সদ্য প্রয়াত ব্রিটেনের রানীর সাথে কিছু দুর্লভ মুহূর্ত ড. রতন কুন্ডু
আমার একজন প্রিয়জন কাল এ পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়ে পরপারে চলে গেলেন। হ্যাঁ আমি ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এর কথা বলছি। আজ থেকে বত্রিশ বছর আগেকার কথা। সাল ১৯৯০ খৃষ্টাব্দ। তার সাথে আমার দুর্লভ সাক্ষাত হয়েছিলো ডিউক অফ এডিনবারার হিল-সাইড টেরাসের গার্ডেন পার্টিতে। সে কাহিনিতে যাওয়ার আগে একটু ভূমিকা না দিলে কথিকাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমরা শুধু জানি তিনি ব্রিটেনের রাণী। আসলে তিনি কমনওয়েলথ ভুক্ত দেশগুলোর সাংবিধানিক প্রধান। তারই ধারাবাহিকতায় কমনওয়েলথ ফান্ড থেকে কমনওয়েলথভুক্ত দেশের মেধাবী ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার জন্য প্রতিবছর শত শত বৃত্তি প্রদান করা হয়ে থাকে। তেমনি একটি বৃত্তি নিয়ে ১৯৮৯ সালে আমি এডিনবারা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর কোর্সে গবেষণার সুযোগ পাই। চূড়ান্ত ফলাফলে আমি ডিস্টিংশন সহ প্রথম স্থান অধিকারে সক্ষম হই। সুবাদে বিবিসি টেলিভিশন আমার ও আমার শিক্ষক প্রোফেসর জি আর স্কটের একটি তিন মিনিট সাঁইত্রিশ সেকেন্ডের একটি সাক্ষাতকার সম্প্রচার করে। আমি ব্রিটিশ কাউন্সিল স্কলার হিসেবে তৎকালীন সরকারের একটি গৃহীত পদক্ষেপের বিরোধিতা করে মহামান্য রানীর কাছে একটি পত্র দিয়েছিলাম। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, গ্লাসগো ও ব্রিস্টল রয়্যাল কলেজ অব ভেটেরিনারি সায়েন্স বন্ধ করে দেবে। তাতে করে আমাদের বাংলাদেশী মেধাবী ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ কিছুটা সীমিত হবার শঙ্কা কাজ করেছে। সেই অনুভব থেকেই লিখা। কিছুদিন পরে আমাকে অবাক করে বাকিংহাম প্যালেসের রাজকীয় প্যাডে রানী স্বাক্ষরিত একটি পত্র আমার পিজিওন হোলে উকি দিলো। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। তিনি ধন্যবাদ জানিয়ে লিখেছেন তিনিও এই সরকারী সিদ্ধান্তে উৎকণ্ঠিত এবং এটি রিভিউ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী বরাবরে লিখেছেন। আমি জানতাম না ঐ চিঠিতে আমার জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছে! তিনি আমাকে ডিউক অব এডিনবরার গার্ডেন পার্টিতে নিমন্ত্রণ করেছেন। সাথে একটি ড্রেস কোড, কোড অফ কন্ডাক্ট, হাউস কিপিং ও অন্যান্য নিয়মাবলী সংযুক্ত ছিলো। আমি পরদিনই আমার কোর্স অরগানাইজার ড. আর্চি হান্টারকে জানালাম। তিনিও বিস্ময়ে থ হয়ে গেলেন। তিনি বললেন এ সুযোগ তুমি আর কোনোদিন পাবেনা! এটি মিস করোনা। আমি ড্রেস কোডের ইংগিত করাতে তিনি ব্যাপারটি বুঝলেন। স্কলারশিপের পয়সায় বৌ-মেয়ে নিয়ে সংসারে কিছু উদ্বৃত্ত থাকা কষ্টকর! তিনি বললেন তোমাকে কয়েকশো পাউন্ড খরচ করে রয়্যাল পার্টি ড্রেস বানাতে হবেনা। মার্কস এন্ড স্পেনসার ড্রেস ভাড়া দেয়। ৫০ থেকে ৮০ পাউন্ডের মধ্যে পেয়ে যাবে। সাধও আছে মনও পোড়ে। কি করি কি করি! সিদ্ধান্ত নিলাম ভাড়া পোশাক পরেই যাবো। মার্কস এন্ড স্পেনসারে গিয়ে দেখি সব বড় বড় সাইজ। আমার সাইজ নেই। লোভ ব্যাকরণ মানেনা। নিয়ে নিলাম মোটামুটি চলন সই একটি সেট। কিন্তু বো টাই লুজ ছিলো। কি আর করা! ওগুলো পড়েই লোথিয়ান কাউন্সিলের দোতলা বাসে চড়ে হিল-সাইড নেমে হেটে হেটে ডিউকের বাড়ি অব্দি। হাতে রাজকীয় এমব্রোস প্যাডে নিমন্ত্রণ পত্র।
হিল-সাইড রাজপ্রাসাদটিকে চতুর্দিকে পাহার বেষ্টিত একটি যক্ষপুরীর মতো মনে হচ্ছিলো। প্রাসাদটি দেখে তাৎক্ষণিক ভাবে আমার ঢাকার কার্জন হল ও চামেরী হাউজের ছবি ভেসে উঠলো মানস-পটে। আমার বিসিএস এর ভাইভা পরীক্ষা হয়েছিলো ঢাকার সেগুন বাগিচার চামেরী হাউজে।ব্রিটিশদের তৈরি সবগুলো স্থাপনার মধ্যে একটি পুরনো ঐতিহ্য, বিশেষ ডিজাইন ও নির্মাণশৈলী আছে। সব প্রাসাদের গাঁথুনি বড় বড় পাথর দিয়ে। রাস্তা ঘাটের বিছানাও পাথরের। প্রাসাদের সিংহ দরোজায় লম্বা কাফেলায় নিজেকে সামিল করলাম। পার্কিং লটে সার বেঁধে লিমোজিন, রোলস রয়েস ও অন্যান্য দামী দামী গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। খুব ইচ্ছে হয়েছিলো রোলস রয়েসের সাথে একটি ফটো তোলার জন্য। বিধি নিষেধের কারণে সে ইচ্ছের অপমৃত্যু মেনে নিতে হয়েছে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের একটি প্লাটুন নিরাপত্তার দায়িত্বে। বুকটা অজানা আতঙ্কে দুরু দুরু করতে লাগলো। সিকিউরিটি চেকে আমার পকেটের লাইটার বিসর্জন দিতে হলো। ভাগ্যিস নির্দেশনা মেনে আমার বিয়ের একমাত্র যৌতুক- ইয়াশিকা ইলেকট্রো ৩৫ বাসায় রেখে এসেছিলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল। সব ধূমপায়ীদের যেমন হয়। সার বেঁধে সব অতিথি যক্ষপুরীর অন্দর মহলে চলছে। আরেকটি সিংহ দরোজায় একজন পুরুষ ও একজন মহিলা সবাইকে ওয়েলকাম করছে। পরে জেনেছি তাঁদের একজন ছিলেন প্রিন্স এন্ড্রু এবং অন্যজন প্রিন্সেস এ্যান। প্রাসাদ গুলোর মাঝের চাতাল ঘাসে ছেয়ে আছে, হরেক রকম ফুলের বাগান, ছোট ছোট জাকারান্ডা, বড় বড় ইউক্যালিপটাস, সেঞ্চুরি প্লান্ট আর লতাগুল্ম দিয়ে সাজানো। প্রতিটি ঝোপে, প্রাসাদের দেয়ালে নিওনের মিটি মিটি চাহনি। পাখীরা কিচির মিচির করে এ ডাল ওডাল করছে।ঠিক রূপকথার গল্পের মতো।
একজন গাইড আমাদের নিয়ে গেলেন যক্ষপুরীর একটি কক্ষে। আমাদের দলে আনুমানিক ৩০-৪০ জন অতিথি ছিলেন। সর্ব স্তরের মানুষকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। বিদেশী ডিপ্লোম্যাট, দেশী প্রতিরক্ষা বাহীনির সদস্য, সরকারের প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, পেনশনার, ছাত্র সহ পেশাজীবীদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো। প্রতি বছরই দেশের বিভিন্ন রাজকীয় প্রাসাদে এই গার্ডেন পার্টির আয়োজন হয়। যাই হোক সেই বিশাল হল রুমে ঢুকতেই একটি অশরীরী অনুভব আচ্ছন্ন করলো। প্রকাণ্ড হলরুমে ধুপছায়া খেলা করে। মাথার উপরে সার সার প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ঝালর, রঙিন ক্রিস্টাল গবাক্ষ পথে নানান রঙের আলোর বিচ্ছুরণ। যেমনটি দেখেছিলাম এডিনবারা দুর্গে। দেয়ালে ঢাউস সাইজের সার সার ছবি সাঁটানো। গাইড পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন- এইটি রানী ভিক্টোরিয়ার এতো সালের ছবি। এইটা পঞ্চম জর্জ, এইটা সপ্তম এডওয়ার্ড ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার স্মৃতিতে ব্রিটিশ ভারতে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অত্যাচার আর তার প্রতিরোধে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা, মাওলানা মহম্মদ আলী, শওকত আলীর অসহযোগ আন্দোলন, গান্ধীজীর স্বদেশী আন্দোলন স্মৃতিপটে ভেসে উঠলো। মনকে সংযত করে বাইরে বাগানে চলে এলাম।
বাইরে স্কটিশ অর্কেস্ট্রা ব্যাগ-পাইপ বাজানো শুরু করলো। রাজকীয় উর্দি পরা নাইটরা মাথায় স্ট্রাইপের টুপি পরে ট্রেতে করে রঙিন পানি বিতরণ করছে। আমার কাছে আসতে আমিও সবার মতো একটি তুলে নিলাম। বোতলের গায়ে লিখা ড্রাই মার্টিনী। আমি চুমুক দিলাম। পাশের এক অতিথি বললেন আগে রানীমাকে উইশ করো। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই তিনি গ্লাস উঁচিয়ে বললেন- চিয়ার্স, উই ড্রিংক ফর দ্য গুড হেলথ অব হার মেজেস্টি কুইন এলিজাবেথ ২। গলা ঠেলে একটা হেঁচকি বেড়িয়ে এলো। ইতোমধ্যে আরেকজন এলো প্রন ফিংগার ফুড নিয়ে। কয়েকটি পিক করে নিলাম। মেয়টি মুচকি হাসল। প্রন আমারো ফেভারিট! আমি বো করলাম। এভাবে পানাহার চললো বেশ কিছুক্ষণ। হঠাৎ বিউগল বেজে উঠলো। দক্ষিণ প্রাসাদের দেয়াল, জানালা, গবাক্ষ বেয়ে আলোর ঝর্ণাধারা নেমে এলো। ওয়াইন গ্লাসে কেউ চামচ দিয়ে তিনবার টিংটিং শব্দ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। এটেনশন লেডিস এন্ড জেন্টেলমেন- হার মেজেস্টি দি কুইন এলিজাবেথ টু এন্ড হিজ মেজেস্টি দ্য ডিউক অব এডিনবারা কিং ফিলিপ গোয়িং টু জয়েন আস শর্টলি। রাজ প্রাসাদের একটি দরোজা খুলে গেলো। নাইটরা গার্ড অফ অনার দিলো, প্রশিক্ষিত অশ্বগুলো লেফট রাইট করতে করতে বো করে চিঁহি চিঁহি শব্দ করতে লাগলো। তার মাঝ খান দিয়ে রাজ দম্পতি, তাঁদের পরিবারের সবাই জনারণ্যের মাঝখানে চলে এলেন। তাঁদের ঠিক পেছনেই প্রিন্স ও প্রিন্সেস অব ওয়েলস- প্রিন্স চার্লস ও প্রিন্সেস ডায়ানা। তার পেছনেই দ্য ডিউক অব ইয়র্ক- প্রিন্স এন্ড্রু ও ডাচেস অব ইয়র্ক- প্রিন্সেস সারাহ ফারগুসন। এর পরপরই আছেন তাঁদের একমাত্র কন্যা- দ্য রয়েল প্রিন্সেস রাজকুমারী এ্যান ও কনিষ্ঠ সন্তান, দ্য আর্ল অব ওয়েসেক্স- প্রিন্স এডয়ার্ড। আরো আছেন নাতী নাতনী সহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজন। মহামান্য ডিউক সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য রাখার পরে হার মেজেস্টি , স্বাগত জানান। তাঁরা একত্রে সবার সুখ ও শান্তি কামনা করে টোষ্ট করেন। তাঁরা ঘুরে ঘুরে সব গ্রুপের কাছে গিয়ে কুশলাদি বিনিময় করেন। পুরো সময় জুড়ে হাল্কা ধ্রুপদী মিউজিক বাজতে থাকে। একটি চমৎকার অনুভবের বিকেল নিয়ে সিংহ দরোজার বাইরে পা রাখতেই মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো। তাল সামলাতে না পেরে একটি পাথরের সাথে ধাক্কা খেলাম। বা হাত দিয়ে পতন সামলাতে গিয়ে হাতটা মচকে গেল। একজন নাইট দৌড়ে এলেন- আর য়ু অলরাইট? আমি তার দিকে করুন চোখে তাকাতেই সব বুঝতে পারলেন। একটি ট্যাক্সি ডেকে দিলেন। আমি ঘোরের মাঝেই হে মার্কেট এলাকায় ক্যালিডোনিয়ান প্লেসে সাবলেট এপার্টমেন্টে নিজের বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।
গ্রানভিল ৯ ই সেপ্টেম্বর ২০২২
ড. রতন কুন্ডু, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|