স্বপ্না ভট্টাচার্য (এক অসমাপ্ত মহাকাব্য) রতন কুণ্ডু (২য় অংশ)
এরপর বাসা নিলাম বোটানিতে। আবার সেই স্বপ্না বৌদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। আবার আমরা নতুন করে সংসার শুরু করলাম। পরমেশ সেদিন কো- অর্ডিনেটর হয়ে সবাইর সাথে যোগাযোগ করে আবারও আমাদের উঠে দাড়াতে সাহায্য করেছে। আর এর পেছনে ছিলো স্বপ্না বৌদির অনুপ্রেরণা। স্বপ্না বৌদিকে কাছে থেকে যতই দেখেছি ততই অবাক হয়েছি। আমাদের উপমহাদেশে একজন স্নেহময়ী নারীর যত গুন থাকা দরকার সব তাঁর মধ্যে ছিল। বুদ্ধি, বিবেচনা, শিক্ষা, জ্ঞান, সামাজিকতা, পরোপকার কোন কিছুরই কমতি তার মধ্যে ছিলনা। এমন কি নিজের সংসার পরিচালনা, স্বামীকে সৎ পরামর্শ, ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা, শিক্ষা, নিয়মতান্ত্রিকতা এই পরিবারটিকে একটি আদর্শ পরিবার হতে সাহায্য করেছিল। তার উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় রিতু সাবলীল ভাবে বাংলা লিখতে ও পড়তে পারে। বাংলা উপন্যাস তার প্রিয়। মায়ের অনুপ্রেরণায় সোসাইটির অনুষ্ঠানে নাচ, গান ও বিতর্কে সে অদ্বিতীয়। শিক্ষা ক্ষেত্রেও তার অসামান্য অগ্রগতি। ক্লাসে সর্বোচ্চ মেধাবী ছাত্রী হিসেবে সিডনী গার্লস' এর মত সিলেকটিভ স্কুলে চান্স পাওয়া সবই মা-বাবার অবদান। ঋত্বিক তাদের ছেলে। ছেলেটিও ও.সি তে চান্স পেয়েছে। সামাজিক অনুষ্ঠানে ঋত্বিকের গান, নাচ, নাটক ও র্যা ফেল এর টিকেট বিক্রি করে মন্দিরের জন্য অর্থ উত্তোলন তাঁরই অনুপ্রেরণার ফসল। স্বামীকে উপদেশ, নির্দেশ, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেয়া ছাড়াও সংসারের সচ্ছলতার জন্য রাতভর ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। নিজের স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশের জন্য কখনই কাতর ছিলেন না । আমাদের কষ্টময় সময়গুলোতেও স্বপ্না বৌদি আমাদের অনেক উপদেশ ও মনস্তাত্বিক সাপোর্ট দিয়েছিলেন । তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন - -চিন্তা করুইন না যে। ভগবান আছে । কষ্ট চিরদিন থাকেনা। একদিন সুখে সন্ধান পাবেন। মিথ্যার জয় কোনদিন হবে না । সত্যই জয়ী হবে।
তাঁর কথা সত্যি হয়েছিল আমার ও অনেকের জীবনেই। কিন্তু এই ক্ষণজন্মা মহীয়সী নারীর জীবনে যে এক অনাকাঙ্ক্ষিত সত্য লুকিয়ে ছিল আমরা তা কোনদিনই বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারিনি -
"বাক্য-ভারে রুদ্ধ-কণ্ঠে রে স্তম্ভিত প্রাণ, কোথায় হারায়ে এলি তোর যত গান। বাঁশী যেন নাই, বৃথা নিশ্বাস কেবল- রাগিণীর পরিবর্তে শুধু অশ্রুজল ॥"
এই মহীয়সী নারী ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করে অবশেষে মৃত্যুর কাছে হেরে গেলেন। অবশেষে বিগত তেসরা জুলাই ২০১২ মঙ্গলবার সকাল ৫.১৫ মিনিটে তিনি সবার মায়া ত্যাগ করে পরপারে চলে গেলেন। ভাবতে অবাক লাগে যে তাঁর চলে যাওয়ার আগ মূহুর্তেও তার বুদ্ধি বিবেচনা একটুকুও লোপ পায়নি । পরমেশ তার বিপদে আপদে অমল ও বর্নাকে কাছে পেলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সেদিন হাসপাতালে স্বপ্নাবৌদির মৃত্যুশয্যায় বসে পরমেশ যখন অমলকে কল করতে যাচ্ছে তখন তিনি ইশারায় তাকে কল করতে নিষেধ করেন । ফিসফিসিয়ে বললেন - ওদের ছোট বাচ্চা, রাতে ভালোভাবে ঘুমাতে পারেনা । ওদের বিরক্ত করোনা । মৃত্যু পথযাত্রী একজন মানুষের এই বিবেচনা শক্তি আমাদের বিস্মিত করে, আপ্লুত করে। বিগত ৪ঠা জুলাই ২০১২ ম্যাট্রাভিল সিমেটারীতে তার শেষকৃত্য সম্পাদিত হয় । জাতি-ধর্ম-বর্ণ -নারী -পুরুষ ভেদে কমিউনিটির প্রায় তিনশত লোক সেই শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। সবার কান্নায় সেদিন ম্যাট্রাভিল সিমেটারীর সাউথ চ্যাপেলের বাতাস ভারী হয়ে গিয়েছিল । খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলেন প্রাক্তন পুলিশ মিনিস্টার মাইকেল ডালী এম.পি সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দও । তাদের মেয়ে অনন্যা ভট্টাচার্য (রিতু) মাইক্রোফোনে কান্নায় ভেঙে পরলে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয় । সে সবার কাছে তার মায়ের বিদেহী আত্মার শান্তি ও স্বর্গবাস প্রার্থনা করেছে। আপনারা সবাই এই মহীয়সী নারীর আত্মার সদ্গতি ও স্বর্গপ্রাপ্তির জন্য প্রার্থনা করবেন। পরিশেষে বলতে ইচ্ছে করছে- "তাই তব অশান্ত ক্রন্দনে চির মৌন-জাল দিয়ে বেঁধে দিলে কঠিন বন্ধনে। জ্যোৎস্না রাতে নিভৃত মন্দিরে -প্রিয়রে যে নামে ডাকিতে ধীরে ধীরে সেই কানে - কানে ডাকা রেখে গেলে এইখানে অনন্তের কানে।"
< ১ম অংশে ফিরে যাবার জন্য এখানে ক্লিক করুন
|