শেখেন। বিশ-শতকের ঠিক যে সময়টাতে আমার মায়ের জন্ম, সে সময়ের মানদণ্ডে চিন্তা ও চেতনায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত অগ্রসর, নিরহংকারী এবং সমাজ সচেতন। তাঁর ভাবনা, স্বপ্ন এবং জীবনবোধ ছিল একেবারেই ভিন্ন রকম; আর তাঁর আচরণ ছিল খুবই সাধারণ এবং সহজ সরল। চারপাশের মানুষদেরকে ভালোবেসে, তাদের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনাকে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলাই ছিল তার লক্ষ্য আর সারা জীবন সেই লক্ষ্য থেকে তিনি এতটুকু বিচ্যুত হননি। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার একমাত্র ছোটভাইকে তিনি ‘ফি আমানিল্লাহ’ বলে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে ঢাকা বা তার আশে-পাশে রাতের আঁধারে গেরিলা হামলা চালানোর জন্য মেলাঘর ক্যাম্প থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সাহায্য করার জন্য তিনি নিজের গহনা তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন।
আমার মা একজন সাহিত্যপ্রেমী এবং সাহিত্যসেবী মানুষ ছিলেন। তার লেখা বেশ কিছু কবিতা তৎকালীন বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক কাগজ ‘বেগম’ এবং অন্যান্য স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তাঁর দুটি কবিতার বই (ঝরনা ধারা; চেতনায় নয় মাস) এবং দুটি ছোট গল্পের বই (পথের শেষের ছায়া; স্মৃতির মেঘে বৃষ্টি নামে) ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছে। তার জীবনের অনেকটা জুড়েই ছিল কবিতা; তার নিজের কথায় ‘অলস মস্তিষ্কে কবিতার শব্দেরা করে ঘোরাঘুরি ..’। জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে তিনি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলেন আর সে প্রস্তুতির কথা তিনি নানাভাবে লিখে গেছেন। যেমন তার ঝরনাধারা কাব্যগ্রন্থের ঘুমন্ত অতীত কবিতায় তিনি লিখেছেন ‘এসো সুপ্তি, এসো শান্তি বিস্মৃতির অমিয় জগতে / অঘোরে ঘুমাবো আমি বিস্মৃত শয়ানে’ আবার তেমনি তুলে নিবে রথে কবিতায় তিনি লিখেছেন ‘সোনার দিবস শেষ হল যে সূর্যি ডোবে ডোবে। বসে আছি তারই আশে আসিবে সে কবে।’
যে বয়সটা থেকে মানুষের মন, মনন, চিন্তা এবং বোধের বিকাশ ঘটতে থাকে তখন থেকেই আমার মা আমার এবং আমার অন্যান্য ভাই-বোনদের মনের ভিতর নানা বৈচিত্র্যময় স্বপ্ন বুননের চেষ্টা করে গেছেন। সাহিত্যিক হাফিজ, রুমি, মির্জা গালিব এবং ইকবাল থেকেও তিনি মাঝে মাঝে আমাকে শের-শায়েরী শোনাতেন। গ্রীষ্মের অলস মধ্যাহ্ন, বর্ষণমুখর আষাঢ় সন্ধ্যা, জ্যোৎস্না-স্নাত শারদীয় রাত, হেমন্তের হিমানী সকাল, শীতের বিশীর্ণ দিন, কিংবা বাসন্তী গোধূলি - সব সময়ই আমার মা গুন গুন সুর করে বিভিন্ন স্বাদের কবিতা আওড়াতেন। আজ এক যুগের ও বেশী সময় ধরেই আমি জানি, আমার সে কবিতা পাগল মা আর কোনদিনও জেগে উঠবেন না। আর তাই তার অত্যন্ত পছন্দের একটি কবিতার কয়েকটি পঙক্তিমালার মাধ্যমে তাঁকে আমার প্রিয় মা’কে আমি সশ্রদ্ধ প্রণাম এবং ভালোবাসা জানাইঃ “শোকে দুঃখে লাঞ্ছনায় বন্ধুর জীবনে, তোমার অমৃত দৃষ্টি স্নেহের সিঞ্চনে বিকশিত কর বারংবার - হে জননী, তব শুভ্র কমল-চরণে লহো দীন সন্তানের, দীন নমস্কার”
পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার কাছে আমার একান্ত প্রার্থনা “এয় খোদা দয়াময়, আমার মায়ের কবরে যেন গো বেহেশত নাজিল হয়।” আল্লাহতায়ালা যেন অসীম মমতায় আমার মায়ের আত্মার শান্তি বিধান করেন এবং তাকে জান্নাতবাসী করেন।
 মোহাম্মদ আবদুর রাযযাক, সিডনি
|