bangla-sydney













কথক থিয়েটার আয়োজিত
“ময়ূখ নামের এখানে কেউ থাকেনা”
ড. রতন কুন্ডু



গত পহেলা ও দোসরা জুলাই সিডনির ব্যাংকসটাউন আর্ট সেন্টারে মঞ্চায়িত হল কথক থিয়েটার প্রযোজিত নাটক “ময়ূখ নামের এখানে কেউ থাকে না”। ইংলিশ নাট্যকার শেক্সপিয়ারের “ম্যাকবেথ” নাটকের ছায়া অবলম্বনে রচিত হয়েছে এই নাটকটি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাটের একটি গ্রুপ থিয়েটারের নাট্য-দ্বন্দ্ব নিয়ে এই নাটকটি রচিত হয়েছে। নাটকটি রচনা করেছেন দিব্যেন্দু দাশগুপ্ত ও নির্দেশনায় ছিলেন কথক থিয়েটারের পুরোধা টিটো রায়। মূল ভূমিকায় অভিনয় করেছেন কলকাতা থেকে আগত নাট্য অভিনেতা পার্থপ্রতিম দেব ও তুলি রায়। অন্যান্য ভূমিকায় অভিনয় করেছেন কলকাতা থেকে আগত নাট্য শিল্পী রুপা দেব, স্থানীয় শিল্পী শর্মিলা রায়, তামিম মিনারুল মান্নান সহ এপার বাংলা ও ওপার বাংলার “কথক” কুশীলবেরা।

ম্যাকবেথ হলো স্কটল্যান্ডের রাজা ডানকানের সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল এবং গ্লামিসের অমাত্য। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যুদ্ধ-সঙ্গী ব্যাঙ্কোকে নিয়ে যখন ফিরে আসছেন ম্যাকবেথ তখন ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা । ওরা তখন নির্জন এক প্রান্তর পেরুচ্ছে, ঠিক এ সময় ওদের সামনে মাটি ফুড়ে বেরিয়ে এলো ভয়ঙ্কর-দর্শন তিন ডাইনী।

তিন ডাইনি ম্যাকবেথ সম্পর্কে একে একে তিন ভবিষ্যৎবাণী করলো: ম্যাকবেথকে তারা লর্ড অভ গ্ল্যামিস, লর্ড অভ কডর ও স্কটল্যান্ডের নতুন রাজা হবে বলে ভবিষ্যৎবাণী করলো। লেডি ম্যাকবেথও স্বামীর চেয়ে কম উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়। ভবিষ্যদ্বাণীর সফলতার জন্যে সব কিছু করতে প্রস্তুত সে। মহিলা বুদ্ধিমতী। তার বুঝতে অসুবিধা হল না ডানকান যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন ম্যাকবেথের রাজা হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। ছলে বলে কৌশলে সরিয়ে দিতে হবে পথের কাটা ডানকানকে। সে ঠিক করল এ ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করবে স্বামীর ওপর। এভাবেই স্ত্রীর পরামর্শে ম্যাকবেথ, রাজা ডানকান, প্রহরী ম্যাকডাফ, লেনক্স, ব্যাংকো, ফ্লিয়ান্স সহ তাঁর পথে কাঁটা হতে পারে এমন সবাইকে একে একে খুন করে। কিন্তু মনে শাস্তি নেই তার। সিংহাসনে নিরাপদ বোধ করছে না সে । তীব্র অপরাধ বোধে দগ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত, কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। পরিশেষে বার্ণামের জঙ্গলে ম্যাকডাফের হাতে খুন হন ম্যাকবেথ। ম্যাকবেথের ছিন্ন-মুণ্ডু দেখে সবাই খুশি হল। ম্যালকমকে সবাই তাদের রাজা বলে ঘোষণা করল।

ঠিক একইভাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাটের এক নাট্য সম্প্রদায়ের কুশীলবদের জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত এক ভয়ংকর পরিণতি নিয়ে এ নাটকটি রচিত হয়েছে। স্থানীয় নাট্য সম্প্রদায়ের কুশীলবদের দ্বান্দ্বিক পরম্পরা এই নাটকটিকে শেক্সপিয়ারের “ম্যাকবেথের” সাথে একাকার করে দিয়েছে। রানাঘাট এক্সপ্রেসে ব্যাগ বদল হওয়ায় হঠাৎ কুড়িয়ে পাওয়া অর্থ এই অনিষ্টের মূল কারণ। আর দ্বিতীয় কারণ হলো মূল কুশীলবের স্ত্রীর উচ্চাশা ও একটি সন্তান লাভের প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা। স্ত্রীর প্ররোচনায় সেই মূল কুশীলব অনিচ্ছা সত্ত্বেও একে একে সেই নাট্যগোষ্ঠীর প্রযোজক পরিচালক, অর্থলোভী পুলিশ সহ অন্যান্য কুশীলবদের হত্যা করে। প্রচণ্ড অনুশোচনা ও ভয়ে সেই মূল কুশীলব টাকার ব্যাগটি পুড়িয়ে ফেলে। ঘটনার ভয়াবহতায় সেই মূল কুশীলবের স্ত্রী পাগল হয়ে যায় এবং পরিশেষে নিজের বুকে ছুড়ি চালিয়ে আত্মহত্যা করে। কি এক করুন ক্যাথারসিস! নাটকের শেষে মূল কুশীলবের কণ্ঠে আমরা শুনতে পাই যে, ময়ূখ চ্যাটার্জী নামের আসলে কেউ কোনদিন ছিল না। ময়ূখ নামের এখানে কেউ থাকেনা। ময়ূখ আসলে একটি ইলিউশান। ভয়ংকর অত্যাচার, হাতুড়ি দিয়ে হত্যা, প্রচুর রক্তপাত দিয়ে নাটকটিকে একটি বীভৎস রূপ দেয়া হয়েছে। আলোকসম্পাতে কিছুটা সমস্যা থাকলেও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক যথাযথ ছিলো। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক নাটকের আবহ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। সব কুশীলবেরাই খুব সুন্দর পারফর্ম করেছেন। বিশেষ করে পার্থ প্রতিমের অনবদ্য অভিনয় ও তুলি রায়ের বিভিন্ন অভিব্যক্তি দিয়ে চোখের কাজগুলো দর্শকদের বিমোহিত করেছে। যদিও পার্থ প্রতিমের সংলাপের পৌনঃপুনিকতা একটা টান টান উত্তেজনা ধরে রাখতে পারলেও কিছুটা অতিরঞ্জন মনে হয়েছে। এসব সামান্য ত্রুটি বিচ্যুতি ব্যতীত ময়ূখ নামের এখানে কেউ থাকেনা একটি চমৎকার প্রযোজনা নিঃসন্দেহে। আবহমানকাল ধরে বেঁচে থাক বাংলার নাট্য সংস্কৃতি ও নাট্য চর্চা, দেশে ও বিদেশে।




ড. রতন কুন্ডু, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া







Share on Facebook               Home Page             Published on: 10-Jul-2023

Coming Events: