আবহমান বাংলার লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি (সংকলিত) ড. রতন কুন্ডু
(উত্তর আমেরিকা সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত - বহির্বিশ্ব তৃতীয়বিশ্ব বাংলা সাহিত্য সমাবেশ ২০২১ এ পঠিত)
পুর্বকথাঃ বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত জনপদে আমার জন্ম। আমার কাঁথা মুড়ি ছেলেবেলা শীতের সকাল। ঢোল, করতাল আর কাশর বাদ্যের ঢং ঢং শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়া। সবাই মন্দিরের সামনে নাম সংকৃতন শুরু করেছে। কিচ্ছুক্ষণ বাদেই পাড়ায় পাড়ায় নাম সংকৃতন হবে। বাতাসা, নকুল দানা আর খেজুরের রসের পাটালি গুড় প্রসাদ। সাত সকালেই স্নান করে রাধেশ্যামদা মন্দিরে গীতা পাঠ শুরু করেছে - সর্ব ধর্মান পরিত্যাজ্য মামেকং স্মরনং ব্রজ অহং তাং সর্বপাপেভ্য মোক্ষইস্বামী মা সুচ।
ওদিকে জ্যাঠাতো বোন সন্ধ্যা মাটির তৈরি বারুণী বিদায় করছে নদীর জলে - “আজ যাও বারুণী কালকে আইও, বচ্ছরে বচ্ছরে পূজা খাইয়া যাইও। আম কাঁঠালের পিড়িখানি গঙ্গা জলে ভাসে, আমার ভাই পরিমল সেই পিড়িতে বসে।”
বিজুদি কাল বিকেলের তারার ব্রতের আলপনায় ছড়ানো গাঁদা ফুলের পাপড়ি কাশফুলের ঝাড়ু দিয়ে তুলে নিচ্ছে পরম মমতায়- “ষোলো ষোলো তাড়াল তোমরা হলে সত্য, ঘি দিয়ে করবো মোরা পঞ্চ ব্রত। নিত্য আসি নিত্য বাসি নিত্য করি বাস, মনের বাসনা করবে পূরণ আমার শ্রীনিবাস।”
আর দুপুরের খাবার শেষ না হতেই দালানের দাওয়ায় হোগলা পেতে গীতা পিসি বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল সুর করে পড়ছে - চান্দ সওদাগর আর বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনী- “সিথান হইতে কালিয়া নগরে ও নাগ পৈথানেতে যায়, আচম্বিতে মারলরে ঠোকর লখিন্দরের পায়।”
পড়ন্ত বেলায় বাবা রামায়ণ থেকে -লক্ষণের শক্তিশেল, সীতার বনবাস কিংবা মহাভারত থেকে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ পাঠ করছে ছন্দে ছন্দে-
“মহা ভারতের কথা অমৃত সমান কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।”
বাড়ির পুরুষ মহিলারা চারিদিকে গোল হয়ে বসে বসে এ আখ্যান শোনে। রাতে মা তাঁর কীর্তনের পালা, নিমাই সন্ন্যাসের পালা কিংবা রাধা-শ্যাম বিচ্ছেদ গাইতে বসলে পাড়া প্রতিবেশী মেয়ে বৌরা ভিড় জমায়-
“আইজ ক্যানে গো নিধু বনে রাধা কৃষ্ণ একাসনে ! পালঙ্কেতে শুয়ে নিদ্রা যায়”
এ হলো আমার সংস্কৃতির প্রথম স্মৃতি যা কিনা আজও অমলিন।
হাজার হাজার বছর ধরে এই গাঙ্গেয় অববাহিকায় আবহমান বাংলায় প্রতিটি সামাজিক এমনকি পারিবারিক কর্মকাণ্ডেও নাট্য, গীত, বাদ্য, বাচিক সহ অন্যান্য কলা পরিবেশিত হতো। এর কোনটি ধর্মীয় আবার কোনটি সামাজিক অনুষ্ঠানের মোড়কে পরিবেশিত হতো আর এই অনুষ্ঠানগুলো সহ নবান্ন, মেলা, বিবাহ, খৎনা, অন্নপ্রাশন কিংবা অন্যান্য পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলো হতো ফসল তোলার মৌসুমে। কারণ ওই সময় সব পরিবারেই কম বেশি প্রাচুর্য থাকে। তবে সব আয়োজনের লক্ষ ছিলো বিনোদন। এই বিনোদনের মৌসুম শুধুমাত্র এই উপমহাদেশেই নয়, ইউরোপ, আফ্রিকা ও ক্যারিবীয় দেশগুলোতেও উজ্জাপিত হতো। হাজার হাজার বছর পূর্বে নির্মিত মিসরীয় পিরামিডের মধ্যে মমির কফিনেও অনেক নাটকের স্ক্রিপ্ট পাওয়া গেছে। গ্রিক নাটকের পুরোধা এরিস্টোফেনিস, ইস্কাইলাস, সফোক্লিসরা খৃষ্টের জন্মের পাঁচ থেকে ছ’শো বছর আগে ওডিসি, ইডিপাস কিংবা উইল্ডারনেস রচনা করেছিলেন।
প্রাচীন বাংলায় বহুকাল যাবত অঞ্চল ভিত্তিক হাস্তর, গাজীর গীত, গম্ভীরা, কবিগান, হাপুগান, জারিগান, সারিগান, কীর্তন ও যাত্রাপালা পরিবেশিত হতো। আরেকটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি ছিলো মঙ্গলকাব্য, যার চর্চা আর নেই বললেই চলে। মঙ্গলকাব্য ধারায় মাটির মঞ্চে চারণ কবি দ্বারা গীত হতো। মঙ্গলকাব্যের মধ্যে অন্নদামঙ্গল, মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, গোবিন্দমঙ্গল, মৎসমঙ্গল, শস্যমঙ্গল ও সরোবরমঙ্গল অন্য়তম। পাশাপাশি পৌরাণিক কাহিনী ও মিথ দ্বারা রচিত বা চারণ দ্বারা গীত পালা সমূহ- শিবপুরাণ, কালিকাপুরাণ, বিষ্ণপুরাণ, ব্রক্ষ্মপুরাণ, লক্ষ্মী পাঁচালী, সরস্বতী পাঁচালী।
পরবর্তীকালে আমরা প্রত্যক্ষ করি আমাদের এই ভূখণ্ডে উপরে উল্লিখিত নানান সূত্রের আদলে এবং সুফিবাদের পদার্পণের আঙ্গিকতায় মিশ্রিত শিল্পধারা পথ থেকে পথে, প্রান্তর থেকে প্রান্তরে ব্যাপ্তি লাভ করেছিলো। গ্রাম সমাজ-গৃহের আলোক বর্তিকায় লক্ষ্মীন্দরের হাস্তর, আসমানসিং যাত্রা, ঈমানযাত্রা, কৃষ্ণলীলা, নৌকাবিলাস, কবিগান, পুতুলনাচ, ষষ্ঠিরগান, ঘোড়া-নাচন, গোরনাথ, কাজলরেখা, গাজিরগান, নারীধামালী, ঘেটুযাত্রা, শিবের-গাজন, ইসমাইলের কোরবানির জারি, শিব গৌরির পালাসমূহ অন্য়তম। পরবর্তীকালে যাত্রার নানা আদল আমরা প্রত্যক্ষ করি নাম ও প্রায়োগিক ঢঙে ভিন্নতা। যেমন লেবেলযাত্রা, ঝুমুরযাত্রা, ঘেটুযাত্রা, খৈলান যাত্রা-র এই পালাসমূহ প্রত্যক্ষ করি। পালাসমূহের মধ্যে, আমেনা বিবির পালা, বেদেনীর পালা, রাখাল-বন্ধু, মহুয়া, আলোমতি, প্রেমকুমার, বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না, ভেলুয়াসুন্দরী, আমিন সাধু, নছিমন, পরিবানুর পালা, পাতালপুরীর রাজকন্যা-সহ নানা নামের পালাও প্রত্যক্ষ করি।
ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস ও কাল্পনিক ইতিহাস সমন্বয়ে লিখিত পালাসমূহও আমাদের সামনে আসতে থাকে- যেমন: শাহজাহান, টিপু সুলতান, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, মীর কাশেম, বাঁশের-কেল্লা, সাধক রামপ্রসাদ, লালন ফরিক, কোহিনুর-সহ নানা পালাসমূহ। সামাজিক নানা সমস্যা নিয়ে যাত্রাপালাও আমাদের সামনে হাজির হয়। যেমন: একটি পয়সা, নিহত গোলাপ, রক্তের বাধন, মাটির মানুষ, গলি থেকে রাজপথ, অশ্রু দিয়ে লেখা, সমাজের বলি, রক্তে রোয়া ধান। উপরোক্ত পালাসমূহ ছাড়াও গান নির্ভর বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতো- কীর্তন, কবি পাঁচালী, কালি কীর্তন, নৌকা বাইচের গান, রয়ানী, গাজীর গান, ভাদু, টুসু, চটকা, মুর্শিদী, ছাঁদ পিটানো গান, ভাওয়াইয়া, নবীর গান, সাঁওতালী গান, মাইজভাণ্ডারী, মারফতি, ঝুমুর বিয়ের গান, মিছিল যাত্রা, গজল, গম্ভীরা, গৌরগীত, বিচ্ছেদ, নীলের-গান, রাখালিয়া, দেহতত্ত্ব গুরুভজন, ঘেটুরগান, ঢাকেরগান, মাদার গান ইত্য়াদি অন্য়তম। বিভিন্ন মঞ্চ ছাড়াও বার মাসের তের পার্বণের এই দেশে বিভিন্ন মেলা হত, সেই মেলায় এই পালা গানসমূহ পরিবেশিত হতো। মেলাসমূহ- পৌষ পার্বণের মেলা, গঙ্গাস্নানের মেলা, মহরমের মেলা, বৈশাখী মেলা, শ্রাবণ সংক্রান্তির মেলা, চৈত্র সংক্রান্তির মেলা, চরকের মেলা, মহাদেবের মেলা, বাটুদার মেলা, গাজী পীরের মেলা। উপরোক্ত ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যসমূহের ধারার পাশাপাশি বাঙালি জীবনের নানা লোকাচারের আয়োজনে চলতে থাকে ৷ বট পাইকুড়ের বিয়ে, হাজরা নৃত্য, নবান্ন উৎসব, পৌষ পার্বণ মেলা, বলিখেলা, অন্নদা মঙ্গলিক, এই ধারায় নৃত্য-ছন্দে গীত ও বর্ণনে নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ বাঙালির মানসপট।
ড. রতন কুন্ডু, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|