প্ল্যানচেট ড. রতন কুন্ডু
(একটি স্মৃতিচারণ মূলক আখ্যান)
ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদের কুল ঘেঁষে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যারাই পড়াশুনা, অধ্যাপনা কিংবা চাকুরীর সুযোগ পেয়েছে তাঁরা অত্যন্ত ভাগ্যবান। ক্যাম্পাসের মাটির সোঁদা গন্ধ, ব্রহ্মপুত্রের কুল ঘেঁষে কাশবন, ইউক্যালিপটাস বাগানের ঝিরিঝিরি হাওয়া আর নদীর কুলুকুলু শব্দে আমাদের জীবন গাঁথা হয়েছিলো।
ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক ছিলো ত্রিমাত্রিক। ড. হাফিজ ইংল্যান্ডের লিভারপুল থেকে সদ্য ডক্টরেট সম্পন্ন করে এসেছেন। মনসুরুল আমিন স্যার এর আগেই ইংল্যান্ড থেকে পি এইচ ডি করে ফিরেছেন। হঠাৎ এক বিকেলে ফ্যাকাল্টি লবিতে দেখা - রতন বিকেলে ফ্রি আছো? - হ্যাঁ স্যার। কেনো বলুনতো? - ফ্রি থাকলে টিএসসি তে চলে আয়! - বিশেষ কিছু আছে স্যার? কিছু নিয়ে আসবো? - না, হাফিজ এসেছে ইংল্যান্ড থেকে, আতাউর আসবে। তুই মোস্তফাকে নিয়ে ৭ টার দিকে চলে আয়।
বলা প্রয়োজন আমাদের ফ্যাকাল্টির প্রগতিশীল সদ্য শিক্ষকেরা ছিলেন আমাদের বন্ধুর মতো। আমি একটু আনাড়ি ও বহির্মুখী হওয়ার কারণে তাঁরা আমাকে আলাদা করে ভালো বাসতেন। মনসুরুল আমিনের মতো অনেকেই আমাকে তুই তুই করে সম্বোধন করতেন। এই সম্বোধন ছিলো অনেক স্নেহ আর অনেক ভালোবাসা মাখা। যাই হোক, সেদিন বিকেলে আমি ও আমার রুমমেট অগ্রজ মাহবুব মোস্তফা ভাইকে নিয়ে মনসুরুল আমিন স্যারের টিএসসির ষ্টুডিও এপার্টমেন্টে হাজির হলাম। সেখানেই হাফিজ স্যারের সাথে প্রথম পরিচয়। উঁচু লম্বা ফর্সা সুঠাম ঝাঁকড়া চুলে সুঠাম দেহের অধিকারী এক যুবক। প্যারাসাইটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। এক পর্যায়ে মনসুরুল আমিন স্যার কাছে ডাকলেন। ফিসফিসিয়ে আমার কানে কানে কিছু বললেন। আমি যথারীতি তাঁর নিত্য দিনের সহকারী বাবুলকে নিয়ে কো-অপারেটিভ মার্কেট থেকে সিঙ্গারা, ডালপুরি, ছোলাভাজি আর এক প্যাকেট ৫৫৫ সিগারেট নিয়ে ফিরে এলাম। জম্পেশ আড্ডা হয়েছিলো সেই বিকেলে। নবাগত হাফিজ স্যার সেদিন ছাত্র শিক্ষক ত্রিমাত্রিক সম্পর্কের উপর একটি সংজ্ঞা আমাদের বলেছিলেন তা এখনো আমার মনে গেঁথে আছে ও আমি লালন করি। তিনি বলেছিলেন: “Teacher is a friend, a philosopher and a guide of a student” অর্থাৎ প্রকৃত শিক্ষক একজন ছাত্রের ভালো বন্ধু, দার্শনিক ও পরিচালনাকারী হবেন। স্যারের এই সংজ্ঞায় আমরা আপ্লুত হলাম! সেই থেকেই অন্ততঃ এই তিনজন শিক্ষকের সাথে আমাদের সম্পর্কটা ছিলো বন্ধুর মতোই নিবিড়।
এর পর একাডেমিক প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে স্যারদের বাসায় যেতাম। লাভ ছিলো দ্বিমাত্রিক, এক: তাঁদের আনুকূল্য লাভ এবং দ্বিতীয়ত: ভাবীর হাতের এগ নুডলস, এগ রোল, ভাপা পিঠা সহ নাম না জানা অনেক ইংলিশ খাবার। বলা প্রয়োজন আতাউর ভাই ও মনসুর ভাই তখনো বিয়ে করেননি। সুতরাং একমাত্র ভাবী ছিলেন টিনা ভাবী। অর্থাৎ মিসেস হাফিজ। সব ইয়ং টিচার আর আমাদের মতো বাদাইম্মা ছাত্রদের আড্ডা ছিলো হাফিজ স্যারের বাসায়। টিনা ভাবিও আমাদের খুব পছন্দ করতেন। নিত্য নতুন আইটেম করে খাওয়াতেন। আর সেই লোভে আমরা “শিয়ালের সেই ভাঙা বেড়া” দেখানোর গল্পের মতো তাঁর স্টাফ কোয়ার্টারে গিয়ে ঢু মারতাম।
হাফিজ স্যারের মুখাবয়টা ছিলো মঙ্গলয়েড। অর্থাৎ চাকমাদের মতো দেখতে। একদিন আড্ডার সময় এই প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি কিছুক্ষণ যেনো কি ভাবলেন। মনে হলো স্মৃতির মণিকোঠা হাতড়ে বেড়াচ্ছেন! কিছুক্ষণ পরে চোখ খুললেন। - আচ্ছা রতন, তুমি ইএসপির কথা শুনেছো? - জ্বিনা স্যার। ইএসপি কি স্যার? - ইএসপি হলো এক্সট্রা সেন্সরি পার্সেপশন। অর্থাৎ যাঁদের এটা আছে তাঁরা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। আমার মনে হয় ইএসপি প্রবল! আমার স্নায়ু সজাগ হলো। - স্যার একটু বিস্তারিত বলবেন।
শোনো তাইলে। অন্যের কাছে বললে সবাই নির্ঘাত আমাকে পাগল বলবে। আমার কেনো জানি মনে হলো তুমি এই কাহিনীটা বিশ্বাস করবে। কারণ তোমরা তো পুনর্জন্মে বিশ্বাস করো? - আমি এ মিথ শুনেছি কিন্তু বিস্তারিত জানিনা স্যার। - শোনো ছেলেবেলা থেকে আমি ভোররাতে যতগুলো স্বপ্ন দেখেছি তার সবগুলোই ফলে গেছে। আমি নিজেও অবাক হয়েছি! আমি আমার পূর্বজন্ম দেখতে পেয়েছি। একবার নয়, একাধিক বার। আমি সম্মোহিত হলাম। গুটি শুটি মেরে একাগ্র মনে স্যারের গল্প শুনছি। গায়ের পশমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ স্যারের মুখের দিকে। তিনি চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে চলেছেন।
আমি পূর্বজন্ম হয়েছিল একজন কোরিয়ান কৃষকের ঘরে। আমার বাবা-মায়ের পাঁচ সন্তানের মধ্যে আমি ছিলাম সবার বড়। আমার ছেলেবেলায় পড়াশুনার পাশাপাশি বাবাকে মাঠ চাষে সাহায্য করতাম। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিলো ছোট্ট একটি নদী। আমাদের দুটো ডিঙি নৌকা ছিলো। একটি করে আমরা মাছ ধরতাম আর অন্যটি দিয়ে হাট বাজার ও কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কাজে ব্যবহার করতাম। আমাদের বাড়িতে একটি ছোট্ট বুদ্ধ মন্দির ছিলো। মা প্রতিদিন সকালে সেখানে মোমবাতি জ্বালাতো। বাবা মাঠে যাওয়ার আগে সেখানে প্রার্থনা করতো। প্রার্থনার শেষ কথা ছিলো, নির্বাণ। আমার অন্য দু ভাই ও স্কুলে পড়তো। বোন দুটো ছোটো ছিলো। আমি ছিলাম হাড় জিরজিরে। আমার নাকি ক্ষয়রোগ হয়েছে। আমি নাকি বেশিদিন বাঁচবোনা। তাই আম্মা ঈশ্বর বুদ্ধের কাছে আমার রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনা করতেন। এর মধ্যে দরজায় কলিং বেলের শব্দে স্যারের গল্প বন্ধ হয়ে যায়। ভাবীকে উদ্দেশ্য করে বললেন - দেখতো টিনা কে এসেছে! ভাবি দরোজা খুলতেই আতাউর ভাই আর মনসুরুল আমিন স্যার হাতে দুটো ঠোঙ্গা নিয়ে হুড়মুড় করে ঘরে ঢোকে। হাফিজ স্যারের মুখ উজ্জ্বল হয়। ও তোমরা এসে গেছো! আমি ওদের সাথে গল্প করছিলাম। আমি বলে উঠলাম - স্যার আমরা তাইলে আজ উঠি! স্যার বললেন, না তোমরা থাকতে পারো। আজ একটা ইন্টারেষ্টিং ইভেন্টের পরিকল্পনা আছে। আমি আর মনসুর আজ প্ল্যানচেটে বসবো। তোমরাও থাকতে পারো। কিন্তু কোনো কথা বলতে পারবেনা। পিন-ড্রপ সাইলেন্স! পারবে? আমরা বোকার মতো স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। - স্যার, প্ল্যানচেট কি? - প্ল্যানচেট হলো একটি পবিত্র বোর্ড। ওই বোর্ডে মৃত যে কোনো ব্যক্তির আত্মাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অনেক আত্মা আসতে চায়না তখন অন্য আত্মাকে ডাকতে হয়। তাকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়। ব্যাপারটা মাথায় ঢুকলোনা বলে প্রাক্টিক্যালি দেখার অদম্য ইচ্ছেটা চেপে রাখতে পারলাম না। এর মধ্যে টিনা ভাবি এসে বললো - - তোমাদের চা দেই? হাফিজ স্যার বললেন - না এখন না। প্ল্যানচেট সেশন শেষ হলে চা খাবো।
আমাদের সবাইকে পাশের রুমে নিয়ে গেলেন স্যার। রুমের মাঝখানে একটি টেবিল আর তাকে ঘিরে ৬ টি চেয়ার। হাফিজ স্যার আর মনসুর স্যার মুখোমুখি বসলেন। আমরা অন্য চেয়ারগুলোতে বসলাম। হাফিজ স্যার একটি বাক্স থেকে লুডু খেলার বোর্ডের মতো একটি বোর্ড বের করলেন। বোর্ডের উপরিভাগে ইংরেজিতে লিখা “welcome”, নিন্ম ভাগে-“Good bye”, ডান প্রান্তে- “Yes” আর বাম প্রান্তে “No” এর সাথে চক্রাকারে সাজানো আছে A থেকে Z ও 1 থেকে 9 এবং 0 পর্যন্ত। আছে একটি হালকা সাদা রঙের বোতলের ছিপির মতো একটা কর্ক যা সহজেই ওই বোর্ডের উপর চলাফেরা করতে পারে। দু’জনের অনামিকা দিয়ে ওই ছিপি যা বোর্ডের কেন্দ্রে স্থাপন করে মুখোমুখি বসে দু প্রান্তে আলতো করে স্পর্শ করতে হবে। হাফিজ স্যার রুমের বাতি নিভিয়ে দিলে এক ভৌতিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তারপর তিনি একটি মোমবাতি জ্বালালেন। আবছা আলো আধারিতে দুজন মুখোমুখি বসলেন। আমি আর মোস্তফা ভাই নীরব দর্শক। আতাউর ভাই ভাবীর হাতের চা আর মার্কেট থেকে কেনা সিঙ্গারা খাচ্ছে ড্রয়িং রুমে বসে। পুরো প্রক্রিয়াটি ইংরেজিতে। পাঠকদের বোঝার সুবিধার জন্য আমি অনুবাদ করে দিচ্ছি।
দুই স্যার প্ল্যানচেটে বসার আগে শলা পরামর্শ করছেন কার কার আত্মাকে আবাহন করবেন। ঠিক হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, শেখ মুজিব, মার্গারেট থ্যাচার, আব্রাহাম লিঙ্কনের এঁদের আত্মাকে আবাহন করবেন। প্রক্রিয়া শুরু হলো। দুজন দু’পাশ থেকে কর্কের দু’প্রান্ত আলতো করে স্পর্শ করে চোখ বন্ধ করে একাগ্ৰ ভাবে ডাকছেন - - হে রবি ঠাকুরের শুদ্ধ আত্মা আমরা আপনাকে প্ল্যানচেট বক্সে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এই প্রক্রিয়া কয়েক মিনিট চলার পরে কর্ক নড়ে উঠলো। আমার শরীরও কাঁটা দিয়ে উঠলো। কর্ক ধীরে ধীরে Welcome বাটনের দিকে চলতে শুরু করলো। সেখানে স্পর্শ করার পর আবার কর্ক কেন্দ্রের কাছে চলে এলো। হাফিজ স্যার প্রশ্ন করলেন - হে শুদ্ধ আত্মা, আপনি কি আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি আছেন?
এরপর কর্কটি No লিখা বাটনের দিকে চলতে শুরু করলো। স্যারদের চোখে মুখে হতাশা দেখতে পেলাম। এরপর কর্কটি Good bye বাটনের দিকে চালিয়ে তাঁর আত্মাকে বিদায় জানানো হলো। এরপর তাঁরা মহাত্মা গান্ধীর আত্মাকে আবাহন করলেন। একই প্রক্রিয়ায় তাকে ওয়েলকাম করে প্ল্যানচেট বক্সে নিয়ে আসলেন। তিনি উত্তর দিতে রাজি হলে স্যার তাঁকে নানান রকম প্রশ্ন করেন ও সম্ভাব্য উত্তর জিজ্ঞেস করলে আত্মা Yes অথবা No জবাব দিতো। সময় সংক্রান্ত প্রশ্ন হলে কর্কটি 0 থেকে 9 এর দিকে গিয়ে একটি সংখ্যা-মান নির্দেশ করতো। স্যারেরা অনেক প্রশ্ন করেছিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রশ্ন ও উত্তর বলছি। হাফিজ স্যার প্রশ্ন করেছিলেন - - এরশাদ সাহেব কত বছর ক্ষমতায় থাকবেন? উত্তর ছিলো ৭ বৎসর। - মনসুরুল আমিনের বিয়ে কত বৎসরে? উত্তর ছিলো No আমরা মুচকি হাসলাম। স্যার আবার প্রশ্ন করলেন - ব্রিটেনে এরপর কারা ক্ষমতায় আসবে লেবার না লিবারেল? লিবারেল বলার পরে -Yes হলো - ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে কে জয়ী হবে? ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড - No লিভারপুল - No রেঞ্জার্স - Yes - মনসুরুল আমিন তার টেনিস ব্যাট কোথায় হারিয়েছে? কো-অপেরাটিভ মার্কেট - No ডিপার্টমেন্ট - No টয়লেট - Yes
আরো অনেক প্রশ্ন তাঁরা করেছিলেন। সবটা মনেও নেই। উত্তরের সত্যতাগুলোও যাচাই করিনি কোনোদিন। তবে পরে জেনেছি এরশাদ সাহেব প্রায় দু টার্ম ক্ষমতায় ছিলেন। মনসুরুল আমিন স্যার চির কুমার ছিলেন। আজ প্রবাসে বসে আমার এই প্রিয় তিনজন শিক্ষক তথা প্রিয় তিন বন্ধুর কথা মনে পড়ছে। তাঁরা নিকটজন সবাইকে ছেড়ে, সব কাজ অসমাপ্ত রেখে জীবনের মধ্য দুপুরেই ওপারে পাড়ি জমালেন। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন। আমিও হয়তো একদিন প্ল্যানচেট এ আপনাদের আত্মাকে আলাদা আলাদা ভাবে নিয়ে আসবো। আপনাদের প্রত্যেককে একই প্রশ্ন করবো: - আপনি কি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন? আপনি কি আমাকে আগের মতোই স্নেহ করেন? আপনার কি কষ্ট হয়না? তারপর উত্তরগুলো মিলিয়ে বিদায় নেবো।
স্থান: প্রিন্স অফ ওয়েলস হাসপাতাল, আইসোলেশন ওয়ার্ড, সিডনি তারিখ: ২১ সে ফেব্রুয়ারি ২০২১
ড. রতন কুন্ডু, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|